গুপ্তযুগে নগরের অবক্ষয়ের কারণ
প্রাচীন ভারতে নগরায়ণের ঐতিহ্য যথেষ্ট গৌরবােজ্জ্বল হলেও গুপ্তযুগ থেকে ভারতে নগরপুলিতে অবক্ষয় দেখা দেয়। এই সময় নগরের সংখ্যা ক্রমে হ্রাস পেতে থাকে। ইতিহাসবিদ ড. রামশরণ শর্মা, বি. এন. যাদব প্রমুখ এই যুগে নগরায়ণের অবক্ষয়ের বিভিন্ন কারণ ব্যাখ্যা করেছেন一
[1] রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাব: মৌর্য-পরবর্তী যুগে উত্তর ভারতে কুষাণ ও দক্ষিণ ভারতে সাতবাহন সাম্রাজ্যের পতন ঘটার ফলে ভারতীয় ব্যাবসাবাণিজ্য ও নগরগুলি রাজকীয় পৃষ্ঠপােষকতা থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে নগরের অবক্ষয় শুরু হয়।
[2] বাণিজ্যের ক্ষতি: কুষাণ সাম্রাজ্যের পতনের পর পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ভারতীয় অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও ভারতের নগরগুলিতে এর প্রভাব পড়ে।
[3] সামন্ততান্ত্রিক প্রবণতা: খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতক থেকে উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে বৈশ্য ও শূদ্ররা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। বিদ্রোহী অঞ্চল থেকে রাজস্ব আদায় করা কঠিন হয়ে পড়ে ফলে রাজার আয় কমে যায়। ফলে রাজা তার কর্মচারীদের বেতনের পরিবর্তে ভূমিদান করতে থাকেন। এভাবে সামন্ততান্ত্রিক প্রবণতা বৃদ্ধি পায় যা শিল্প, বাণিজ্য ও নগরজীবনের অবক্ষয়ের পথ প্রস্তুত করে দেয়।
বিরুদ্ধ মত: অবশ্য ড. ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ মনে করেন যে, এই যুগে নগরের অবক্ষয় নয়, বরং সমৃদ্ধি ঘটেছিল। তিনি উদাহরণ হিসাবে অহিচ্ছত্র, পেহেয়া, তত্ত্বানন্দপুর, নাভােল, বেলগাঁও প্রভৃতি নগরের বিকাশের কথা বলেছেন।
প্রাচীন ভারতে নগরায়ণের সুফল
প্রাচীন ভারতে নগরায়ণের প্রসার ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছিল। সমাজজীবনে নগরায়ণের অন্যতম সুফলগুলি ছিল-
[1] শিল্প ও বাণিজ্যের বিকাশ: নগরগুলি শিল্পী, কারিগর ও বণিকদের বাসস্থান এবং বাণিজ্যিক পণ্য আদানপ্রদানের কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নগরগুলিতে প্রচুর জনসমাগমের ফলে সস্তায় শ্রমিক পাওয়াও সহজ হয়। ফলে শিল্প ও বাণিজ্যের প্রভূত অগ্রগতি ঘটে।
[2] মিশ্র সংস্কৃতির উদ্ভব: একই নগরে বিভিন্ন বর্ণ, পেশা ও জাতির মানুষ পাশাপাশি বসবাসের ফলে সমাজে মিশ্র সংস্কৃতির বিকাশ ঘটতে থাকে।বহু বিদেশি নাগরিক জীবনে মিশে যায়।
[3] মিশ্র জাতির উদ্ভব: নগরে উচ্চনীচ বিভিন্ন জাতির পাশাপাশি বিশাল সংখ্যক অন্ত্যজ জাতির ও বাস ছিল। ক্রমশ সমাজের এই সমস্ত জাতির মধ্যে সংমিশ্রণ ঘটতে থাকে। এভাবেই ভারতীয় বর্ণপ্রথা ক্রমশ শিথিল হতে থাকে।
[4] পৃথক বর্ণে বিবাহ: শাস্ত্রসম্মত না হলেও এই সময় থেকে নগরপুলিতে পৃথক বর্ণে বিবাহের রীতি প্রচলিত হয়। এভাবে নগরজীবন থেকেই সামাজিক উদারতার বিষয়টি উঠে আসে।
[5] সাংস্কৃতিক প্রগতি: নগরজীবন সমাজের সাংস্কৃতিক অগ্রগতির পক্ষে সহায়ক উপাদান হিসেবে কাজ করে। শিক্ষা, সংস্কৃতি প্রভৃতির অগ্রগতি নগরজীবনের দ্বারাই বেশি সম্প্রসারিত হয়েছিল। নগরগুলিতে উৎসাহী মানুষ জ্ঞানের আলাের সন্ধানে ছুটে আসত।
উপসংহার: প্রাচীনযুগে যখন কোনাে কোনাে নগরের অবক্ষয় শুরু হয় তখন পাশাপাশি অন্যান্য অঞ্চলে নতুন নতুন নগরের প্রতিষ্ঠা হতে দেখা যায়। তাই নগরায়ণের মূল স্রোতটি কখনােই একেবারে থেমে থাকেনি। নগরপ্ুলি বিভিন্ন যুগে ভারতের সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল।