জাতীয় স্বার্থের উপাদানসমূহ
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের লেখকদের মতে, জাতীয় স্বার্থ সম্পর্কিত ধারণাটি একমাত্রিক নয়, বহুমাত্রিক। জাতীয় স্বার্থের উপাদানগুলিও তাই। কোনো একটিমাত্র উপাদানের সাহায্যে জাতীয় স্বার্থ তৈরি হয় না। জাতীয় স্বার্থের বহুবিধ উপাদান রয়েছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-
[1] ভৌগোলিক অখণ্ডতা: দেশের প্রতিরক্ষা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতাকে নিয়ে জাতীয় স্বার্থের প্রধান উপাদান গঠিত হয়। অনেকে একে জাতীয় নিরাপত্তা বলে অভিহিত করেছেন। দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নটিও এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে একটি দেশ সমস্ত রকমের বৈদেশিক নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকতে চায়। এই কারণে যে-কোনো মূল্যে নিজের স্বাধীন অস্তিত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা বজায় রাখার বিষয়টিকেই আধুনিক বিশ্বের দেশগুলি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়।
[2] আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সামন্ত্রস্যবিধান: জাতীয় স্বার্থের অন্যতম উপাদান হল আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যবিধান। বিশ্বের ছোটো বড়ো বিভিন্ন রাষ্ট্রকে নিয়ে যে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, তার সঙ্গে মেলবন্ধন করাই হল এর মুখ্য উদ্দেশ্য। বর্তমান বিশ্বে কোনো দেশ, সে ছোটো-বড়ো যাই হোক না কেন, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার বাইরে বিচ্ছিন্ন হয়ে টিকে থাকতে পারে না। তাই জাতীয় স্বার্থের বিষয়টিকে সামনে রেখে বিদেশনীতি অনুসরণের মাধ্যমে বিভিন্ন রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করতে চায়।
[3] অর্থনৈতিক উন্নয়ন: অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়টিকে জাতীয় স্বার্থের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে মনে করা হয়। বর্তমানে বিশ্বায়নের যুগে জাতীয় স্বার্থের উপাদান হিসেবে অর্থনীতির ক্ষেত্রটি নতুন মাত্রা লাভ করেছে। প্রতিযোগিতানির্ভর বিশ্ববাণিজ্যে নিজের স্থান অন্ধ্রয় রাখা, বহির্বাণিজ্যের বাজারে প্রবেশাধিকার অর্জন করা, অবাধ বাণিজ্য ও বিদেশি পুঁজি লগ্নির সুযোগ গ্রহণ করা ইত্যাদি বিষয়ে ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে সব রাষ্ট্রের বিপুল আগ্রহ লক্ষ করা যায়।
[4] সাংস্কৃতিক বিনিময়: জাতীয় স্বার্থের উপাদান হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের একটি ভূমিকা রয়েছে। বর্তমান যুগে কূটনীতি, অর্থনীতি ও প্রতিরক্ষার পরে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিশ্বায়নের নয়া ব্যবস্থায় তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতির ফলে এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের বিষয়টি আরও সহজতর হয়েছে। বিদেশের মাটিতে যেলা, উৎসব, প্রদর্শনী, আলোচনাচক্র ইত্যাদি অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের পথ প্রশস্ত করা হয়। সাংস্কৃতিক বিনিময়ের সাহায্যে এক দেশ অন্য দেশের কাছে তার সংস্কৃতির প্রচারের মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে মজবুত করে জাতীয় স্বার্থের লক্ষ্য পূরণ করতে চায়।
[5] আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ: আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটি দেশ বিভিন্ন ধরনের আন্তর্জাতিক সংগঠনে কতখানি সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারছে তার ওপর সেই দেশের জাতীয় স্বার্থপূরণের বিষয়টি। অনেকাংশে নির্ভরশীল। এই কারণে আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের বিষয়টিকে জাতীয় স্বার্থের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে মনে করা হয়। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ ছাড়াও বিভিন্ন অঞ্চলে বর্তমান বিশ্বে যেসব আঞ্চলিক সংগঠন গড়ে উঠেছে, সেখানে জাতীয় স্বার্থপূরণের বিষয়টি একটি ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। উদাহরণ হিসেবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, আসিয়ান, সার্ক, ওপেক, আফ্রিকান ঐক্য সংস্থা প্রভৃতির কথা উল্লেখ করা যায়।
