জাতীয় স্বার্থের ধারণা বিশ্লেষণ করো। অথবা, জাতীয় স্বার্থের সংজ্ঞা দাও। কীভাবে তুমি জাতীয় স্বার্থের শ্রেণিবিভাজন করবে ?

জাতীয় স্বার্থের ধারণা

বিদেশনীতির অন্যতম নির্ধারক ও নিয়ন্ত্রক হিসেবে জাতীয় স্বার্থের গুরুত্ব নিয়ে কোনো সংশয় না থাকলেও জাতীয় স্বার্থ বলতে ঠিক কী বোঝায় সে-বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞরা একমত হতে পারেননি। বস্তুত, জাতীয় স্বার্থের ধারণা অত্যন্ত অস্পষ্ট হওয়ায় এর সর্বজনগ্রাহ্য কোনো সংজ্ঞা নির্ধারণ করা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য।

পল সিবিউরি দুটি অর্থে জাতীয় স্বার্থের ধারণাকে ব্যাখ্যা করেছেন, তাঁর মতে- 1 জাতীয় স্বার্থ হল কিছু আদর্শস্থানীয় উদ্দেশ্যের সমষ্টি। ② জাতীয় স্বার্থ হল সেইসব উদ্দেশ্যের সমষ্টি যা প্রতিটি জাতি ও তার নেতৃবৃন্দ সবসময় অনুসরণ করে।

হার্টম্যান বলেছেন, জাতীয় স্বার্থ হল তা-ই যাকে প্রতিটি রাষ্ট্র অর্জন ও সংরক্ষণ করতে বিশেষভাবে আগ্রহী। কোনো রাষ্ট্র যখন অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কস্থাপনে সচেষ্ট হয়, তখনই এই স্বার্থের উন্মেষ ঘটে। হ্যান্স জে মর্গেনথাউ রাজনৈতিক বাস্তবতার দৃষ্টিকোণ থেকে জাতীয় স্বার্থের ধারণা ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে, যে-কোনো রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি হল জাতীয় স্বার্থ। কোনো রাষ্ট্র জাতীয় স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে বিদেশনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থির করে না। প্রতিটি রাষ্ট্রের কতকগুলি ন্যূনতম স্বার্থ থাকে, যেমন-ভৌগোলিক অখণ্ডতা বজায় রাখা, প্রচলিত রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে রক্ষা করা এবং রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক সত্তা অক্ষুণ্ণ রাখা। এই সমস্ত স্বার্থপূরণ করাই যে-কোনো রাষ্ট্রের লক্ষ্য। মর্গেনঘাউ-এর অভিমত হল, জাতীয় স্বার্থের ধারণার সঙ্গে দেশের অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িত রয়েছে। বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ তার সামর্থ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া বাঞ্ছনীয়। মর্গেনথাউ আরও মনে করেন যে, জাতীয় স্বার্থের ধারণা শুধু যে নিজের জাতির স্বার্থের ধারণা সম্পর্কে সচেতন করে তাই নয়, অন্য জাতির  স্বার্থ সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল করে।

জোশেফ ফ্রাঙ্কেলের বক্তব্য অনুযায়ী, সংক্ষেপে এবং স্পষ্ট করে  জাতীয় স্বার্থের ধারণা ব্যাখ্যা করা সহজ নয়। কোনো নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ বলতে কী বোঝায় তা বলাও সম্ভব নয়। তবে বিদেশনীতি রূপায়ণের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের ধারণা যে মুখ্য ভূমিকা পালন করে সে বিষয়ে তিনি দ্বিমত পোষণ করেননি। জাতীয় স্বার্থ শুধু যে একটি দেশের আশা-আকাঙ্ক্ষার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে তাই নয়, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও অন্য রাষ্ট্রের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ওপরও তা নির্ভরশীল। ফ্ল্যাঙ্কেলের মতে, জাতীয় স্বার্থ হল বিদেশনীতির মুখ্য ধারণা (National interest is the key concept in foreign policy) | তিনি এই অভিমতও পোষণ করেন যে, জাতীয় স্বার্থের ধারণা জাতীয় মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত।

প্রকৃত অর্থে জাতীয় স্বার্থ হল জাতীয় উন্নয়ন, জাতীয় নিরাপত্তা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ইত্যাদি ন্যূনতম রাষ্ট্রীয় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সমষ্টি যেগুলি অর্জনের জন্য প্রতিটি রাষ্ট্রই সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করে। মানবসমাজে যেমন ব্যক্তিগত লাভক্ষতির ধারণার দ্বারা ব্যক্তির আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রিত হয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তেমনই রাষ্ট্রও মূলত জাতীয় স্বার্থের দ্বারা চালিত হয়। জাতীয় স্বার্থরক্ষা করাই হল প্রত্যেক দেশের বিদেশনীতির মূল লক্ষ্য। জাতীয় স্বার্থের ধারণার মধ্যে রাষ্ট্রের নিজস্ব লাভক্ষতির হিসেবনিকেশ নিহিত থাকে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনা নিয়ন্ত্রণকারী একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল জাতীয় স্বার্থের ধারণা।

