কোরিয়া সংকট বা কোরিয়ার যুদ্ধের বর্ণনা দাও?

সূচনা

মাও-সে-তুঙ- এর নেতৃত্বে চীনে প্রজাতন্ত্র গঠিত হওয়ার (১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে অক্টোবর) নামাজ পরে করিয়ান যুদ্ধ শুরু হয় ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে ২৫ জুন। আসলে ১৯৪৫ সালে করিয়ান বাশির অনুমতি ছাড়াই কোরিয়ানকে উত্তর ও দক্ষিণ ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। কোরিয়া সংকট বা কোরিয়া যুদ্ধ ঠান্ডা লড়াই আহ্বানকে আরো তীব্র করে।

কোরিয়া যুদ্ধের বিবরণ

১. সংকটের সূত্রপাত

কোরিয়া ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা পর্যন্ত জাপানের কর্তৃত্বাধীন ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে মার্কিন সেনা ও সোভিয়েত লাল ফৌজ জাপানের হাত থেকে কোরিয়াকে মুক্ত করে। অবশেষে জাপান সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হলে ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে আগস্ট মাসে ৩৮ ডিগ্রি অক্ষরেখা বরাবর কোরিয়ার উত্তরাংশে রাশিয়া ও দক্ষিণাংশে আমেরিকা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাভাবিকভাবে উভয় শক্তি নিজে নিজে এলাকা নিজেদের মতাদর্শ অনুযায়ী সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগী হয়। কিন্তু উত্তর কোরিয়ায় সোভিয়েত সমর্থিত সেনা বাহিনী ৩৮ ডিগ্রি অক্ষরেখা বারংবার এগিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় ঢুকলে করিয়া যুদ্ধ সূচনা ঘটে যা অবসান ঘটে 1953 খ্রিস্টাব্দে ২৭ জুলাই।

২. সমস্যা সমাধানের কমিশনদক্ষিণাঙ্গীর গঠন

ডিসেম্বর মাসে মস্কোয় রাশিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মিলিত হয়ে এক যুগ্ম কমিশন গঠন করে। এই কমিশন কোরিয়ায় অস্থায়ী স্বাধীন সরকার গঠন করবে বলে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু আদর্শগত মতানৈকের কারণ এর যুক্তরাষ্ট্র তখন বিষয়টি রাষ্ট্রসঙ্ঘের উত্থাপন করলে সমস্যা সমাধানের জন্য সাধারণ সভা নয়টি সদস্য রাষ্ট্র নিয়ে একটি অস্থায়ী কমিশন বা UNTCOK গঠন করে সেপ্টেম্বর মাসে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে। এই কমিশনের ওপর কোরিয়ান থেকে বিদেশী সেনা অপসারণ এবং শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব অর্পিত হয়। ভারতীয় কূটনীতিবিদ কে. পি. এস. মেনন এই কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন।

৩. দক্ষিণ কোরিয়ায় সরকার গঠন

রাষ্ট্রসঙ্ঘের অস্থায়ী কমিশনের সদস্যদের রাশিয়া উত্তর কোরিয়ার প্রবেশের অনুমতি দেয়নি। রাষ্ট্রসংঘ তখন নিজে তত্ত্বাবধানে দক্ষিণ কোরিয়া একটি নির্বাচনের আয়োজন নিয়ে করে ১০ মে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছর ১৫ আগস্ট প্রজাতন্ত্রী করিয়া নামে সেখানে মার্কিন প্রভাবিত একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। সিওর হয় এর রাজধানী। ওই সরকারকে রাষ্ট্রসংঘ সমগ্র কোরিয়ার একমাত্র বৈধ সরকার বলে স্বীকৃত জানায় ১২ ডিসেম্বর ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে। পরের বছর এক জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র পদাতান্ত্রিক কোরিয়ান তথা দক্ষিণ কোরিয়াকে স্বাধীন হিসেবে স্বীকৃতি দান করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র সব দিক থেকে কোরিয়াকে সাহায্য করতে থাকে। এভাবে সুদৃঢ় প্রাচ্যে দক্ষিণ কোরিয়া, একটি মার্কিন ঘাঁটিতে পরিণত হয়।

৪. উত্তর কোরিয়ার আগ্রাসন

দক্ষিণ কোরিয়াকে কেন্দ্র করে সদর প্রাচ্যে যখন একটি মার্কিন ঘাটি তৈরি হচ্ছে তখন কোরিয়া সমসাকে আরো জটিল করে তোলেন উত্তর কোরিয়ার কমিউনিস্ট নেতা কিম ইল সুং। সোভিয়েত মদদে তিনি সেখানে গণতান্ত্রিক কোরিয়া নামে একটি সরকার গঠন করে। পানমুনজম হয় এর রাজধানী। এই সরকারের সেনাবাহিনী কোন পূর্বাভাস ছাড়াই হঠাৎ ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে ২৫ জুন ৩৮ ডিগ্রি অক্ষরেখা অতিক্রম করে দক্ষিণে প্রবেশ করলে দুই পক্ষের মধ্যে শুরু হয় প্রত্যক্ষ লড়াই।

৫. চীনের অংশগ্রহণ

নিরাপত্তা পরিষদ উত্তর কোরিয়াকে আক্রমণ কারী বলে চিহ্নিত করে এবং কোরিয়ার রাষ্ট্রসঙ্ঘের সেনাবাহিনী পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়।

