সূচনা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে জার্মানির আক্রমণের চাপে মিত্রশক্তির দেশ গুলি বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। ভারতীয় জাপানের আক্রমণের প্রবল সম্ভাবনা দেখা দেয়। এই জটিল পরিস্থিতিতে ভারতের ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর আর্থিক ও সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করে। যদিও কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাই, ফলে এক রাজনৈতিক অচলাবস্থা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার সদস্য স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বে ক্রিপস প্রস্তাব নামে পরিচিত। ক্রিপস প্রস্তাব সম্পর্কে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন – “আমাদের সততা প্রমাণের জন্যই ক্রিপস মিশন অপরিহার্য”।
ক্রিপস মিশন
১. পটভূমি
(১) জাপানি আক্রমণ প্রতিরোধ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের সাত ডিসেম্বর জাপান হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে পার্লহারবারে অবস্থিত মার্কিন যুদ্ধ জাহাজ ধ্বংস করে অক্ষশক্তির পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করলে বিশ্ব রাজনীতিতে গুরুতর পরিবর্তন ঘটে। একে একে ফিলিপিসন, ইন্দোচিন, ইন্দোনেশিয়া, মালয় ও ব্রহ্মদেশ বিধ্বস্ত করে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ৮ মার্চ জাপান ভারতের নিকটে এসে হাজির হয়। এই পরিস্থিতিতে জাপানি আক্রমণ মোকাবিলায় ভারতবাসী সক্রিয় সাহায্য লাভের আশায় ব্রিটিশ সরকার বাগ্রহ হয়ে ওঠে
(২) প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দের চাপ : মার্কিন রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট, ব্রিটেনের শ্রমিক দলে নেতা ক্লিমেন্ট এলিট ও অন্যান্য ব্রিটিশ রাজনীতিবিদগণ যুদ্ধে ভারতীয়দের সাহায্য নেওয়ার কথা বলেন। ভারতবাসীকে স্বায়ত্ত শাসন ও স্বাধীনতা প্রদানের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি ঘোষণার জন্য তারা ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে চাপ দেয়। চীনে রাষ্ট্রপতি চিয়াং কাই শেকও ভারতীয়দের স্বাধীনতার দাবি কে সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনার জন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলকে অনুরোধ জানান।
(৩) ভারতের শাসনতান্ত্রিক অচলবস্থা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভারতের ব্রিটিশ বিরোধী গণ বিদ্রোহ শুরু হলে শাসনক্রান্তি অচলাবস্থা দেখা দেয়। অপরদিকে মিত্রপক্ষ ভুক্ত ব্রিটিশ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রণাঙ্গনে তার ঔপনিবেশিক শক্তিকে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিলে ভারতের সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এই লক্ষ্য নিয়েই যুদ্ধকালীন ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার সদস্য, ব্রিটিশ সমাজসেবী ও খ্যাতনামা আইনজ্ঞ স্যার স্ট্রাফোর্ড ক্রিপস তার এক গুচ্ছ প্রস্তাব নিয়ে ভারতে আসেন।
৩. ক্রিপস প্রস্তাব
স্যার স্ট্রাফোর্ড ক্রিপস ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ভারতে বিভিন্ন স্তরে নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এক সপ্তাহ ধরে আলোচনার পর ২৯ মার্চ এক গুচ্ছ প্রস্তাব রাখে, যা ক্রিপস প্রস্তাব নামে পরিচিত। ক্রিপস মিশনের প্রস্তাবগুলি ছিল –