জাতীয় স্বার্থের শ্রেণিবিভাগ

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রেক্ষিতে জাতীয় স্বার্থকে নিম্নলিখিত কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যেতে পারে-

[1] মৌলিক বা মুখ্য স্বার্থ: একটি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব যেসব স্বার্থের ওপর নির্ভরশীল সেইসব স্বার্থকেই মৌলিক বা মুখ্য জাতীয় স্বার্থ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। এইসব স্বার্থরক্ষা করতে না পারলে একটি রাষ্ট্রের অস্তিত্বই বিপন্ন হতে পারে। স্বাভাবিক কারণেই এই ধরনের জাতীয় স্বার্থরক্ষার জন্য রাষ্ট্র যে-কোনো মূল্য দিতে প্রস্তুত থাকে। শুধু তাই নয়, এই ধরনের স্বার্থরক্ষার জন্য রাষ্ট্র যুদ্ধে যেতেও দ্বিধা করে না। অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সীমানাগত, রাজনৈতিক ইত্যাদি স্বার্থ হল এই শ্রেণিভুক্ত।

[2] গৌণ স্বার্থ: গৌণ জাতীয় স্বার্থ হল সেইসব স্বার্থ যেগুলি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষার সঙ্গে জড়িত না হলেও সেগুলি রক্ষা করাকে রাষ্ট্র কর্তব্য হিসেবে বিবেচনা করে। এই ধরনের জাতীয় স্বার্থপূরণ করতে রাষ্ট্র আগ্রহী হলেও এগুলি সংরক্ষণের জন্য রাষ্ট্র কখনোই যুদ্ধে যেতে চায় না। গৌগ জাতীয় স্বার্থের দৃষ্টান্ত হিসেবে কূটনৈতিক কর্মীদের কুটনৈতিক সুযোগসুবিধার নিশ্চিতকরণ, বিদেশি কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক বা অন্যান্য সম্পর্ক গড়ে তোলা ইত্যাদি বিষয়ের কথা বলা যায়।

[3] স্থায়ী স্বার্থ: প্রতিটি রাষ্ট্রের এমন কিছু স্বার্থ থাকে যেগুজি অপরিবর্তনীয় ও দীর্ঘমেয়াদি এবং যেগুলির পরিবর্তন হয়ে থাকে অত্যন্ত ধীর গতিতে। এই ধরনের স্বার্থকেই একটি রাষ্ট্রের স্থায়ী জাতীয় স্বার্থ হিসেবে নির্দিষ্ট করা যেতে পারে। যেমন, জাতীয় স্বার্থে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোনে রাষ্ট্রের নিজের প্রভাব সম্প্রসারণের প্রচেষ্টা।

[4] পরিবর্তনীয় স্বার্থ: এই শ্রেণির জাতীয় স্বার্থ হল সেইসব স্বার্থ যেগুল্লি কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে কোনো রাষ্ট্রের জাতীয় কল্যাণের পক্ষে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই ধরনের স্বার্থেরও পরিবর্তন ঘটে। সাধারণভাবে রাজনৈতিক মতাদর্শ, বিদেশনীতি নির্ধারকদের ব্যক্তিত্ব ইত্যাদির দ্বারা এই ধরনের স্বার্থ নির্ধারিত হয়ে থাকে।

[5] সাধারণ স্বার্থ: সাধারণ জাতীয় স্বার্থ বলতে একটি রাষ্ট্রের সেইসব স্বার্থকে বোঝায় যেগুলির অগ্রাধিকার রাষ্ট্র তার গুরুত্ব অনুযায়ী নির্ধারণ করে। ইতিবাচক শর্তযুক্ত এই ধরনের জাতীয় স্বার্থ বহুসংখ্যক রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে একইভাবে প্রযুক্ত হতে পারে। যেমন, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার সঙ্গে বিভিন্ন রাষ্ট্রের স্বার্থ সমানভাবে যুক্ত থাকে।

[6] সুনির্দিষ্ট স্বার্থ: স্থান ও সময়ের মানদণ্ডে সাধারণ জাতীয় স্বার্থের যুক্তিসংগত সম্প্রসারণে নির্ধারিত স্বার্থগুলিকেই সুনির্দিষ্ট জাতীয় স্বার্থ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিকাশশীল দেশগুলির সাধারণ স্বার্থরক্ষার নির্দিষ্ট কোনো প্রচেষ্টাকে এই শ্রেণিভুক্ত বিষয় হিসেবে উল্লেখ করা যায়।

Leave a Comment