৬. চীনের অংশগ্রহণ

রাষ্ট্রসংঘ প্রেরিত বাহিনী প্রধান জে. ম্যাক আর্থার দক্ষিণ কোরিয়া থেকে শত্রুসেনা বিতাড়িত করার পর ৩৮ ডিগ্রি অক্ষরেখা অতিক্রম করে উত্তর কোরিয়ার প্রবেশ করেন। এতে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে পড়ে। কিন্তু এখানে না থেমে মেঘ আর্থারে নেতিতে রাষ্ট্রসঙ্ঘবাহিনী চীন সীমান্তে ইয়ালু নদীর তীরে পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে সেখানে বোমা বর্ষণ করলে চীন তার তীব্র প্রতিবাদ জানায়। এরপরই চীন কোরিয়া যুদ্ধ যোগদান করে এবং অতি দ্রুত দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিওল দখল করে নেয় ৪ জানুয়ারি ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে।

৭. যুদ্ধের অবসান

মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ম্যাক আর্থাকে দরখাস্ত করেন। এরপরই রাশিয়া উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতা ও যুদ্ধ বিরোধী প্রস্তাব দিয়ে যুদ্ধের গতি মন্থর হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে ২৭ জুলাই উত্তর কোরিয়ায় রাজধানী পানমুনজম উভয় পক্ষের যুদ্ধ বিরোধী ঘটে। পূর্বের মতো ৩৮° অক্ষরেখা ধরে দুই কোরিয়ার রাষ্ট্রসীমা নির্ধারিত হয়।

৮. ফলাফল

কোরিয়া যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য আদৌ সফল হয়নি। এই যুদ্ধের ফলে –

(১) বিভাজন শিকার : মাধ্যমে দুই কোরিয়া সংযুক্তি তো দূরের কথা উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার বিভাজনকেই মেনে নিতে হয়।

(২) মানবিক ও আর্থিক ক্ষতি : যুদ্ধে দুই কোরিয়ার‌ই প্রচন্ড ক্ষতি হয়। মার্কিনী, কোরীয়, চীনা সব মিলিয়ে ২৫ লক্ষেরও বেশি মানুষ নিহত হয়। উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

(৩) আমেরিকার সামরিক শক্তি বৃদ্ধি প্রস্তুতি : যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধের সুযোগে চীনকে দুর্বল করতে চাইলেও তা পারেনি। তাই তখন থেকে সে তার সামরিক বাহিনীকে আরও শক্তিশালী করে গড়ে তোলার প্রস্তুতি নেয়।

(৪) ঠান্ডা লড়াইয়ের বিস্তার : এই যুদ্ধের ফলে ঠান্ডা লড়াই এর সমগ্র প্রশান্ত মহাসাগরী অঞ্চল বিস্তার লাভ করে।

৯. গুরুত্ব

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোরিয়ায় যুদ্ধ একাধিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ –

(১) সামরিক জোট তৈরিতে : মার্কিনি যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধের থেকেই ফিলিপিসন, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জাপান, তাইওয়ান পর এক সামরিক জোট প্রতিষ্ঠার উদ্যোগী হয়।

(২) রাষ্ট্রসঙ্ঘের মর্যাদা হ্রাসে : এই দুদুকে কেন্দ্র করে মার্কিন শার্টে রাষ্ট্রসঙ্ঘকে ব্যবহার করা হলে রাষ্ট্রসঙ্ঘের মর্যাদা হ্রাস পায়।

(৩) শান্তি প্রতিষ্ঠায় : এই যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে নভেম্বরের রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ সভার শান্তির জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ায় প্রস্তাব পাস করেছিল। এই যুদ্ধ নিঃসন্দেহে পরমাণবিক অস্তের যুগে ও সীমিত যুদ্ধের ঐতিহ্য রক্ষা করেছিল।

(৪) ঠান্ডা লড়াইয়ের সম্প্রসারণ : এতদিন পর্যন্ত ঠান্ডা লড়াই ইউরোপীয় ভূখণ্ডের সীমাবদ্ধ ছিল। এখন ওই যুদ্ধে সাম্যবাদী চীনের অংশগ্রহণের ফলে তা এশিয়া মহাদেশীয় সম্প্রসারিত হয়।

(৫) সোভিয়েত-চীন মৈত্রী প্রতিষ্ঠায় : এই যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতেই সোভিয়েত ইউনিয়ন বিরোধী মার্কিন পররাষ্ট্র নীতি বৃহত্তর সাম্যবাদ বিরোধী রূপ গ্রহণ করে। এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে সোভিয়েত ও চীন মৈত্রী দৃঢ় হয়।

উপসংহার

কোরিয়ার যুদ্ধ প্রকৃত অর্থে ছিল অনাবশ্য ও নিষ্ফল, কেননা দীর্ঘস্থায়ী এই যুদ্ধের ফল ছিল শূন্য। ঐতিহাসিক ডি. এবং. ফ্লোমিং তার দ্যা কোল্ড ওল্ড ওয়ার এন্ড ইটস অরিজিন গ্রন্থে লিখেছেন – মার্কিন নাগরিকের কাছে কোরিয়ার যুদ্ধের নিট ফল অত্যন্ত নেতিবাচক ছিল।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment