সূচনা
বিংশ শতকের শুরুতে চীনে বিদেশীদের আধিপত্য, বিদেশিদের চাপিয়ে দেওয়ার বিভিন্ন অসম চুক্তি, বিদেশি পণ্য প্রভৃতির বিরুদ্ধে দেশপ্রেমিক চিনাদের মনে ক্রমাগত ক্ষোভ জমতে থাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর প্যারিসের শান্তি সম্মেলনে চীনের প্রতি বিদেশী শক্তি গুলির বিভিন্ন অবিচার সেই ক্ষোভ ঘৃতাহুতি দেয়। ফলে যুদ্ধ শেষে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ৪ মে চীন এক বিদ্রোহ শুরু হয় যা ৪ মে-র আন্দোলন বা মে ফোর্থ মুভমেন্ট নামে পরিচিত।
৪ মে-র আন্দোলনের প্রসার
চীনের ৪ মে-র আন্দোলন শুরু হয় ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ৪ মে। এ আন্দোলনে শীঘ্রই চীনের বিভিন্ন অংশ ছড়িয়ে পড়ে। মোটামুটি ভাবে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত এই আন্দোলন চলেছিল। এ আন্দোলনের অগ্রগতি সম্পর্কে নীচে আলোচনা করা হলো।
১. আন্দোলনের সূচনা
চীনের পিকিং বিদ্যালয়ের অধ্যাপক চেন-তু-শিউ ছিলেন ৪ মে আন্দোলনের অন্যতম নেতা। দাঁড়া আহবানে চীনের হাজার হাজার দেশপ্রেমিক ছাত্র ও ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ৪ মে পিকিং এর ‘তিয়েন-আন-মেন স্কোয়ার’-এ সমবেত হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। তারা চিনে থেকে বিদেশী শক্তিদের অপসারণ, সমস্ত অসম চুক্তি বাতিল, দেশ বিদ্রোহের শাস্তি প্রভৃতি দাবি করে এবং জাপানি পণ্য বয়কটের আহ্বান জানান। বেশ কিছু ছাত্রকে পুলিশ গ্রেফতার করলে পিকিং এর ছাত্ররা ধর্মঘটে শামিল হয়।
২. আন্দোলনের অগ্রগতি
চিনা ঐতিহাসিক চাও সে সুং ৪ মে-র আন্দোলনের অগ্রগতিকে দুটি পর্যায় বিভক্ত করেছেন।
(১) প্রথম পর্যায় : আন্দোলন শুরু হওয়ার পর মে ও জুন এই প্রথম দু মাস মূলত চীনের ছাত্ররা এতে অংশ নিয়েছিল। জাপানের পাটরত চীনা ছাত্ররা ও টোকিওর রাজপথে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। তারা প্রচারপত্রে জানায় যে, “চিনা জনগণকে হত্যা করলেও তারা আত্মসমর্পণ করবে না।”
(২) দ্বিতীয় পর্যায় : এই পর্যায়ে ছাত্রদের সঙ্গে চিনে শ্রমিক, কৃষক, মধুর ও বুদ্ধিজীবী চীনের সর্বশ্রেনীর মানুষ আন্দোলনে সামিল হয়। ফলে চীনের বিভিন্ন অংশে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে।
৩. দমন নীতি
চীনের প্রজাতন্ত্রের সরকার প্রথমে দমননীতির দ্বারা আন্দোলন ভেঙে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। ৩ জুন সরকার ৩০০ এর বেশি ছাত্রকে গ্রেফতার করে এবং সব ধরনের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ফলে ছাত্র আন্দোলন দাবানলের মতো চীনের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এবার শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলন সক্রিয় ভাবে জড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন শিল্প কারখানা ও অফিস আদালতে ধর্মঘট শুরু হয়
৪ মে-র আন্দোলনের গুরুত্ব
৪ মে-র আন্দোলন ছিল চীনের সংস্কৃতি নবজাগরণের ফলশ্রুতি। চাও সে-সং মনে করেছেন যে, “কর্মকাণ্ডের ব্যাপকতা ও গভীরতার বিচারে ৪ মে-র আন্দোলন ছিল চীনের ইতিহাসে এক নজরবিহীন ঘটনা।” চীনের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সংস্কৃতি জীবনে এই আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এই ভূমিকা গুলি হল –
১. শ্রমিক শ্রেণীর গুরুত্ব
৪ মে-র আন্দোলনের দ্বারা চীনের শ্রমিক শ্রেণীর গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। এ আন্দোলনে শ্রমিকরা অর্থনৈতিক দ্রাবিদেয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিক সংগ্রামী পথে অগ্রসর হয়। ঐতিহাসিক জাঁ শ্যেনো মনে করেন যে, “চীনের শ্রমিক শ্রেণী এই আন্দোলনের দ্বারা রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্যে প্রবেশ করেছিল।”
২. জাতীয়তাবাদের প্রসার
৪ মে-র আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই তিনি আধুনিকতা, দেশরে মো জাতীয়তা বোধের প্রসার ঘটে। প্রথম পর্বে দেশপ্রেম ও জাতীয়তা বোধের উদ্বুদ্ধ ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীরা ছিল এই আন্দোলনের চালিকাশক্তি। লি তা চাও এই আন্দোলনকে মানবমুক্তি সংগ্রাম বলে অবহিত করে।
৩. সংস্কৃতিক অগ্রগতি
আন্দোলন শুরু হওয়ার পর চীনে বহু বই পত্র ও পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হলে সংস্কৃতি অগ্রগতি ঘটে। চীনের পুরনো কনফুসিয়া মতাদর্শ সমালোচিত হতে থাকে এবং নতুন সংস্কৃতিকে সবাই স্বাগত জানাই। চিনা ঐতিহাসিক হো-কান-চি বলেন যে, “দেশপ্রেমিক ৪ মে-র আন্দোলন নতুন বিপ্লবী ঝড়ের জন্ম দেয় এবং চীনের বিপ্লব কে আগে নতুন স্তরে পৌঁছে দেয়।” ঐতিহাসিক ইমান্যুয়েল সু-র মতে এই আন্দোলনের চীনের সংস্কৃতি জগতে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন আনে।
৪. আন্দোলনের সাফল্য
আন্দোলনের চাপের কাছে চীন সরকার নীতি স্বীকার করলে আন্দোলনে সাফল্য ঘোষিত হয়। আন্দোলনের চাপের সরকার আন্দোলনকারী ধৃত ছাত্রদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। চীনের পক্ষে ভার্সাই সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর না করার কথা সরকার শেষ পর্যন্ত ঘোষণা করে ২৮ জুন ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে।
৫. কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা
৪ মে-র আন্দোলনের ফলে চীনে কুয়োমিনতাং দলের পুর্ণ গঠন হয় এবং কমিউনিস্ট পার্টির উত্থান ঘটে। এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন নেতা ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে চীনে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তীকালে এই পার্টি চিহ্নের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
৬. ব্যাপকতা
চিনে ১৯১১ বিপ্লব ছিল একটি আঞ্চলিক বিপ্লব। কেবল দক্ষিণ চীন এবং সন্নিহিত অঞ্চলের তা সীমাবদ্ধ ছিল না। কিন্তু ৪ মে-র আন্দোলনের প্রভাব ছিল চীনের সর্বত্র এবং এর গণভিত্তিক ছিল ব্যাপক।