সূচনা : ভৌগলিক আবিষ্কারের সুবাদে ভারতবর্ষে প্রথম দিকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাণিজ্য করতে এলেও পরবর্তীকালে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ভারতবর্ষ হয়ে ওঠে ব্রিটিশের সবথেকে রোভনীয় উপনিবেশ। আসলে এখানকার অপরিমিত সম্পদ ঐশ্বর্যের মহাবিশ্ব হয়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এখানে উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল।
ঔপনিবেশিক ভারতে জাতি বিতর্ক
১. গোড়ার কথা
(১) গ্রাম : ভারতবর্ষ তার সূচনা কাল থেকে সর্ব বর্ণ-ধর্ম সম্প্রদায় নিয়ে গঠিত এক দেশ। প্রাক ব্রিটিশ ভারতের গ্রামে কৃষক ছাড়া ছুতোর, কুমোর, মুচি, ধোপা, তেলি, নাপিত এবং অন্যান্য কারিগররা বাস করত। গ্রামীণ সমাজের মধ্যে নিম্ন শ্রেণীর অস্তিত্ব ছিল। সামাজিক বিচারে অন্তজ্য শ্রেণীর অধিকাংশই ছিল অধিবাসী জনগোষ্ঠীর বংশধর। প্রাগ ব্রিটিশ ভারতের গান গুলির অধিবাসীরা জাত ব্যবস্থাকে দৈবা দুষ্ট হিসেবে গণ্য করতো। যার প্রথার সমস্ত ধরনের আচার ও বিধি নিষেধ তারা মুখ বুঝে মেনে নিত।
(২) শহর : প্রাক ব্রিটিশ ভারতের শহরগুলিতে বিভিন্ন পেশার মানুষ বাস করত। শাসক শ্রেণী, প্রশাসন গোষ্ঠী, শিল্পী ও কারিগরি শ্রেণি, উৎপাদক, ব্যবসায়ী, শিক্ষাবিদ প্রভৃতি নানা ধরনের মানুষ শহরবাসী ছিল। নাগরিক সমাজের কারিগর ও শিল্পীদের কেমন মর্যাদা ছিল না। কারিগর শ্রেণীর মধ্যে পড়তো হিন্দু ও মুসলিম তাঁতি, মুচি, তেলি, কামার, স্বর্ণকার প্রভৃতি মানুষেরা।
২. ব্রিটিশদের জাতিগর্ব
অষ্টাদশ শতকের শেষ পর্ব থেকে কোম্পানি মারফত বাংলা এবং মাদ্রাজের ইংরেজদের রাজনৈতিক ক্ষমতা কায়েম হয়। এক সময় থেকে ইংরেজরা নিজেদের দেশ ও জাতি নিয়ে প্রকাশ্যে গর্ববোধ করতে শুরু করেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা নিজেদের জাতিগত গর্ভের কথা তুলে ধরার উদ্দেশ্যে প্রচার করতে যে, ব্রিটিশ জাতি সাম্রাজ্যের সূর্য কখনো অস্তমিত হয় না। ভারত ব্রিটিশ আইন সচিব লর্ড মেকলে এই সভ্যতাকে সরাসরি দুর্নীতি অপবিত্র ও নির্বুদ্ধতা বলে অবহিত করেন।
কুসংস্কার মুক্ত মন নিয়ে এবং যুক্তিবাদের আলোকে স্নাতক হয়ে ইংরেজরা নিজেদেরকে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ আধুনিক সভ্য জাতি হিসেবে ঘোষণা করে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী অহমিকা প্রাচ্যের জ্ঞান, বিজ্ঞান, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্যের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। প্রাচ্য ক্রমাগত নিজস্ব হতে থাকে। ভারতের মতো উপনিবেশ প্রাচীন আরবি, ফরাসি ও সংস্কৃত শিক্ষার অস্তিত্ব ব্রিটিশ জাতির আঘাতে লুপ্ত হতে শুরু করে।
৩. ভারতীয়দের সম্পর্কে ব্রিটিশদের মনোভাব
ভারত শাসনকালে ব্রিটিশরা নিজেদেরকে আধুনিক সভ্য জাতি হিসেবে দাবি করত। শাসিত ভারতীয়রা ছিল শাসক ব্রিটিশদের কাছে কালো চামড়ার মানুষ। শাসক ব্রিটিশ প্রতিটি ক্ষেত্রে এই বর্ণবিদ্বষ প্রস্তুতি জাতিভেদ কে কাজে লাগিয়ে নিজেদের উপনিবেশিক শাসন কে দীর্ঘস্থায়ী করতে চেয়েছিল। শাসক ইংরেজ জাতিগত দিক থেকে ভারতীয়দের অপেক্ষায় শ্রেষ্ঠ বলে মনে করতো। ভারতীয়দের প্রতি তাদের আচরণ ছিল ঔদ্ধত্যপূর্ণ।
প্রতিদিনকার জীবনযাত্রায় ভারতীয়দের প্রতি তাদের সদায় তীব্র ঘৃণা এবং অবজ্ঞা প্রকাশিত হতো। শাসন ইংরেজদের কাছে শাসিত ভারতীয়রা ছিল ভিন্ন ও দুর্নীতিগ্রস্ত এবং অর্ধ বর্বর। চার্লস গ্রান্ট তাই লিখেছেন, “ভারতীয়রা হল একটি ঘৃণিত ও সোজনীয় ভাবে অর্ধপতিত এক জাতি।” উপনিবেশিক ভারতের কোন কোন ইউরোপীয় ক্লাবের নোটিশ ঝুলিয়ে দেওয়া হত যে, “কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ’ ।
ঔপনিবেশিক ভারতের জাতির বিতর্কগত প্রভাব
১. সরকারি ক্ষেত্রে
ভারত শাসনকালে শাসক ব্রিটিশ শাসিত ভারতীয়দের কাছে নিজেদেরকে প্রভুর জাত হিসেবে তুলে ধরতো। এবার সঙ্গে বড়োলাট এলগিন রোজ বেরিকে লেখেন – “আমরা প্রভুর জাত, শুধু এই ভাব কায়েম রেখেই আমরা শাসন করতে পারি। চাকরিতে যদিও ভারতীয়দের উৎসাহ দেওয়া উচিত, কিন্তু আমাদের যদি এখানেই থাকতে হয়, তাহলে একটি সীমা অবধি নিয়ন্ত্রণ ভার অবশ্যই আমাদের হাতে রাখতে হবে।
(১) শাসন ব্যবস্থায় : ভারতের ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থায় সামরিক ও প্রশাসনিক স্তরের উচ্চপদগুলিতে শিক্ষিত ভারতীয়দের নিয়োগ না করার প্রথা চালু ছিল। ইংল্যান্ডের পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে ভারতীয় পরীক্ষার্থীদের এক যোগ পরীক্ষা নিতে হবে ভারতীয়দের এই দাবি দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে উপেক্ষিত থাকে। কোন কারণ ছাড়াই পদস্থ ভারতীয়দের প্রকাশ্যে লাঞ্ছনা বা অপমান করা হতো। শাসন বিভাগের প্রতিটি স্তরে জাতি বিদ্বেষ কথা খোলাখুলি প্রচার করত। বর্ণ শ্রেষ্ঠ তে কর্তৃক পাঞ্জাবের লেফটেন্যান্ট গর্ভনরকে লেখা এক চিঠি থেকে -“আপনার অধীনস্থ কর্মচারীদের এই শিক্ষা দেবেন যে আমরা সবাই ব্রিটিশ ভদ্রলোক এবং একটি নিকৃষ্টতর জাতিকে শাসন করার মতো মহৎ কাজে আমরা সবাই নিযুক্ত”।
(২) বিচার ব্যবস্থা : কালো চামড়ার ভারতীয়দের বিচারে জন্য এদেশের আলাদাভাবে শ্বেতাঙ্গ প্রধান আদালত গড়ে তোলা হয়েছিল। আসলে উপনিবেশিক ভারতের শ্বেতাঙ্গ প্রধান আদালত গুলি কে ব্রিটিশ নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করত অন্যায়কারী শ্বেতাঙ্গরা নামমাত্র জরিমানার বিনিময়ে মুক্তি পেত। ইংরেজ মনি ভারতীয় চাকরকে বা চা বাগানের সাহেব তার কলি বা কর্মচারীকে অন্যায় ভাবে হত্যা করে না মাত্র জরিমানায় মুক্তি পেয়েছে, এরকম প্রচুর নিদর্শন আছে। উল্লেখ্য আগ্রআয় ফুলার নামে এক ইংরেজ তার সহিসকে অন্যায় ভাবে হত্যা করে এবং ৩০ টাকা জরিমানা দিয়ে মুক্তি পায়।।
২. আর্থিক ক্ষেত্র
আর্থিক ক্ষেত্রে ব্রিটিশের জাতিবিদ্বেষ ছিল অত্যন্ত তীব্র। ব্যবসা বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতায় সবসময় শ্বেতাঙ্গরা ভারতীয়দের তুলনায় অধিক সুযোগ-সুবিধা পেত। ইউরোপীয় বণিক এবং ব্যবসায়ীরা নিজেদের মধ্যে ঐক্য বজায় রেখে চলতে এবং নিজেদের মধ্যে আপস ও পারস্পরিক বোঝাপড়া অটুট রেখে ব্যবসা-বাণিজ্য চালাতো। শ্বেতাঙ্গরা নিজেদের আর্থিক সুরক্ষার জন্য নানা বণিক সভা, ব্যবসায়ী সমিতি এবং সংগঠন গড়ে তোলে। এক্ষেত্রে ইংরেজির একটানায় উদ্দেশ্য ছিল, তা হল শাসিত ভারতীয়দের আর্থিক দিক থেকে আরও দুর্বল করে দেওয়া। এ প্রসঙ্গে কার্জন বরাকরের ব্রিটিশ খনি মালিকদের এক সবাই বলেন, “আমরা কাজ প্রশাসন নিয়ে আর আপনাদের শোষণ নিয়ে ; দুই-ই কিন্তু একই প্রশ্ন ও বিতর্ক কর্তব্যের দুটি দিক।”
৩. সামাজিক ক্ষেত্রে
(১) সংরক্ষণ : রেলের প্রতীক্ষালয়, পার্ক, ক্লাব, স্টিমার, হোটেলে সর্বত্র ইউরোপীয়দের জন্য আসন সংরক্ষিত থাকতো। কোন ইউরোপী যাত্রী থাকলে টিকেট কাটা সত্বেও কোন ভারতীয় যাত্রী রেলের সেই কামরায় ওঠার অধিকার পেত না।
(২) অপমান : সাধারণ ভারতীয় নাগরিক এবং স্বনামধন্য ভারতীয় ব্যক্তিত্বরাও ব্রিটিশ এর কাছে পদে পদে অপমানিত হতেন। কিন্তু এই অপমানের কোন বিহিত করা যেত না। ইংরেজ অফিসারদের সামনে দিয়ে কোন ভারতীয় ঘোড়া, হাতি বা পালকি চড়ে যেতে পারতেন না। রাজা রামমোহন রায় এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় এর মতো ব্যক্তিরা পর্যন্ত পালকি চলে যাওয়ার অপরাধী বিটিসের কাছে অপমানিত হন। চটি জুতো পড়ার অপরাধে বিদ্যাসাগর মহাশয় কে কলকাতা মিউজিয়ামে ঢুকতে দেওয়া হননি।