জাতীয় শিক্ষানীতি, ১৯৮৬ সম্পর্কে মতামত
মানবসম্পদ উন্নয়নের বহুবিধ প্রক্রিয়ার সমন্বয় ঘটেছে এই শিক্ষানীতিতে। এই শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিটি ক্ষেত্রে উন্নয়ন ও সংস্কারের জন্য কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে সেই সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা করা হয়েছে। তবে একবিংশ শতকের প্রেক্ষাপটে নতুন শিক্ষানীতির মৌলিক অংশ হবে সে চেষ্টায় শিক্ষা লাভের নিরবচ্ছিন্ন জীবনধর্মী প্রয়াস। জীবনের মানোন্নয়ন এমন ধারায় হওয়া প্রয়োজন যেন পরবর্তী বংশধররা শারীরিক, মানসিক, আর্থিক ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সুস্থতা নিয়ে স্বয়ম্ভর ও সম্পদশালী হতে পারে।
স্বাধীনতার পরে ভারত সরকার শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন ও সংস্কারের জন্য বহু কমিশন (রাধাকৃষ্ণন কমিশন, মুদালিয়ার কমিশন, কোঠারি কমিশন) ও কমিটি (১৯৬৮ খ্রি., ১৯৭৯ খ্রি.-এর শিক্ষা কমিটি) গঠন করেছে। এদের সুপারিশের ভিত্তিতে শিক্ষা ক্ষেত্রে অনেক সংস্কারও হয়েছে। যেমন, কোঠারি কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সুপারিশ হল— শিক্ষায় সমসুযোগ, জাতীয় সংহতি, সামাজিক ন্যায়বিচার, মূল্যবোধ ইত্যাদি। এই নীতিগুলির উপর ভিত্তি করেই NPE-1986-তেও সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, শিশু শিক্ষা, নারী শিক্ষা, বয়স্ক শিক্ষা, ভাষা শিক্ষা, শিক্ষার মাধ্যম ইত্যাদি বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
আবার নতুন কতগুলো সুপারিশ রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল— অপারেশন ব্ল্যাকবোর্ড কর্মসূচি (প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নের জন্য), মাধ্যমিক স্তরের মান উন্নয়নের জন্য নবোদয় বিদ্যালয়ের পরিকল্পনা, চাকরি থেকে ডিগ্রি বিযুক্তিকরণ, স্বশাসিত কলেজ, শিক্ষক, স্কুলের জোট সংগঠন ইত্যাদি।
মতামত : নতুন শিক্ষানীতির সর্বাধিক তাৎপর্যপূর্ণ দিক হল এই নীতি একদিকে যেমন যথেষ্ট রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে তেমনি নীতিগত বিষয় কয়েকটি প্রয়াসে বিরুদ্ধে প্রতিবাদও উঠেছে। যে বিষয় গুলোকে কেন্দ্র করে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়েছিল সেগুলো নিম্নরূপ —
(১) মডেল স্কুলে অঢেল অর্থব্যয় : সমগ্র মাধ্যমিক স্তরকে অবহেলা করে বৈষম্যমূলক মডেল স্কুলের (পরবর্তী নবোদয় বিদ্যালয়) জন্য কেন্দ্রের অঢেল অর্থ ব্যয়।
(২) বহিঃপরীক্ষার মূল্য হাস : অভ্যন্তরীণ মূল্যায়নের উপর গুরুত্ব দিয়ে বহিঃপরীক্ষার মান হ্রাস।
(৩) ডিগ্রিকে চাকুরি থেকে বিচ্ছিন্নকরণ : ডিগ্রির সঙ্গে চাকুরির সম্পর্ক ছেদ করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মূল্যায়ন ব্যবস্থার গুরুত্ব হ্রাস।
(৪) স্বায়ত্তশাসন বৈষম্য : বিশেষ বিশেষ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দিয়ে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি।
(৫) ভাষাগত বৈষম্য : হিন্দি ও ইংরেজির উপর মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে ভারতীয় অন্যান্য ভাষাকে অবহেলার ইঙ্গিত প্রদান।
(৬) নিরক্ষরতাকে বাঁচিয়ে রাখা : নিরক্ষরতা সৃষ্টির উৎসমুখ রুদ্ধ না করে নিরক্ষরতা বাঁচিয়ে রাখার ইঙ্গিত প্রদান।
(৭) অবৈতনিক শিক্ষা : এই শিক্ষানীতির একটি উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্ত হল ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ১১ বছরের ছেলে মেয়েদের, যাদের পাঁচ বছরের শিক্ষাকাল শেষ হয়েছে তাদের এবং ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ১৪ বছরের সব ছেলেমেয়ে আবশ্যিক ও অবৈতনিক শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। যদিও এটিকে কার্যকরী করার জন্য যে প্রচুর অর্থ প্রয়ােজন, সে ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি।
