গ্রামীণ এলিট সম্প্রদায় হিসেবে পতিদার ও সাউকার শ্রেণীর পরিচয় দাও?

ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতে দরিদ্র কৃষক ও শ্রেণী সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজেশ্বরে দাবি মেটাতে গিয়ে ধ্বনি মহারাজাদের কাছে থেকে উচ্চ সুদে অর্থ ঋণ নিতে বাধ্য হয়। এর হলে ভারতের গ্রামীণ জীবনে সুদখোর মহাজন শ্রেণীর দ্রুত প্রসার ঘটে। তারা গ্রাম জীবনের এলিট বা উচ্চবিত্ত শ্রেণীর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এসব ঋণদাতা ব্যবসায়ীদের মধ্যে অন্যতম ছিল প্রতিদান, সাউকার এবং অর্থ হল অগ্নিকারী ও মধ্যস্বত্বভোগী সম্প্রদায়।

পতিদার

মোগল সম্রাট এর পতনের পর ভারতের গ্রামীণ শাসন ও রাজস্বব্যবস্থা ভেঙে পড়ে এবং অরাজকতার সৃষ্টি হয়। এরপর উপনিবেশিক ব্রিটিশ শক্তি ভারতে বিভিন্ন স্থানীয় মোড়ল বা আধিপত্যকারী সম্প্রদায়ের যোগসূত্র গড়ে তুলে রাজস্ব আদায় করতে থাকে। এরূপ একটি উল্লেখযোগ্য স্থানীয় মোড়ল বা আধিপত্যকারী সম্প্রদায় ছিল গুজরাটের প্রতিদারার। গুজরাটে গ্রামে যৌথ ভূমির পতি নামে পরিচিত ছিল। এই ভূমি রাজস্ব আদায় কারীগণ পতিদারে নামে পরিচিত ছিল। সাধারণত গুজরাটের কুনবি পতিদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করত। তাদের উপাধি হতো ‘প্যাটেল’ অর্থাৎ গ্রামের প্রধান।

১. কৃষি কাজ

গুজরাটে পতিদাররা আগে কলি নামে একটি যোদ্ধা সম্প্রদায়ের সমগোত্রীয় ছিল। পরবর্তীকালে ব্রিটিশরা ভারতের ভূমি বন্দোবস্তের প্রবর্তন করলে পতিদাররা কৃষি সঙ্গে যুক্ত হয়ে যথেষ্ট উন্নতি ঘটায়। কৃষি কাজের মাধ্যমে তাদের আর্থিক সচ্ছলতা যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। ১৮৬০ এর দশকের পর থেকে সঠিক ফসলের উৎপাদন, উন্নত কৃষি কৌশল শস্য রপ্তানি ব্যবস্থার উন্নতির মাধ্যমে পতিদার সম্প্রদায় যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটায়। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে ভারতের আদমশুমারি পতিদার সম্প্রদায় একটি পৃথক সত্তা হিসেবে চিহ্নিত হয়।

২. রাজস্ব আদায়

দাক্ষিণাত্যের মুম্বাই প্রেসিডেন্সিতে ব্রিটিশ সরকার প্রবর্তিত রায়তওয়ারী ভূমি ব্যবসায়ী প্রত্যেক কৃষকদের ওপরে পৃথকভাবে রাজস্ব ধার্য করা হতো। পতিদাররা রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব ছিল। তারা গ্রামের আদর্শ আদায় করে তা সরকারের কোষাগারে জমা দিত। এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে তারা গুজরাটে গ্রামীণ সমাজের শীঘ্রই এলিয়েট গোষ্ঠী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। গুজরাটের বাইরে প্রতিবেশী মহারাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রদেশের কিছু কিছু অঞ্চলে ও পতিদাররা রাজস্ব আদাই করত।

৩. শোষণ

উপনিবেশিক আমলে ভারতের ভূমি রাজস্বের হার যথেষ্ট বেশি ছিল। এই বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় করতে গিয়ে পতিদাররা গুজরাটে দরিদ্র কৃষকদের ওপর তীব্র শোষণ পীড়ন চালাত। তারা কৃষকদের কাছ থেকে বিভিন্ন উপায়ে বাড়তি অর্থ আদায় করে তা আত্মসাৎ করত। কৃষকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত বিপুল পরিমাণে সুদের অর্থ ও তারা ভোগ করতো। এভাবে তারা বিপুল পরিমাণ অর্থ সম্পদের মালিক হয়ে উঠেছিল। পতিদারদের না না বিয়ের শোষণের ফলে গুজরাটে কৃষকের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে যায়।

৪. গ্রামীণ সমাজে ভাঙ্গন

গুজরাটের প্রতিদারার শীঘ্রই বিপুল পরিমাণে অর্থ সম্পদের মালিক হয়ে উঠলে তারা সাধারণ দরিদ্র কৃষক থেকে পৃথক সত্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ফলে পতিদাররা তাদের মূল গ্রামীণ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং সমাজে ভাঙ্গন দেখা দেয়। পতিদাররা কংগ্রেসের একনিষ্ঠ সমর্থক কে পরিণত হলে পতিদার-বিরোধীর ‘স্বতন্ত্র পার্টি’র সমর্থকের পরিণত হয়। অবশ্য পরবর্তীকালে গান্ধীজী নেতৃত্বে উভয় সম্প্রদায় এই জাতীয় আন্দোলনকে শক্তিশালী করেছিল।