[ 6] বিশ্বজনমত: আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের অন্যতম উপাদান হিসেবে বিশ্বজনমতের কথা উল্লেখ করা হয়। আন্তর্জাতিক সংকটের।
মোকাবিলায় বিভিন্ন রাষ্ট্র বিশ্বজনমত গঠনের মাধ্যমে নিজেদের জাতীয় স্বার্থপূরণের লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দুই মহাশক্তিধর রাষ্ট্রই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে এই ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে দেখা গেছে। সাম্প্রতিককালে সন্ত্রাসবাদ কবলিত বিশ্বে বিভিন্ন রাষ্ট্র নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে বিশ্বজনমত গঠনে প্রয়াসী হয়েছে। এই প্রসঙ্গে, ২০১১ খ্রিস্টাব্দে মুম্বাই বিস্ফোরণের পরে পাক সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের বিরুদ্ধে ভারতের ভূমিকার কথা উল্লেখ করা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মতো বৃহৎ শক্তিগুলির কাছে। ভারত বারে বারে পাক মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদের স্বরূপ তুলে ধরতে চেয়েছে।
পরিশেষে বলা যায়, জাতীয় স্বার্থের উপাদানগুলিকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ছোটো-বড়ো সব রাষ্ট্র বিশেষ গুরুত্ব দিলেও কখন কোন্ উপাদানকে প্রাধান্য দেওয়া হবে তা অনেকটাই আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভা করে। তবে একথা সুস্পষ্টভাবে বলা যায় যে জাতীয় স্বার্থের উপাদান একমুখ নয়, বহুমুখী। তাই এক্ষেত্রে একটিমাত্র উপাদানের ভূমিকা যথেষ্ট নয়।
জাতীয় স্বার্থরক্ষার পদ্ধতিসমূহ
জাতীয় স্বার্থরক্ষার কতকগুলি বিশেষ পদ্ধতি রয়েছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—
[1] পররাষ্ট্রনীতি: ফ্র্যাঙ্কেলের মতে, জাতীয় স্বার্থের ধারণা পররাষ্ট্রনীতির একটি প্রধান বিবেচ্য বিষয়। পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে একটি মৌলিক নির্ধারক হল জাতীয় স্বার্থ। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোনো রাষ্ট্র নিঃস্বার্থভাবে অপর কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে না। মূলত জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতেই রাষ্ট্রগুলি আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধান সম্পর্কে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে।
[2] প্রচার: প্রচারের সাহায্যে একটি দেশ তার জাতীয় স্বার্থসমন্বিত পররাষ্ট্রনীতির অনুকূলে অন্যান্য দেশের মতামত গড়ে তোলে। পররাষ্ট্রনীতি রূপায়ণের একটি শক্তিশালী মাধ্যম হল রাজনৈতিক প্রচার। প্রচারের মাধ্যমে একটি রাষ্ট্র তার গৃহীত নীতিকে বহির্বিশ্বের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে চায়।
[ 3] জোটগঠন: আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থরক্ষার অন্যতম একটি। উপায় বা পদ্ধতি হল জোটগঠন। মূলত, জাতীয় স্বার্থপূরণের উদ্দেশ্যে। রাষ্ট্রগুলি জোটগঠন করে থাকে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলির জোট ন্যাটো (NATO) এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিকে নিয়ে গঠিত ওয়ারশ (Warsaw) জোটের কথা উল্লেখ করা যায়।
[4] অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও ঋণ: অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও ঋণ প্রদানের মাধ্যমে ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রগুলি তাদের জাতীয় স্বার্থপূরণের লক্ষ্যে কাজ করে। প্রধান আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থরক্ষার কৌশল হিসেবে উন্নত দেশগুলি উন্নয়নশীল দেশগুলিকে অর্থনৈতিক সাহায্য ও ঋণ প্রদান করে থাকে। এভাবে উন্নত দেশগুলি আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিভিন্ন বিষয়ে ঋণগ্রহীতা উন্নয়নশীল দেশগুলির সমর্থন অতি সহজেই অর্জন করতে সক্ষম হয়।
[5] বলপ্রয়োগ: আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শক্তিধর ও অতিবৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্রগুলি অনেক সময় নিজেদের জাতীয় স্বার্থপূরণে অন্যান্য রাষ্ট্রের ওপর বলপ্রয়োগ বা বলপ্রয়োগের ভীতি প্রদর্শন করে থাকে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, অতীতে নিকারাগুয়া, অ্যাঙ্গোলা, গ্রেনাডার ওপর এবং সম্প্রতি ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে ইরাকের ওপর মার্কিনি আগ্রাসনের কথা বলা যায়।