জাতীয় স্বার্থের সংজ্ঞা দাও। বিদেশনীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের ভূমিকা পর্যালোচনা করো।

জাতীয় স্বার্থের সংজ্ঞা

জাতীয় স্বার্থের সংজ্ঞা নিয়ে বিশেষজ্ঞগণ একমত নন। হার্টম্যান বলেছেন, জাতীয় স্বার্থ হল তাই যাকে প্রতিটি রাষ্ট্র অর্জন ও সংরক্ষণ করতে বিশেষভাবে আগ্রহী। কোনো রাষ্ট্র যখন অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কস্থাপনে সচেষ্ট হয় তখনই এই স্বার্থের উন্মেষ ঘটে। অধ্যাপক ফ্র্যাঙ্কেল মনে করেন, জাতীয় স্বার্থ হল জাতীয় মূল্যবোধের সমষ্টি। তাঁর মতে, ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক যেভাবে ব্যক্তিগত লাভক্ষতির হিসেবনিকেশ দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে, আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কও সেভাবে জাতি-রাষ্ট্রের লাভক্ষতির অঙ্ককে সামনে রেখে পরিচালিত হয়। ফ্র্যাঙ্কেল, এই লাভক্ষতির হিসাবকে জাতীয় স্বার্থরূপে অভিহিত করতে চেয়েছেন। বাস্তববাদী তত্ত্বের প্রবক্তা মর্গেনথাউ-এর অভিমত অনুসারে যে-কোনো রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি হল জাতীয় স্বার্থ। প্রতিটি রাষ্ট্র ভৌগোলিক অখণ্ডতা বজায় রাখা, প্রচলিত রাজনৈতিক- অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে রক্ষা করা এবং রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক সত্তা অক্ষুর রাখার মতো কয়েকটি ন্যূনতম স্বার্থপূরণ করতে চায়।

সুতরাং, উপরোক্ত আলোচনা থেকে জাতীয় স্বার্থের একটি মোটামুটি গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা দেওয়া যেতে পারে। জাতীয় স্বার্থ বলতে জাতীয় নিরাপত্তা, জাতীয় উন্নয়ন, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ইত্যাদি ন্যূনতম রাষ্ট্রীয় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে বোঝায়, যেগুলি পূরণের জন্য প্রতিটি রাষ্ট্রই সক্রিয় উদ্যোগ নেয়।

বিদেশনীতি নির্ধারণে জাতীয় স্বার্থের ভূমিকা

কোনো দেশের বিদেশনীতি নির্ধারণে ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নির্ণয়ে সেই দেশের জাতীয় স্বার্থ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। জাতীয় স্বার্থকেই প্রতিটি রাষ্ট্র বিদেশনীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে ভিত্তিগত উপাদান হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। তাই কোনো দেশের বিদেশনীতি তথা বৈদেশিক সম্পর্ক জাতীয় স্বার্থ-বহির্ভূত অন্য কোনো শর্ত মেনে গড়ে ওঠে না।

প্রকৃতপক্ষে, জাতীয় স্বার্থের প্রেক্ষাপটেই পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলি একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হয় এবং সেইমতো নিজেদের বিদেশনীতি গ্রহণ করে থাকে। বলা বাহুল্য, প্রতিটি রাষ্ট্রের বিদেশনীতি গড়ে ওঠে তার জাতীয় স্বার্থকে চরিতার্থ করার জন্য। জাতীয় স্বার্থের মধ্যে জাতীয় আশা, আকাঙ্ক্ষা, রুচি, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ এবং বিকাশের ইঙ্গিত নিহিত থাকে। একটি রাষ্ট্রের এই সমস্ত স্বার্থপূরণ নির্ভর করে সেই রাষ্ট্রের সঠিক বিদেশনীতির ওপর। আজকের আন্তর্জাতিক পরিবেশে পৃথিবীর প্রায় সব রাষ্ট্রই গৃহীত ও অনুসৃত বিদেশনীতির মধ্যে দিয়ে সর্বাধিক পরিমাণে নিজ নিজ জাতীয় স্বার্থকে চরিতার্থ করার চেষ্টা করে থাকে। তা ছাড়া প্রতিটি রাষ্ট্রই আন্তর্জাতিক পরিবেশে তার নিজস্ব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কীভাবে বজায় রাখবে তা জাতীয় স্বার্থের ধারণার ওপর নির্ভর করে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থকরা মনে করেন যে, কোনো রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতির মূল ভিত্তি হল জাতীয় স্বার্থ। কোনো রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি জাতীয় স্বার্থের ধারণাকে অতিক্রম করে গড়ে ওঠেনি বা গড়ে ওঠা সম্ভবও নয়। কারণ, আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের ধারণা মুখ্য ভূমিকা পালন করে। যেমন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন

যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমানে অবলুপ্ত) পৃথক পৃথকভাবে যে দুটি সামরিক ও অর্থনৈতিক জোট গঠিত হয়েছিল, সেই দুটিরই মূল উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের জাতীয় স্বার্থকে সুরক্ষিত ও প্রসারিত করা। আবার ওই সময় সোভিয়েত ও মার্কিন জোটের বাইরে অবস্থানকারী রাষ্ট্রগুলিও জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনেই জোটনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করেছিল।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, জাতীয় স্বার্থই হল কোনো রাষ্ট্রের বিদেশনীতির মূলমন্ত্র। তবে বৈদেশিক নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে নিজের জাতীয় স্বার্থকে গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি কোনো ক্ষেত্রেই অন্ধ জাতীয় স্বার্থকে প্রশ্রয় না দেওয়াও জরুরি। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক স্বার্থ ও বিশ্বমানবতার স্বার্থকে গুরুত্ব দেওয়াই বাঞ্ছনীয়। এর ফলেই বিদেশনীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের ধারণা অর্থবহ ও কার্যকর হয়ে উঠবে।

Leave a Comment