সাউকার

দাক্ষিণাত্যের মুম্বাই প্রেসিডেন্সিতে গ্রামের প্যাটেল বা মোড়ল রাজ রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব পালন করত। সরকার কর্তৃক দলিত কৃষকের ওপর চাপিয়ে দেওয়া বিপুল পরিমাণ রাজস্ব এবং মোড়লদের অতিরিক্ত অর্থের দাবি কৃষকরা মেটাতে সক্ষম ছিল না। ফলে সরকার ও প্যাটেলদের যৌথ শোষণের জর্জরিত কৃষকরা মহাজনের কাছ থেকে উৎস শুধু অর্থ ঋণ নিতে বাধ্য হয়। এই সুদখোর মহাজন শ্রেণী দাক্ষিণাত্য স‌ঊকার নামে পরিচিত।

১. সাউকারদের প্রসার

দাক্ষিণাত্য কৃষকদের ঋণ গ্রহণের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সেখানে সুদখোর সাউকারদের মহাজনিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। দাক্ষিণাত্য প্রতিটি স‌উকারের কোন না কোন শহরের ঋণ প্রদানের জন্য গদি বা অফিস ছিল। ঋণের বিনিময় কৃষকদের জমি দলিলপত্র সাউকারদের কাছে বন্ধক থাকতো। এভাবে কৃষকদের জীবন জীবিকার ওপর সাউকারদের আধিপত্য বৃদ্ধি পায়।

২. শোষণ

সাউকাররা কৃষকদের নগদ টাকা, বীজ ধান, খাদ্য শস্য প্রভৃতি ঋণ দিত। এই দিনে সুদের হাত ছিল ৩৫ থেকে ৭ শতাংশ এবং তা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তো। এই ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে দরিদ্র কৃষকরা স‌উকারদের কাছে চিরদিনের মতো ঋণের জালে আবদ্ধ হয়ে পড়তো। ঋণের জালে আবদ্ধ কৃষকদের জমি জমা সাউকাররা কেড়ে নিলে কৃষকরা জমি থেকে উৎখাত করে সর্বশ্রান্ত হতো।

৩. দাক্ষিণাত্য বিদ্রোহ

১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে দাক্ষিণাত্য কৃষি পণ্যের মূল্য হ্রাস, পরবর্তী কয়েকটি বছর ধরে অজন্মা প্রভৃতির ফলে কৃষকরা খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই অবস্থায় কৃষকদের সরকারের রাজস্ব এবং সাউকারদের ঋণ এর অর্থ পরিষদে ব্যর্থ হলে সাউকার আদালতে সহায়তা কৃষকদের জমি ও বাড়ি দখল করে নিতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে কৃষকরা সাউকারদের বিরুদ্ধে ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে পুনা জেলার কারদে গ্রামে বিদ্রোহ শুরু করে। পরের বছর এই বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারণ করে। এই বিদ্রোহ ‘সাউকার-বিরোধী দাঙ্গা’ বা ‘দাক্ষিণাত্য বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত। অবশ্য পুলিশ ও সেনাবাহিনী তীব্র দমন নীতির ফলে শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়।

অর্থ লগ্নকারি ও মধ্যস্বত্বভোগী

ভারতের সুপ্রাচীন কাল থেকেই সুদূরের কারবারের প্রথা প্রচলিত ছিল। মহাজন ও মধ্যস্তত্বভোগীদের মাধ্যমিক উনিশ শতকের ভারতের গ্রামীণ সমাজের এই কারবার যথেষ্ট সু প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সময় বণিক, ধনী কৃষক, জোতদার, জমিদার প্রমুখ ভারতে গ্রামীণ সমাজের মহাজনি কারবারে সঙ্গে যুক্ত ছিল। এরা দরিদ্র কৃষকদের কৃষি উৎপাদন, খোরাকি, উৎসব অনুষ্ঠান প্রভৃতি প্রয়োজনে নগদ অর্থ বা শস্য ঋণ দিত।

১. বিভিন্ন মহাজনি সম্প্রদায়

মহাজন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জোট বেঁধে বসবাস করত। উত্তর প্রদেশ ও পাঞ্জাবের ক্ষত্রী, গুজরাটে বানিয়া, রাজস্থানে মাড়োয়ারি, তামিলনাড়ুতে চেটিয়ার, বাংলার সাহা ও বণিক প্রভৃতি সম্প্রদায় মহাজনিক কারবারের সঙ্গে যুক্ত ছিল।

২. পরিসংখ্যানের অভাব

বিভিন্ন সূত্র থেকে মহাজনি কারবারের কথা জানা যায়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মহাজন এর কারবার চলত খুব গোপনে, লিখিত নদীপত্র না রেখেই একান্ত মৌখিকভাবে। ফলে মহাজন্দ সঠিক সংখ্যা এবং তাদের নিয়োজিত মূলধনের পরিমাণ প্রভৃতি বিষয়ক কোন নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না।

৩. সুদের হার

ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মহাজনরা গ্রামীণ কৃষকদের কাছ থেকে ৫০ শতাংশ থেকে ৩০০ শতাংশ পর্যন্ত সুদের হার আদায় করতো।

উপসংহার

পতিদার , সাউকার এবং অর্থ লগ্নিকারী ও মধ্যস্বত্বভোগী সম্প্রদায় ব্রিটিশ সরকারের অনুগত ও সহায়ক শ্রেণী হিসেবে কাজ করলে এই সম্প্রদায়গুলির উপর ভিত্তি করে ব্রিটিশ সরকার সেখানকার গ্রামীণ সমাজে নিজেদের ভিত্তি সুদৃঢ় করতে সক্ষম হয়। তবে তাদের বিরুদ্ধে কৃষকদের ক্ষোভ, বিশেষ করে সাউকারদের বিরুদ্ধে দাক্ষিণাত্য বিদ্রোহ তাদের একাধিকপত্যের মৃত্যু ঘন্টা বাজিয়ে দেয়।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment