‘গালিলিও’ প্রবন্ধ অবলম্বন করে গালিলিও-র চরিত্রের প্রতিবাদী সত্তার পরিচয় দাও
বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর ‘গালিলিও’ প্রবন্ধ থেকে আমরা জানতে পারি যে, যথার্থ অর্থেই প্রতিবাদী ছিলেন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী গালিলিও।
মাত্র সতেরাে বছর বয়সে পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাক্তারিতে ভরতি হওয়ার পর যুক্তিবাদী গালিলিও অ্যারিস্টটল-এর মতবাদের বিরােধী হয়ে ওঠেন। সহপাঠীদের সঙ্গে, কখনাে কখনাে শিক্ষকদের সঙ্গেও তিনি বাগযুদ্ধে জড়িয়ে পড়তেন। ভেনিসে পাড়ুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন টলেমির বিশ্ব মতবাদের বিরুদ্ধে এবং কোপারনিকাসের মতবাদের সপক্ষে অনেক বক্তৃতাও দেন গালিলিও। এখানেই ১৬০৯ খ্রিস্টাব্দে দূরবিন যন্ত্র আবিষ্কার করে তিনি তার সাহায্যে চাঁদের পাহাড়, ছায়াপথের স্বরূপ, পৃথিবীর একটি উপগ্রহ এবং বৃহস্পতির চারটি উপগ্রহ আবিষ্কার করে ভেনিসের ধর্মভীরু পণ্ডিতদের বিরাগভাজন হন।
১৬১১ খ্রিস্টাব্দে দেশে ফেরার পর গালিলিও ল্যাটিনের পরিবর্তে মাতৃভাষা ইটালিয়ানে লেখালেখি শুরু করেছিলেন। এইসময় কোপারনিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক মতবাদের সপক্ষে বই লিখে তিনি চরম বিরােধিতার মুখে পড়েন। এরপর কার্ডিনাল বেলারিমিনের পরামর্শে তিনি পােপের সামনে কিছুটা সংযত আচরণ করলেও পরবর্তীকালে গতির কথা বা ভাসমান বস্তুর স্থিতিসাম্য, অথবা টলেমি এবং কোপারনিকাসের বিশ্ববিন্যাসের গুণাগুণ সম্পর্কিত আলােচনা মতবাদের আকারে লিখে ফেলা থেকে নিজেকে আটকাতে পারেননি। এই প্রতিবাদী স্বভাবের জন্যই তিনি পােপের রােষানলে পড়েন এবং জীবনের শেষ ন বছর চরম দুঃখে কষ্টে অতিবাহিত করেন।
গ্যালিলিও প্রবন্ধে বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু গালিলিওর আপসকামী মনােভাবের যে পরিচয় দিয়েছেন তা নিজের ভাষায় লেখাে।
প্রখ্যাত বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু তাঁর গ্যালিলিও প্রবন্ধে গালিলিও চরিত্রের মহানুভবতার দিকটিও শুধু নয়, তার আপসকামী দিকটিকেও তুলে ধরেছেন।
সারা জীবনে বেশ কিছু ক্ষেত্রে আপস করতে হয়েছে গালিলিওকে। যেমন, বৃহৎ একান্নবর্তী পরিবারকে ভরণপােষণের জন্য অর্থনৈতিক কারণে কখনােসখনাে আপস করেছেন তিনি। চাকরির জন্য তিনি যেমন উমেদারি পর্যন্ত করেছেন, তেমনি তাস্কানীর ডিউকের পুত্র কর্সমােকে পড়াতে গিয়ে রানিমার মন জোগানাের জন্য জ্যোতিষে অবিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও রাশিচক্র কেটে ভবিষ্যৎগণনাও করেছেন। ১৬১৬ খ্রিস্টাব্দে রােম-নগরীর বিচারসভায় (inquisition) কার্ডিনাল বেলারিমিনের পরামর্শে তিনি ধর্মযাজকদের সঙ্গে যেমন তর্ক করেননি, তেমনি সেখানে তার মতামত ব্যাখ্যা বা প্রমাণ করারও চেষ্টা করেননি। তবুও তাকে সেখানে প্রতিজ্ঞা করতে হয়েছিল যে, তিনি ভবিষ্যতে ধর্মবিরােধী কোনাে মত মুখে আনবেন না। আর ১৬৩৩ খ্রিস্টাব্দের বিচারসভায় অনুতাপব্যঞ্জক সাদা পােশাক পরে হাঁটু গেড়ে বসে তাকে বলতে হয়েছিল যে, কথােপকথনের আকারে রচিত গ্রন্থে তিনি যা লিখেছেন, সে সবই তাঁর বৃথা গর্বের অজ্ঞতা ও অসতর্কতার নিদর্শন। তিনি একথাও বলতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, কোপারনিকাসের বিশ্ব-মতবাদে বিশ্বাস তিনি ত্যাগ করেছেন। তবে একথা আমরা অস্বীকার করতে পারব না যে, ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র স্বার্থসিদ্ধির জন্য কিন্তু গালিলিও কখনও আপস করেননি।
