চিনে আধুনিক খ্রিস্টান ভাবধারার প্রসারে মিশনারীদের উদ্যোগ সম্পর্কে আলোচনা করো?

চীনের মিশনারিদের উদ্যোগ

চীন প্রাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসার আগে চীনের সমাজ, শিক্ষা ও সংস্কৃতি প্রভৃতি সবকিছুই অন্তর মুখী ও পশ্চাৎপদ হয়ে পড়েছিল। চীন আফিম যুদ্ধে ১৮৩৯-৪২ খ্রিস্টাব্দে বৃটেনের কাছে পরাজিত হওয়ার পর বিদেশী পুঁজিপ্রতিদের কাছে চীনের দরজা খুলে যেতে থাকে। নানকিং চুক্তি ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে, ওয়াংসিয়া চুক্তি ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে, হোয়ামপোয়া চুক্তি ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে, টিয়েনসিন চুক্তি ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে প্রভৃতির মাধ্যমে বিদেশী পুঁজিপতিরা চীনে প্রবেশ করে চীনকে লুন্ঠনের মৃদুগায় ভূমিতে পরিণত করে। বৈদেশিক ক্ষেত্রে চীনের ধারাবাহিক ব্যর্থতার ফলে সচেতন চীনরা উপলব্ধি করতে শুরু করে যে, আধুনিক প্রাশ্চাত্য শিক্ষা ও বিজ্ঞান চর্চা ছাড়া চীনের অগ্রগতি সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের খ্রিস্টান মিশনারীদের চীনে আসতে শুরু করলে সে দেশের বহু স্বাধীনচেতা প্রাশ্চাত্য শিক্ষাকে স্বাগত জানায়।

১. প্রথম পর্বের মিশনারি

খ্রিস্টান মিশনারীদের মধ্যে সর্বপ্রথম চিনে আসেন অ্যাংলো-স্কটিশ রবার্ট মরিসন ১৮৮২-১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে। তিনি চিনে এসে ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে চীনা ভাষা শেখেন এবং এই ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করেন। আমেরিকার খ্রিস্টান মিশনারীদের মধ্যে সর্বপ্রথম চীনে আসেন এলিজা কোলম্যান ব্রিজম্যান ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে। খ্রিস্টান সাহিত্য প্রসারের উদ্দেশ্যে তিনি চীনের মুদ্রণ যন্ত্র স্থাপন করেন। আমেরিকার পিটার পার্কার চিনি এসে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে সেখানকার মানুষের চিকিৎসা উদ্দেশ্যে একটি হসপিটাল প্রতিষ্ঠা করে। চিনি প্রথম আরফিমের যুদ্ধে ১৮৩৯-৪২ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের কাছে পরাজিত হয়ে নানকিং এর সন্ধি ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে স্বাক্ষরের বাধ্য হয়। এর দ্বারা চিন্তার পাঁচটি বন্দর বিদেশীদের বাণিজ্যের জন্য খুলে দিতে বাধ্য হলে এসব স্থানে অবাধে খ্রিস্টান মিশনারীরা এসে তাদের সংগঠন করে তুলতে থাক। টিয়েনসিনের সন্ধির ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দের পর তারা চীনে সর্বোচ্চ ছড়িয়ে পড়ে।

২. প্রাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার

আধুনিক প্রাশ্চাত্য শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে চীনে ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দের সর্বপ্রথম তুং ওয়েন কুয়ান বা বিদেশি ভাষা শিক্ষার কলেজের স্থাপিত হয়। এই কলেজে ইংরেজি, ফরাসি, রুশো ও জার্মানি প্রভৃতি ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে এই কলেজে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬৩। এই ১৬৩ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩৮ জন ইংরেজি, ২৫ জন ফরাসি, ১৫ জন রুশো, দশ জন জার্মান ভাষা শিক্ষা গ্রহণ করে। এখানে গণিত, জ্যোতিষ শাস্ত্র, পদার্থবিজ্ঞান, রাসায়ন, শারীরিক বিদ্যা, আন্তর্জাতিক আই ন প্রভৃতি বিভিন্ন আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ করে। তুং ওয়েন কুয়ান কলেজটি ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে ‘ইম্পিরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়’এর অন্তর্ভুক্ত হয়।

৩. অন্যান্য প্রতিষ্ঠান

তুং ওয়েন কুয়ান কলেজে অনুকরণে ১৮৬৩-৬৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সাংহাই, ক্যান্টন, ফুচাও রবিতে শহরে এরুপ বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। পশ্চিমের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, গণিত, আন্তর্জাতিক আইন প্রভৃতি বিষয় বহু মূল্যবান গ্রন্থ চীনা ভাষায় অনুবাদ করা হয়। এর ফলে ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রাশ্চাত্যের আদর্শ ও ধ্যান ধারণার চীনদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।

৪. মিশনারীদের অন্যান্য প্রয়াস

মিশনারিদের উদ্যোগে চীন বহু বিদ্যালয়, গ্রন্থাগার, জাদুঘর প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়। তাদের উদ্যোগে ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে চীনের সাংহাই শহরে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি বিষয়ক একটি সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়।

৫. কাংইউওয়ে-র উদ্যোগ

অষ্টাদশ শতকের ইউরোপীয় দর্শন ও রাজনৈতিক আদর্শের অনুরাগী কাংইউওয়ে চিনের খ্রিস্টান মিশনারিদের সংস্কৃত কর্মসূচির অন্যতম সহযোগীতে পরিণত হন। তিনি চিনে আগত টি. রিচার্জ, ইয়ং জে. অ্যালেন ও অন্যান্য মিশন নারীদের লেখার দ্বারা প্রভাবিত হন। কিং ইউ ওয়ে এইসব মিশনারিদের সঙ্গে মিলিতভাবে চিনি আধুনিক শিক্ষার প্রসারের কাজে নেমে পড়েন।

৬. মিশনারীগণ

বিদেশি পুঁজিপতিদের সঙ্গে খ্রিস্টান মিশনারীরা ও ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে চীনে প্রবেশ করতে থাকে। চীনে সংস্কার আন্দোলনের প্রয়োজন এর প্রেক্ষাপট খ্রিস্টান বা ধর্মপ্রচারকগণ সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ব্রিটেন ও আমেরিকা থেকে চীনে আগত খ্রিস্টান মিশনারীরা এ বিষয়ে সার্বিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। ব্রিটেনের আলেকজান্ডার উইলিয়ামসন ও টি. রিচার্ড, আমেরিকার ইয়াং জে. অ্যালেন, ও এ. পি. মার্টিন প্রোমো খ্রিস্টান মিশনারী চীনে সংস্কার আন্দোলন এ বিশেষ উদ্যোগ নেন।

উপসংহার

দীর্ঘদিনের প্রয়াসে চিনি আগত মিশনারীরা বিভিন্ন সোসাইটি গড়ে তোলেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল লন্ডন মিশনারি সোসাইটি, আমেরিকান বোর্ড অফ কমিশনার ফর ফরেন মিশনস, আমেরিকান রিফর্মড মিশন, ব্যাপিটিস্ট মিশন প্রভৃতি। মিশনারী তাদের মুদ্রিত বাইবেল, ইতিহাস ও বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ গুলি চীনে ছড়িয়ে দেয়। তারা চিনে বেশ কয়েকটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে এবং রাস্তাতে চিকিৎসা পদ্ধতি চালু করে। চীনের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উচ্চ শিক্ষিত যুবকরা মিশন নারীদের আধুনিক ভাবধারার দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হন।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment