‘গুরু’ নাটকের পঞ্চক চরিত্রটির মধ্যে কতখানি প্রথা বিরােধিতা ধরা পড়েছে তা আলােচনা করাে
অচলায়তনের প্রথা ও শাস্ত্রনির্দেশিত পটভূমিতে নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুক্ত জীবনবােধের প্রতীক হয়েই গুরু নাটকে পঞ্চকের আগমন। আলােচ্য নাটকে তার যে যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়, তার মধ্যে প্রথা বিরােধিতা হল অন্যতম।
গুরুর আবাহনি সংগীত গেয়েই এই নাটকে পঞ্চকের আবির্ভাব, সে গানে রয়েছে মুক্তির বাসনা। অচলায়তনের সব পুথিপত্র ফেলে দিয়ে গুরুর জন্য অপেক্ষা করেছে পঞ্চক। অচলায়তনে গান নিষিদ্ধ, তাই বিদ্রোহের হাতিয়ার হিসেবে গানকেই বেছে নেয় পঞ্চক। “অচলায়তনে এবার মন্ত্র ঘুচে গান আরম্ভ হবে। এই বােবা পাথরগুলাে থেকে সুর বেরােবে।” -এই ঘােষণাতেই ফুটে ওঠে সংস্কারে বদ্ধ আয়তনে আঘাত করার প্রত্যয় ও অঙ্গীকার। মহাময়ূরী দেবীর বিরুদ্ধতা করতেও তাই তাকে দ্বিধাহীন দেখা যায়। অচলায়তন ভাঙার সময় পঞ্চকের সঙ্গী হয় যূনকরাই। নাটকের শেষে দেখা যায়, সুভদ্রকে সঙ্গী করে পঞ্চকই দায়িত্ব নিয়েছিল অচলায়তনের জানলাগুলাে খুলে দেওয়ার। রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাটকে কিভাবে পঞ্চকের মধ্য দিয়ে আমাদের প্রথাবিরােধীমুক্ত মানুষ হওয়ার কথা বলেছেন।
‘গুরু’ নাটকে পঞ্চক কীভাবে যুক্তিবাদী মনােভাবের পরিচয় দিয়েছে?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘গুরু’ নাটকে পঞ্চক চরিত্রটির মধ্য দিয়ে একটি আদর্শ প্রচার, করেছেন, যেখানে ছাত্ররা হবে যুক্তিবাদী, সংস্কারমুক্ত এবং সহানুভূতিশীল। পঞ্চক তার ব্যক্তিগত জীবনাচরণ দিয়ে সংস্কার আর অন্ধ বিশ্বাসের শাসনে সন্ত্রস্ত বালকদের সামনে নতুন জীবনাদর্শ তুলে ধরতে চেয়েছেন। সে মহাময়ূরী দেবীর পুজোর দিন কাঁসার থালায় ইঁদুরের গর্তের মাটি রেখে তার উপর পাঁচটা শেয়ালকাঁটার পাতা আর তিনটে মাষকলাই সাজিয়ে নিয়ে আঠারাে বার ফুঁ দিয়েছে। এর ফলে সংস্কার মতে, তিনদিনের মধ্যে নিশ্চিত সর্পদংশন ছিল পঞ্চকের বিধিলিপি -আর তাকেই ভ্রান্ত প্রতিপন্ন করেছে পঞ্চক। যদিও এই পঞ্চককেই কিন্তু দেখা গেছে, তাদের পিতামহ বিষ্কস্তীর কাঁকুড়ের মধ্যে জন্মগ্রহণ করার কথা বিশ্বাস করতে। খেসারিডাল খেতে তার আপত্তি না থাকলেও সেই ডালের চাষে কিন্তু তার ঘাের অনীহা। তামা-পিতলের কাজ করতে আপত্তি না থাকলেও লােহা-পেটানাের কাজে ছিল পঞ্চকের তীব্র সংস্কার এবং অনিচ্ছা। ক্ষৌরকর্মের দিন গাল কেটে রক্ত বেরােলে খেয়া নৌকোয় উঠে নদী পেরােতে ছিল ঘােরতর মানসিক বাধা। যদিও, অচলায়তনের প্রথাসর্বস্ব জীবনবিমুখ ব্যবস্থা আর ব্যবস্থাপকদের জন্য ব্যঙ্গ আর বিদ্বেষও উগরে দিতে দ্বিধা বােধ করে না পঞ্চক “প্রায়শ্চিত্ত বিশ-পঁচিশ হাজার রকম আছে চ -আমি যদি এই আয়তনে না আসতুম তাহলে তার বারাে আনাই কেবল পুঁথিতে লেখা থাকত।” এই তীব্র ব্যঙ্গের পাশাপাশি সুভদ্রের অপরাধ নিয়ে উপাধ্যায়ের উৎসাহ প্রসঙ্গে সে বলেছে- “পাপের এতটুকু গন্ধ পেলে একেবারে মাছির মতাে ছােটে।” যুক্তিবাদের উপর নির্ভর করে এভাবেই পঞ্চক একজন সংস্কারমুক্ত মানুষে পরিণত হয়েছে।
গুরু নাটকে পঞ্চকের সহানুভূতিশীলতার পরিচয় দাও
শিক্ষায়তন যখন অচলায়তনে পরিণত হয়, তখনই অনিবার্যভাবে আসে বদ্ধতা। রবীন্দ্রনাথের ‘গুরু’ নাটকে পঞ্চক সমস্ত প্রকার প্রথাকে অতিক্রম করে, প্রাণের আনন্দকে উপভােগ করে আমাদের সকলের প্রিয় চরিত্র হয়ে ওঠে।
পঞ্চক তার বিশ্বাস এবং আদর্শ থেকেই সুভদ্রের উত্তর দিকের জানলা খােলাকে সমর্থন করে। তার কাছে এ হল তিনশাে পঁয়তাল্লিশ বছরের আগল ঘুচিয়ে দেওয়ার প্রথম সাহসী পদক্ষেপ। বালক সুভদ্রের কান্না তাই সে কখনােই সহ্য করতে পারে না বলে জানায়। পরবর্তীকালেও আচার্যকে সঙ্গে নিয়ে সুভদ্রের পাশেই দাঁড়িয়েছে পঞ্চক। যার ফলে তাকেও দর্ভকপাড়ায় নির্বাসিত হতে হয়।
যে পঞ্চকের অচলায়তনে একঘেয়ে জীবন কাটছিল, অন্ত্যজ শূনকদের মধ্যে গিয়ে নেচে ওঠায় বা দৰ্ভকপল্লিতে নির্বাসিত হয়ে তার মধ্যে বেঁচে যাওয়ার সীমাহীন আনন্দ প্রকাশ পায়। একদা অচলায়তন যাকে ‘দুর্লক্ষণ’ বা ‘মূর্তিমান বিঘ্ন’ ইত্যাদি বলে অভিহিত করেছিল, সেই পঞ্চককেই পরিবর্তনের পরে আয়তনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। শুধু উত্তর দিকের নয়, সুভদ্রকে সঙ্গে নিয়ে বদ্ধ আয়তনের সব দিকের জানলা খােলার দায়িত্ব। নেয় পঞ্চক। প্রথা আর প্রাণের দ্বন্দ্বে প্রাণের প্রতিষ্ঠাকেই সম্ভব করে তােলে সে। খেলা ভাঙার খেলায় সে যেমন পারদর্শী তেমনি সমস্যার পাশে দাঁড়িয়ে সহানুভূতিশীল মনােভাবের পরিচয় দিয়েছে পঞ্চক।
‘গুরু’ নাটকের মহাপক চরিত্রটি আলােচনা করাে
রবীন্দ্রনাথের ‘গুরু’ নাটকে শাস্ত্রনির্দেশ, আচারসর্বস্বতা এবং নিয়মতান্ত্রিকতার প্রতিনিধি রূপেই মহাপঞকের অবস্থান।
প্রথানুরাগ ও শাস্ত্রনির্ভরতা: মহাপঞ্চক অচলায়তনের সংস্কারসর্বস্বতা আর মন্ত্রনির্ভরতার মূল ধারক। তাই অচলায়তনে গান তিনি সহ্য করতে পারেন না, পঞ্চকের গান গাওয়াকে তার ‘মতিভ্রম বলেই মনে হয়।
অমিতায়ুর্ধারণী মন্ত্র বা সপ্তকুমারিকা গাথা তার নখদর্পণে। তিনশাে পঁয়তাল্লিশ বছরের বন্ধ আগল সুভদ্র খুলে ফেলায় তার কী শাস্তি হওয়া বিধেয়, তা মহাপঞ্চক ছাড়া আর কেউই বলতে পারে না।
ক্ষমতালিপ্সা: অহংকার ও ক্ষমতার মােহ এই চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আচার্য অদীনপুণ্যের বিরুদ্ধে ফরমান জারি করে তাই তিনি বলেন—“..ওঁকে আচার্য বলে গণ্য করাই চলবে না।” এরপর দেখা যায়, রাজা মন্থরগুপ্ত আচার্যকে সরিয়ে তাকেই নতুন আচার্য হিসেবে নিয়ােগ করেন।
নিঃসঙ্গ পরিণতি: অচলায়তনের প্রাচীর ভেঙে গুরুর আগমন ঘটলে সকলেই গুরুকে মেনে নিলেও, মহাপক তা করেননি। কারণ তার বিশ্বাস ছিল যে, অচলায়তনের প্রাচীর ফুটো করার ক্ষমতাও কারুর নেই, লােহার দরজা ভাঙলে সূর্য-চন্দ্র নিভে যাবে। ইন্দ্রিয়ের সমস্ত দ্বার রুদ্ধ করে নিজেকে আলাে বাতাস থেকে দূরে রেখে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন তিনি। তবে তাঁর যথার্থ মূল্যায়ন ঘটে যুনকদের উদ্দেশে দাদাঠাকুরের মন্তব্যে—“শাস্তি দেবে! ওকে স্পর্শ করতেও পারবে না।” মহাপঞ্কের নিজের বিশ্বাসের প্রতি অটল আস্থাকে দাদাঠাকুরও স্বীকৃতি জানিয়েছেন।