‘গালিলিও’ প্রবন্ধ অবলম্বন করে গালিলিওর জন্মস্থান পিসায় অতিবাহিত হওয়া তার ছেলেবেলার পরিচয় দাও।
সত্যেন্দ্রনাথ বসুর ‘গালিলিও’ প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারি তাস্কানী রাষ্ট্রের পিসা শহরে গালিলিও জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
মাত্র তেরাে বছর বয়সে তিনি সেন্ট বেনেডিকৃটিন ধর্মসম্প্রদায়ের ভ্যালাম-ব্রোসায় অবস্থিত একটি মঠে যান সাহিত্য, ন্যায় ও ধর্মশাস্ত্র পড়ার উদ্দেশ্যে। গালিলিওর দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ বলে বেশি লেখাপড়া তাঁর পক্ষে ক্ষতিকারক—এই যুক্তিতে দুবছর বাদে গালিলিওকে সেখান থেকে ফিরিয়ে আনেন তাঁর পিতা। আসলে তিনি ভেবেছিলেন যে, তার ছেলে সন্ন্যাসী হয়ে গেলে তার অবর্তমানে দারিদ্র-জর্জর পরিবারের দিকে নজর দেবার আর কেউ থাকবে না। তাই, ছােটোবেলা থেকে সংগীত ও চিত্রকলায় আগ্রহী হলেও মাত্র সতেরাে বছর বয়সে, অর্থাৎ ১৫৮১ খ্রিস্টাব্দে, তিনি পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরতি হন ডাক্তারি শাস্ত্র পড়ার জন্য। সেসময় বিশ্ববিদ্যালয়ে যে-কোনাে বিষয়ের ছাত্রকেই দর্শনশাস্ত্র পড়তে হত। অ্যারিস্টটলের কথা ও মতবাদকে সবাই তখন বিনা প্রশ্নে মেনে নিতেন। গালিলিও যেহেতু বিনা তর্কে কোনাে কিছু গ্রহণ করারই পক্ষপাতী ছিলেন না-তাই সহপাঠীদের সঙ্গে, কখনাে কখনাে অধ্যাপকদের সঙ্গেও তার তর্ক বাঁধত। এইসময় তাদের গােটা পরিবার পিসা ছেড়ে ফ্লোরেন্সে চলে এলে মাঝপথে ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দিয়ে গালিলিও পিসা শহর ত্যাগ করেন। এভাবেই জন্মস্থান পিসায় কেটেছিল তাঁর ছেলেবেলা।
“গণিতের অধ্যয়নবাসনাই প্রবল হয়ে উঠল।” -প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলাে কীভাবে গালিলিওর গণিতের অধ্যয়ন- বাসনা প্রবল হয়ে উঠেছিল?
বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর লেখা গালিলিও প্রবন্ধ থেকে আমরা জানতে পারি যে, গালিলিও পিসাতে ডাক্তারি পড়াশােনার সময়ে অ্যারিস্টটলের মতবাদকে কেন্দ্র করে সহপাঠী এবং শিক্ষকদের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। প্রমাণ ছাড়া কোনাে আপ্তবাক্যই তিনি মানতে চাইতেন না।
এইসময়ে গালিলিও গণিতশাস্ত্রে মহাপণ্ডিত এক পারিবারিক বন্ধুর গণিত পাঠদান ঘটনাচক্রে শুনে গণিতের প্রতি উৎসাহী হয়ে ওঠেন। তিনি ডাক্তারি বিদ্যায় ক্রমশ উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। আসলে, একদিন তাকানী রাজসভার সভাপণ্ডিত সেই গণিতবিদের সঙ্গে পারিবারিক প্রয়ােজনে দেখা করতে ফ্লোরেন্সে যান গালিলিও। সেই বিখ্যাত গণিতবিদ তখন তাস্কানী রাষ্ট্রের শাসকের পুত্রকে পড়াচ্ছিলেন। গালিলিও দরজার কাছে দাঁড়িয়ে, আড়াল থেকে দীর্ঘক্ষণ ধরে মনােযােগ দিয়ে সেই গণিত-ব্যাখ্যা শুনেই গণিতের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। এরপর নানাবিধ কারণে এসময়েই তাঁদের গােটা পরিবার পিসা ছেড়ে ফ্লোরেন্সে চলে আসতে হয়। অর্থনৈতিক কারণেই গালিলিওর পিতা তাঁকে পিসাতে রেখে পড়াতে আর সমর্থ হলেন না। ফ্লোরেন্সে এসে গালিলিও সেই ‘সভাপণ্ডিত’ গণিতজ্ঞের কাছেই পদার্থবিদ্যা-সহ গণিতের পাঠ নিতে শুরু করেন এবং অনতিবিলম্বে তিনি এই দুই বিষয়েই প্রভূত খ্যাতির অধিকারী হন এবং নিজের শিক্ষাগুরুকে অতিক্রম করে যান। এভাবেই ভূতপূর্ব ডাক্তারি ছাত্র গালিলিও হয়ে ওঠেন গণিত-বিশারদ।