রাষ্ট্রপতির জরুরি অবস্থা ঘোষণা-সংক্রান্ত ক্ষমতা
জরুরি অবস্থা বলতে কী বোঝায় সে-সম্বন্ধে ভারতের সংবিধানে কোথাও কিছু বলা হয়নি। সংবিধানের ৩৬৬(১৮) নং ধারায় এই বিষয়ের প্রাসঙ্গিক উল্লেখ করে শুধু বলা হয়েছে, “Proclamation of Emergency means a Proclamation issued under Clause (1) of Article 352″। কে ডি রাও তাঁর Parliamentary Democracy of India শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেন যে, জরুরি অবস্থা হল এমন এক বিপজ্জনক পরিস্থিতি যেখানে দ্রুত ব্যবস্থা * নেওয়া অনিবার্য হয়ে পড়ে। ভারতীয় সংবিধানের অষ্টাদশ অংশে ৩৫২- ২৩৬০ নং ধারার মধ্যে রাষ্ট্রপতিকে তিন শ্রেণির জরুরি অবস্থা ঘোষণার এই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সেগুলি হল- [1] জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা,
[2] রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা-সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা ঘোষণা,
[3]আর্থিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা,
[1] জাতীয় জরুরি অবস্থা: সংবিধানের ৩৫২ নং ধারায় রাষ্ট্রপতিকে জাতীয় জরুরি জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের ৪২ এবং ৪৪তম সংশোধনীতে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি যদি এই মর্মে নিশ্চিত বা সন্তুষ্ট হন যে যুদ্ধ, বহিরাক্রমণ বা দেশের মধ্যে সশস্ত্র বিদ্রোহের ফলে সমগ্র ভারত বা ভারতের কোনো অংশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে বা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, তাহলে তিনি সমগ্র ভারত বা ভারতের কোনো অংশে জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন। তবে একমাত্র কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার লিখিত সুপারিশ ছাড়া রাষ্ট্রপতি এই ধরনের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন না। ৪৪তম সংবিধান সংশোধনী অনুযায়ী, বর্তমানে জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা সম্পর্কে রাষ্ট্রপতির সন্তুষ্টি নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যায়। জরুরি অবস্থা ঘোষণার একমাসের মধ্যে সংসদের কাছে তা অনুমোদনের জন্য পেশ করতে হয়। জাতীয় জরুরি অবস্থার অনুমোদন- সম্পর্কিত বিধিব্যবস্থার বিষয়ে সংবিধানে বলা হয়েছে যে, পার্লামেন্টের উভয়কক্ষে জরুরি অবস্থার ঘোষণাকে মোট সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠের এবং উপস্থিত ও ভোটদানকারী সদস্যের দুই-তৃতীয়াংশের দ্বারা সমর্থিত হতে হবে [৩৫২(৬) নং ধারা]। ভারতে এযাবৎ মোট তিনবার জাতীয় জরুরি অবস্থা জারি করা হয়।
প্রতিক্রিয়া: জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণার ফলে দেশের সাংবিধানিক ব্যবস্থায় পবতীয় জরুরি সেবাশা ঘোষণার
i. সংসদ রাজ্য-তালিকাভুক্ত যে-কোনো বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে পারে।
ii. লোকসভার কার্যকাল আরও একবছর বাড়ানো যায়।
iii. প্রশাসনিক কাজকর্ম পরিচালনার ব্যাপারে কেন্দ্র রাজ্যগুলিকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে পারে। রাজ্যগুলি এসব নির্দেশ মানতে বাধ্য থাকে।
iv. রাজস্ব বণ্টন-সংক্রান্ত বিধিব্যবস্থাও রাষ্ট্রপতির নির্দেশ অনুযায়ী পরিবর্তন করা যেতে পারে।
v. মৌলিক অধিকারের মধ্যে ১৯(১) নং ধারায় উল্লিখিত স্বাধীনতার অধিকারকে স্থগিত রাখা এবং ৩২ ও ২২৬ নং ধারা অনুযায়ী শাসনতান্ত্রিক প্রতিবিধানের জন্য আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার অধিকারকে বাতিল করা যায়। তবে বর্তমানে সংবিধানের ৪৪তম সংশোধনী অনুযায়ী ২০ এবং ২১ নং ধারায় উল্লেখিত জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকারকে জাতীয় জরুরি অবস্থার সময় কোনোভাবেই ক্ষুষ্ণ করা যায় না।
[2] রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা-সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা: সংবিধানের ৩৫৬ নং ধারা অনুসারে, কোনো অঙ্গরাজ্যের রাজ্যপালের রিপোর্টের ভিত্তিতে বা অন্য কোনোভাবে রাষ্ট্রপতি যদি এই মর্মে নিশ্চিত বা সন্তুষ্ট হন যে, সেই রাজ্যের প্রশাসন সংবিধান অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে না, তাহলে তিনি শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা ঘোষণা করতে পারেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বর্তমানে ৪৪তম সংবিধান সংশোধনী অনুসারে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা ঘোষণার ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির সন্তুষ্টি নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যায়। কোনো রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা ঘোষিত হলে আট সপ্তাহের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ঘোষণাটিকে সংসদের উভয়কক্ষে অনুমোদন লাভ করতে হয়। নচেৎ ঘোষণাটি বাতিল বলে গণ্য হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৯৪ সালের বোম্বাই মামলার রায় অনুযায়ী ৩৫৬ নং ধারার প্রয়োগ-সংক্রান্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ আট সপ্তাহের মধ্যে সংসদের উভয়কক্ষে অনুমোদিত না হওয়া পর্যন্ত রাজ্য বিধানসভা ভেঙে দেওয়া যাবে না। সংবিধানের ৩৫৬ নং ধারা এযাবৎ বিভিন্ন রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে শতাধিকবার প্রয়োগ করা হয়েছে।
প্রতিক্রিয়া: কোনো রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা বা রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করা হলে রাজ্যের প্রশাসনিক ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে স্থানান্তরিত হয়। রাষ্ট্রপতি রাজ্য আইনসভার যাবতীয় ক্ষমতা কেন্দ্রীয় আইনসভা (সংসদ) বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিতে পারেন। তিনি রাজ্য বিধানসভা ভেঙে দিতে বা স্থগিত রাখতেও পারেন।
[3] আর্থিক জরুরি অবস্থা: সংবিধানের ৩৬০ নং ধারায় রাষ্ট্রপতিকে আর্থিক জরুরি অবস্থা ঘোষণার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রপতি যদি এই মর্মে নিশ্চিত হন যে, সমগ্র ভারত বা ভারতের কোনো অংশের আর্থিক স্থায়িত্ব বা সুনাম ক্ষুগ্ধ হয়েছে, তাহলে তিনি এই ঘোষণা করতে পারেন। এখানেও রাষ্ট্রপতির সন্তুষ্টি চূড়ান্ত বলে বিবেচিত নয়। আর্থিক জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত ঘোষণাটিকে আট সপ্তাহের মধ্যে সংসদের উভয়কক্ষের অনুমোদন লাভ করতে হয়।
প্রতিক্রিয়া: আর্থিক জরুরি অবস্থা ঘোষিত হলে রাজ্যগুলির যাবতীয় আর্থিক বিষয়ে কেন্দ্রের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। আর্থিক ব্যাপারে কেন্দ্রের নির্দেশ রাজ্যগুলিকে মেনে চলতে হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এখনও পর্যন্ত ভারতে আর্থিক জরুরি অবস্থা একবারও ঘোষিত হয়নি।
উপসংহার: তত্ত্বগতভাবে জরুরি অবস্থা ঘোষণা সংক্রান্ত যাবতীয় ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে থাকলেও বাস্তবে কিন্তু প্রধানমন্ত্রীসহ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা এ ব্যাপারে প্রস্তুত ক্ষমতার অধিকারী। জরুরি অবস্থা ঘোষিত হলে সংবিধানের যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রকৃতি পরিবর্তিত হয়ে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এককেন্দ্রিক চেহারা নেয়। রাজ্যগুলির স্বাতন্ত্র্য বিনষ্ট হয়। নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ক্ষয় হয়। জরুরি অবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতার এই অপব্যবহার রোধ করার জন্যই সংবিধান সংশোধন করা হয় (৪৪তম)। তার ফলে বর্তমানে সংসদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অনুমতি ছাড়া কোনোক্রমেই জরুরি অবস্থা দীর্ঘদিন জারি করে রাখা যায় না। এই ব্যবস্থাকে একটি গণতান্ত্রিক রক্ষাকবচ বলে অনেকে মনে করেন।