(৮) বৃত্তি শিক্ষা : NPE-1986-তে বলা হয়েছে, ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দের ২৫% শিক্ষার্থীদের বৃত্তি শিক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। এই উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য প্রতিটি প্রদেশে অনেকগুলি সরকারি ও বেসরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। তবে যতটা প্রত্যাশিত ছিল ততটা হয়নি, হলে ততদিনে ৫০% শিক্ষার্থী কারিগরি শিক্ষায় পারদর্শী হয়ে উঠত।
(৯) খেলাধুলা : দেহমনের পরিপূর্ণ বিকাশ প্রসঙ্গে আধুনিক খেলাধুলার সঙ্গে দেশজ খেলাধুলার অন্তর্ভুক্তি এবং যোগ শিক্ষা (Yoga Education) উপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান নতুন শিক্ষানীতির একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ বলে গণ্য করা যায়। যােগের মৌলিক জ্ঞান ভারতেই উদ্ভূত— এটি ভারতীয় ঐতিহ্য। জাতীয় শিক্ষানীতি (১৯৮৬)- তে বলা হয়েছে “Efforts will be made to introduce Yoga in all schools; to this end, it will be introduced in ‘Teacher Training courses.” সুতরাং, আগামী নাগরিকদের জন্য এটি একটি সুনির্দিষ্ট ও অত্যাবশ্যক পদক্ষেপ।
(১০) বিদ্যালয়গুচ্ছ : শিক্ষার মানউন্নয়নের উল্লেখযোগ্য উপায় হিসেবে বিদ্যালয় গুচ্ছ এর কার্যকারিতা স্বীকৃত। বিদ্যালয় গুচ্ছ বা School Complex বিষয়ক ধারণা শিক্ষা কমিশন (১৯৬৪-৬৬ খ্রি.) প্রতিবেদনে প্রথম গুরুত্ব দিয়ে সুপারিশ করা হয়। দু-একটি রাজ্যে বিষয়টিকে পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করে ভালো ফল পাওয়া গেছে। তাই ১৯৮৬-এর জাতীয় শিক্ষানীতিতে বিদ্যালয় গুচ্ছের উপর গুরুত্ব দিয়ে দেশব্যাপী তার সম্প্রসারণের কথা বলা হয়েছে।
(১১) কেন্দ্রীয় পাঠক্রম : এই শিক্ষানীতিতে সারা দেশের জন্য একটি সাধারণ কেন্দ্রীয় পাঠক্রম রচনা করার কথা বলা হয়েছিল, যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এর ফলে শিক্ষায় সমতা আসবে। শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ১০+২+৩ কাঠামো বজায় রাখার কথা বলা হয়েছিল, যা এখনও বর্তমান।
(১২) অপারেশন ব্লাকবোর্ড ও পথনির্দেশক বিদ্যালয় : প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য ‘অপারেশন ব্ল্যাকবোর্ড’ কর্মসূচি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ কর্মসূচি। দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য ‘পথনির্দেশক বিদ্যালয়’ বা ‘নবোদয় বিদ্যালয়’ কর্মসূচি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। প্রধানত মাধ্যমিক শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য এই কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।
(১৩) মডেল স্কুল : জাতীয় শিক্ষানীতির অন্যতম একটি বিতর্কিত বিষয় হল মডেল স্কুল। মডেল শব্দটি প্রথম বিতর্কের সৃষ্টি করে। কারণ শিক্ষা ক্ষেত্রে কোন নীতি শেষ কথা বলতে পারে না— পরিবর্তনশীল সমাজ ব্যবস্থায় শিক্ষা সর্বদা পরীক্ষা নিরীক্ষা নির্ভর। তাই সেখানে আদর্শ বা মডেল বলে কিছু হতে পারে না। তাই সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় শিক্ষানীতিতে নবোদয় বিদ্যালয়’ নামটি ব্যবহার করা হয়েছে।
(১৪) উন্নত প্রযুক্তি : এই শিক্ষানীতির আর-একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল শিক্ষাক্ষেত্রে আধুনিক উন্নতমানের প্রযুক্তির ব্যবহার।
তবে সব কিছু ভালাের মধ্যেও কিছু ত্রুটি আছে। যেমন— Dropout শিক্ষার্থীদের সমস্যার সমাধান সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। কলেজ পরিচালনার ব্যাপারে যে সততা ও শৃঙ্খলার প্রয়োজন, তার অভাব রয়েছে। নবোদয় বিদ্যালয় গুলো ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য গড়ে উঠেছে। তাই অনেকে এটিকে গােড়াকাটা বৃক্ষের সঙ্গে তুলনা করেছেন। NPE-1986-এর ভালাে দিকগুলি আলােচনা করলে দেখা যায়, এই শিক্ষানীতি ভারতের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ শিক্ষার নির্ভরযোগ্য দলিল।