(১) যুদ্ধ শেষ হওয়ার অব্যবাহিত পরে ভারতের এক যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করা হবে।
(২) এই যুক্তরাষ্ট্রকে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্ত শাসনাধিকার ডোমিনিয়ন এর মর্যাদা দান করা হবে।
(৩) যুদ্ধ শেষে ভারতীয় প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত গণপরিষদ রচিত সংবিধান প্রবর্তন করা হবে।
(৪) অবিলম্বে ভারতীয় নেতৃবৃন্দকে বড়লাটের শাসন পরিষদের অংশগ্রহণ আন্তর্জাতিক সম্মেলন গুলিতে প্রতিনিধি হিসেবে যোগদানের সুবিধা দেওয়া হবে।
(৫) সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা জন্য স্বতন্ত্র সংবিধান চালু হবে।
(৬) গণপরিষদ রচিত সংবিধান কোন প্রদেশের পছন্দ না হলে সেই প্রদেশটি ভারতীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে নতুন সংবিধান রচনা করতে পারবে।
(৭) সংবিধান রচিত না হওয়া পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের নিরাপত্তা দায়িত্ব নেবে। বিনিময় তারা ভারতের সম্পদ যুদ্ধের কাজে ব্যবহার করবে।
৩. প্রতিক্রিয়া
ক্রিপস মিশনের প্রস্তাবগুলি ভারতীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। বিভিন্ন দিক থেকে প্রস্তাব গুলির বিরূপ সমালোচনা করে রাজনৈতিক দলগুলি সেগুলির গ্রহণ যোগ্যতাকে নস্যাৎ করে দেয়। হলে ২৯ মার্চ ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ক্রিপস যেমন খসড়া প্রস্তাবগুলি সর্বজন সম্মুখে পেশ করেছিলেন, ঠিক তেমনি ১১ এপ্রিল আর এক সাংবাদিক সম্মেলনে সরাসরি প্রত্যাহার করে নিয়ে লন্ডন যাত্রা করেন। রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে প্রতিক্রিয়া ধরনের হিসেবে বলা যায়-
(১) কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়া : দেশ বিভাগের সম্ভাবনাকে প্রশ্রয় দেওয়ায় ক্রইপস প্রস্তাবে তীব্র বিরোধিতা করে কংগ্রেস তা প্রত্যাখ্যান করে।
(২) মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়া : লীগের প্রতিক্রিয়া ছিল অবশ্য দু’রকমের- সন্তোষজন, আর হতাশাব্যঞ্জক। প্রদেশ গুলিকে ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের যোগ দেওয়া বা না দেওয়ায় স্বাধীনতা দেওয়ায় লিখ খুশি হলেও স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের, অর্থাৎ পাকিস্তান দাবি স্বীকৃত না হওয়ায়, লিগ ক্রিপস প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
(৩) শিখ সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া : ভারতীয় শিখ সম্প্রদায় ও ক্রিপস প্রস্তাব মেনে নিতে পারেনি। তাদের আশঙ্কা ছিল মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঞ্জাব ভারত থেকে আলাদা হয়ে গেলে শিখদের স্বার্থ বিপন্ন হয়ে পড়বে।
(৪) হরিজন সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া : পরিজন সম্প্রদায়ের নেতা আম্বেদকর এই ভেবে অসন্তোষ প্রকাশ করেন যে, ক্রিপস প্রস্তাব কার্যকরী হলে বর্ণহিন্দু সম্প্রদায়ের নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে।
(৫) ইঙ্গ ভারতীয় ও ভারতীয় খ্রিস্টানদের প্রতিক্রিয়া : লিঙ্গ ভারতীয় ও ভারতীয় খ্রিস্টান প্রভৃতি সম্প্রদায় ও এই প্রস্তাবের ফলে ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার অভাব বোধ করে।
