ক্রুসেডের প্রভাব বা ফলাফল আলােচনা করাে।

ক্রুসেডের প্রভাব বা ফলাফল

সূচনা: মধ্যযুগের ইউরোপের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ। প্রায় দুশাে বছর (১০৯৬- ১২৯১ খ্রি.) ধরে আটটি ধর্মযুদ্ধ হয়। ক্রুসেডের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী।

ক্রুসেডের পরোক্ষ প্রভাব

[১] ক্রুসেডের রাজনৈতিক প্রভাব

  • সামন্ততন্ত্রের অবসান: ইউরােপের বহু সামন্ত বা জমিদার তাদের ভূসম্পত্তি কমিউনের কাছে বিক্রি করে বা বন্ধক রেখে ক্রুসেডে যােগ দেয়। এই সামন্তদের অনেকেই ক্রুসেডে মারা যায়। আর অবশিষ্টরা ফেরেন সর্বস্বান্ত হয়ে। ফলে সামন্ততন্ত্রের অবসানের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।
  • জাতীয় রাষ্ট্রের উত্থান: ইউরােপে সামন্ততন্ত্রের দুর্বলতার সুযােগে শাসনক্ষমতা রাজশক্তির হাত চলে যায়। রাজ্যের শাসনক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ায় জাতীয় রাষ্ট্রের উত্থানের প্রেক্ষাপট রচিত হয়।

[২] ক্রুসেডের অর্থনৈতিক প্রভাব

  • বাণিজ্যের প্রসার: ধর্মযুদ্ধে নতুন নতুন দেশের সঙ্গে যােগাযােগ গড়ে ওঠায় ব্যাবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। চতুর্থ ক্রুসেডে ভেনিস কনস্ট্যান্টিনােপলের দখল নেয়। ফলে সমগ্র ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের ওপর ইউরােপের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ক্রুসেডের সুবাদে সৃষ্ট বাণিজ্য পথ ধরে দামেস্ক, মসল, কায়রাে, আলেকজান্দ্রিয়া-সহ বড়াে প্রাচ্যের শহরগুলির সঙ্গে যােগাযােগ গড়ে ওঠে। এই সমস্ত শহরগুলি থেকে প্রাচ্যের পণ্যসামগ্রী ইটালি হয়ে ইউরােপীয় দেশগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে।
  • শহরের বিকাশ: ক্রুসেডের সময় একদিকে যেমন বহু পুরাতন শহর প্রাণ ফিরে পায় অপরদিকে তেমন বেশ কিছু নতুন শহরও গড়ে ওঠে। ধর্মযুদ্ধ চলাকালীন যে সমস্ত অঞ্চল থেকে ধর্মযােদ্ধাদের প্রয়ােজনীয় জিনিস পাঠানাে হত সেই জায়গাগুলি ক্রমে শিল্পবাণিজ্যের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। বেশ কিছু নতুন শহর গড়ে ওঠে, যেমন ইটালির ভেনিস, জেনােয়া, পিসা, মিলান ইত্যাদি।
  • কুটিরশিল্পের প্রসার: ক্রুসেড শুরু হলে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই কৃষিভিত্তিক অনিশ্চিত জীবিকা ছেড়ে অনেকেই শিল্পভিত্তিক আর্থিক জীবিকা গ্রহণ করে। ক্রুসেডের সুবাদে ইউরােপীয়রা প্রাচ্যের কুটিরশিল্পের সঙ্গে পরিচিত হলে এই কারিগর শ্রেণির প্রচেষ্টায় কুটির শিল্পের প্রসার ঘটে।

[৩] ক্রুসেডের সামাজিক প্রভাব

  • নাইট সংঘের প্রতিষ্ঠা: ক্রুসেডের পরােক্ষ ফল হিসেবে জনকল্যাণমূলক তিনটি নাইট সংঘের প্রতিষ্ঠা ঘটে, যথা— 
  • টেম্পলার: এই নাইট সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করেন পেইনস-এর হ্নগাে নামে এক নাইট।
  • হসপ্রিটালার: এই সংঘের সদস্যরা পরিচিত ছিলেন নাইটস অফ দ্য হসপিটাল অফ সেন্ট জন অফ জেরুজালেম’। সংক্ষেপে হসপ্রিটালারস নামে।
  • টিউটানিক: এই সংঘটির পুরাে নাম হল ‘অর্ডার অব দ্য নাইটস অব দ্য হসপিটাল অব সেন্টমেরি অব দ্য টিউটস ইন জেরুজালেম’ নামে। এর সদস্যরা পরিচিত ছিলেন ‘টিউটানিক নাইট নামে।
  • বণিক ও শ্রমিক শ্রেণির উদ্ভব: একদিকে বাণিজ্য প্রসারের সুযােগে যেমন বণিক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে, অপরদিকে বহু মুক্ত কৃষক ও ভূমিদাস শহরের শিল্পপ্রতিষ্ঠানে যােগ দিলে শ্রমিক শ্রেণির আত্মপ্রকাশ ঘটে।
  • নারীর মর্যাদা বৃদ্ধি: সামন্তপ্রভু, অভিজাতরা ক্রুসেডে যােগ দেওয়ায় তাদের পত্নীরা জমিদারির শাসনভার পরিচালনা করতে শুরু করে। নতুন এই দায়িত্ব পালন করায় নারীর মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।

[৪] ক্রুসেডের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রভাব

  • জ্ঞানের বিকাশ: ক্রুসেডের কারণে হাজার হাজার ইউরােপীয় প্যালেস্টাইনে যায়। ফলে ইউরােপের সঙ্গে ইসলামীয় সভ্যতার যােগাযােগ ঘনিষ্ঠ হয়। দ্বাদশ-ত্রয়ােদশ শতকে পশ্চিম ইউরােপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ইবন সিনা, ইবন রুশদ, আল খােয়ারিজমি প্রমুখ ইসলামীয় পণ্ডিতের রচনা পাঠ্য হয়। ফলে পশ্চিম ইউরােপে ইসলামীয় জ্ঞানচর্চার অগ্রগতি ঘটে।
  • পােপের ক্ষমতা ও প্রভাব বৃদ্ধি: পােপেদের আহ্বানে সাড়া দিয়েই বারেবারে পশ্চিম ইউরােপের সামন্তপ্রভু ও নাইট সম্প্রদায় ক্রুসেডে যােগ দিয়েছিল। তাই কুসেডের পর ইউরােপীয় সমাজে পােপ তথা চার্চের ক্ষমতা ও প্রভাব বৃদ্ধি পায়।
  • পূর্বাঞ্চলীয় চার্চের প্রতিপত্তি হ্রাস: বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের চার্চ বা গ্রিক চার্চ অনেকটাই বাইজানটাইন রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল ছিল৷ ক্রুসেডের যুদ্ধগুলির ফলে বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের অবক্ষয় ত্বরান্বিত হয়। পরিণামে পূর্বাঞ্চলীয় তথা গ্রিক চার্চের প্রতিপত্তিও কমে যায়। পক্ষান্তরে ইউরােপে রােমান চার্চ তথা পােপের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়।

ক্রুসেডের প্রত্যক্ষ প্রভাব

ক্রুসেডের প্রত্যক্ষ প্রভাব হিসেবে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন ও সম্পদহানি ঘটে। দুশাে বছর ধরে চলতে থাকা এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে প্রায় বিশ লক্ষ মানুষ আত্মবলিদান দেন। ব্রিটিশ লেখক উইলসন তাই সমালােচনার সুরে লিখেছেন, “ক্রুসেডগুলি মধ্যযুগের ধর্মান্ধতা এবং নির্বুদ্ধিতার প্রতিফলন ছাড়া আর কিছুই নয়।”

History সব প্রশ্ন উত্তর (একাদশ শ্রেণীর)

Leave a Comment