সূচনা: আধুনিক বস্তুনিষ্ঠ ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রতত্ব পূর্ণতা পায় ব্রিটিশ রাষ্ট্রচিন্তাবিদ জন লকের রচনাগুলির মধ্যে। তিনি ছিলেন উদারনীতিবাদের জন্মদাতা তথা সার্থক প্রবত্তা।
জন লকের রাষ্ট্রচিন্তা
[1] রাষ্ট্রীদর্শ: সমকালীন ইংল্যান্ডের সমাজজীবনের প্রেক্ষিতেই গড়ে উঠেছিল লকের রাষ্ট্রদর্শন। লকের রাষ্ট্রাদর্শের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বিষয় ছিল—অভিজ্ঞতাবাদ, প্রকৃতির রাজ্য, প্রাকৃতিক আইন ও প্রাকৃতিক অধিকার, সামাজিক চুক্তি, সম্পত্তি তত্ত্ব প্রভৃতি৷
[2] রচনাসমূহ: ‘টু ট্রিটিজেস্ অফ গভর্নমেন্ট (1690 খ্রি.)। প্রন্থে লক রাষ্ট্র ভাবনার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর লেখা অন্যান্য কয়েকটি গ্রন্থ হল—‘কনসার্নিং হিউম্যান আন্ডারস্ট্যান্ডিং, ‘হিস লেটারস্ অন টলারেন্স প্রভৃতি।
[3] গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বের ব্যাখ্যা
- সামাজিক চুক্তি: জন লক বলেছেন প্রকৃতির রাজ্যে প্রতিটি ব্যক্তি প্রত্যেকের সঙ্গে চুক্তি করে এই রাষ্ট্রসমাজ গড়ে তুলেছে। এই চুক্তির উদ্দেশ্য হল জীবন, স্বাধীনতা এবং সম্পত্তির অধিকারকে রক্ষা করা।
- ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ: জন লক ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। ক্ষমতার ভিত্তিতে তিনি সরকারকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন যথা—আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ এবং ফেডারেটিভ (Federative) বিভাগ। তিনি মনে করতেন সরকারের এই তিনটি বিভাগকে আলাদা করে দিলে স্বেচ্ছাচারিতার সুযােগ থাকবে না।
- প্রকৃতির রাজ্য: প্রকৃতির রাজ্য প্রাকৃতিক আইন দ্বারা পরিচালিত হওয়ায় প্রত্যেকে সমান অধিকার ও স্বাধীনতা ভােগ করে। লক প্রকৃতির রাজ্যকে এক শান্তির রাজ্য হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যেখানে মানুষ পারস্পরিক সহযােগিতার মধ্যে দিয়ে বাস করত।
- অভিজ্ঞতাবাদ: লক বলেন যে জগৎ সংসারে সমস্ত কিছুকেই অভিজ্ঞতার আলােকে বিচার করা উচিত। লকের ধারণায় জন্মানাের পর প্রথমে মানুষের মন থাকে সাদা কাগজের মতাে, যাতে কোনাে দাগ থাকে না। কিন্তু যতদিন যায় মানুষ অভিজ্ঞতা লাভ করে, যা তার চিন্তা ও জ্ঞানের জগতের প্রসার ঘটায়।
- প্রাকৃতিক আইন ও অধিকার: লক বলেছেন প্রকৃতির রাজ্য পরিচালনা করত প্রাকৃতিক আইন। এই প্রাকৃতিক আইন ছিল বলেই কেউ কারও জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির ওপর হস্তক্ষেপ করতে পারত না। লকের ধারণায় এই প্রাকৃতিক আইন ছিল সর্বজনীন।
- সম্পত্তি তত্ত্ব: লকের ধারণায় সম্পত্তির অধিকারের মধ্যেই রয়েছে মানুষের জীবন ও স্বাধীনতার অধিকার। লক বলেছেন সমস্ত মানুষ প্রকৃতিগতভাবে সমান প্রাকৃতিক সম্পদ ভােগ করার অধিকারী।
সমালােচনা: লকের রাষ্ট্রচিন্তা সমালােচনার উর্বে ছিল না। প্রথমত, লকের বেশ কয়েকটি তত্ত্বে স্ববিরোধিতা লক্ষ করা যায়। লক একদিকে আইনসভা অপরদিকে রাষ্ট্রসমাজকে চরম ক্ষমতার আধার বলে উল্লেখ করছেন। আবার কখনও বা রাজাকে ক্ষমতার বিশেষ অধিকারী হিসেবে বর্ণনা করেছেন। দ্বিতীয়ত, লক শ্রমজীবীদের ওপর মালিকপক্ষের শােষণগত ভুমিকাকে তিনি এড়িয়ে গেছেন। তৃতীয়ত, লক তার রাষ্ট্রচিন্তার মধ্যে যুক্তিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের মধ্যে মিলন ঘটাতে চেয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব নয়।
জন লকের অবদান
[1] প্রাকৃত অধিকার তত্ত্ব: তিনিই প্রথম স্পষ্টভাষায় বলেন জীবন, স্বাধীনতা এবং সম্পত্তির অধিকার হল মানুষের স্বাভাবিক বা প্রাকৃত অধিকার।
[2] ক্ষমতা-পৃথকীকরণ তত্ত্ব: লকই প্রথম স্পষ্টভাবে ক্ষমতা বিভাজন নীতির ব্যাখা দেন।
[3] ঐশ্বরিক অধিকার তত্ত্বের বিরোধিতা: ঐশ্বরিক তত্ত্বের বিরােধিতা করে লক বলেন—রাষ্ট্র হল মানবীয় প্রতিষ্ঠান, কোনাে ঐশ্বরিক প্রতিষ্ঠান নয়।
[4] বিপ্লবের তত্ত্ব: বিপ্লবের তত্ত্বে লক স্বৈরাচারিতার অবসানের ক্ষমতা জনগণের হাতে দেন। তার এই তত্ত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রে অনুসৃত হয়।