এইভাবে ক্রইপস প্রস্তাব সম্পর্কে ভারতীয়দের তীব্র প্রতিক্রিয়া একদিকে যেমন মিশনের ব্যর্থতাকে প্রপাত করে তোলে, অন্যদিকে তেমন ব্রিটিশ কে বুঝিয়ে দেয় যে, এদেশে তাদের দিন ফুরিয়ে এসেছে।
ক্রিপস প্রস্তাবের ব্যর্থতার কারণ
বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সম্প্রদায়ের প্রত্যাখ্যানের ফলে ক্রিপস প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিল। ঐতিহাসিক আর. জে. মুর তার চার্চিল ক্রিপস অ্যান্ড ইন্ডিয়া গ্রন্থে বলেছেন যে, ব্রিটিশ পঞ্চা সভা ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনার জন্য ক্রিপসকে যে ক্ষমতা দিয়েছিল, ক্রিপস তার চেয়ে বেশি প্রতিশ্রুতি দেয়, যার অনেকটাই ছিল ধাপ্পা। ক্রিপস প্রস্তাব ব্যর্থ হওয়ার প্রধান কারণ গুলি ছিল-
১. পূর্ণ স্বাধীনতা দানের অনুল্লেখ
এই প্রস্তাবটিতে পূর্ণ স্বাধীনতা রানের কোন উল্লেখ ছিল না। ব্রিটিশ সরকার বিশেষত চার্চিলের অনিচ্ছুক মনোভাব এই প্রস্তাবকে ব্যর্থ করেছিল। তিনি কখনোই চাননি ভারতে স্বাধীনতা হোক। আসলে এটি ছিল লোক দেখানো কৌশল মাত্র।
২. সংবিধান সভা কেন্দ্রিক সমস্যা
ক্রিপস প্রস্তাব সংবিধান সবাই ভারতীয় প্রতিনিধিদের সরাসরি নির্বাচনের দ্বারা নিয়োগের কথা কিছু বলা হয়নি। এছাড়াও এই প্রস্তাবের সংবিধান সভা কে সর্বভৌম ক্ষমতা না দেওয়ায় হিন্দু ও মহাসভা, লিবারেল পার্টি প্রভৃতি দল ও ক্রিপস প্রস্তাবের কঠোর সমালোচনা করে।
৩. ভারত বিভাজনের ইঙ্গিত
ক্রিপস প্রস্তাবে দেশের রাজ্যগুলি ৯ কোটি মানুষের ভাগ্য দেশীয় রাজ্য বর্গের ইচ্ছা অনিচ্ছার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। যা আসলে প্রচ্ছন্ন ভাবে ভারত বিভাজনেরই ইঙ্গিত দেয়। তাই জাতীয় কংগ্রেস এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে। গান্ধীজী এই প্রস্তাবের সমালোচনা করে বলেন – “এই প্রস্তাবটি ছিল একটি ভেঙে পড়া ব্যাংকের ওপর ফেলে পড়া এক চেক কাটার শামিল”।
৪. সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতার অভাব
ভারতের বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠী গুলির কাছে অর্থাৎ হিন্দু, শিখ, মুসলিম, অনুন্নত সম্প্রদায় কারো কাছে এই প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য ছিল না। তাই এই প্রস্তাব ব্যর্থ হয়েছিল।
ভারতবাসী ক্রিপস প্রস্তাবে যেভাবে বিরোধিতা করেছিল তাতে ব্রিটিশ বুঝেছিল এ দেশে তাদের দিন ফুরিয়ে আসছে। ব্রিটিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞান হ্যারল্ড ল্যাসকি বলেছেন – “এই প্রস্তাব ব্যর্থ হওয়ার জন্য সেই সময়কার ব্রিটিশ রাজনীতি দায়ী ছিল।” ড. বিপানচন্দ্র ও এই মদ সমর্থন করে বলেছেন -“চার্চিল, আমেরি, লিনলিথগো ও ওয়াভেল কেউই চাননিৎযে ক্রিপস সফল হন।
মূল্যায়ন
ক্রিপস প্রস্তাব আসলে ভারতবাসীর কাছে প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়। অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বলেন যে, ক্রিপস এক মুখে দু কথা বলতেন। ভারতে অর্থ ও মানব সম্পর্কে কাজে লাগিয়ে ব্রিটিশ সরকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিজেকে বিজয়ী আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল। যুদ্ধ শেষ হতেই তাই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের মুখোশ খুলে যায়। জওহরলাল নেহেরু এই প্রসঙ্গে বলেন -“যখনই প্রস্তাব গুলি আমি প্রথম করলাম, আমি ভীষণভাবে হতাশা হয়েছিলাম”