সূচনা
১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে ২৫ জন উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনী ৩৮ ডিগ্রি অক্ষরেখা অতিক্রম করে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রবেশ করে দু পক্ষের মধ্যে প্রত্যক্ষের যুদ্ধ শুরু হয়।
কোরিয়ার যুদ্ধের কারণ
১. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়
১৯১০ খ্রিস্টাব্দে থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা পর্যন্ত কোরিয়ার ওপর জাপানি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু কায়রো সম্মেলনে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে নভেম্বরে এবং পটসডাম সম্মেলনে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে ১৭ জুলাই কোরিয়ান কে স্বাধীন প্রতিষ্ঠিত করার পরিকল্পনা নেয়া হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান পরাজিত হলে এই পরিকল্পনার রূপায়ণের উদ্যোগ শুরু হয়।
২. রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের সম্পূর্ণ রূপে পরাজিত হয়। ফলে জাপানের অধিকৃত কোরিয়ার উত্তরাংশে রাশিয়ার কাছে এবং দক্ষিণাংশের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এ সময় থেকে করিয়া রাত্রি উত্তর অক্ষরেখার উত্তর অংশে রাশিয়া এবং ৩৮ ডিগ্রি উত্তর অক্ষরেখার উত্তর অংশের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে।
৩. অস্থায়ী কমিশনের ব্যর্থতা
কোরিয়ার সমস্যা নিয়ে মস্কতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে ডিসেম্বরে। এই কমিশনে নেতৃত্বে করি আর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে এক অস্থায়ী স্বাধীন সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু এই উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়।
৪. কোরিয়ার দুই সরকার প্রতিষ্ঠা
অস্থায়ী কমিশনের উদ্যোগে ব্যর্থ হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট কোরিয়ার সমস্যা কে জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভায় উত্থাপন করে। সাধারণ সভা তার নয়টি সদস্য রাষ্ট্র নিয়ে একটি অস্থায়ী কমিশন (United Nations Temporary Commission on Korea গঠন করে। এই কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্তি হন বিশিষ্ট ভারতীয় কূটনীতিবিদ কে. পি. এস. মেনন। এই কমিশনের উপর কোরিয়া জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু রাশিয়ার আদিপুঞ্জের সদস্যদের উত্তর কোরিয়ার প্রবেশ করতে দেয়নি।
তাই জাতিপুঞ্জে তথা বাঁধনে দক্ষিণ কোরিয়ায় নির্বাচনের দশমীর ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের মাধ্যমে এক গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। মার্কিন প্রভাবিত এই সরকারের প্রধান হন সিংম্যান রিং ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে ১৫ আগস্ট। ঠিক একই সময় উত্তর কোরিয়াতে ও কমিউনিস্ট নেতা কিম-ইল-সুঙের নেতৃত্বে সোভিয়েত প্রভাবিত একটি সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর রুশা মার্কিন সম্পর্ক তিক্ত হয়ে উঠলে দুই কোরিয়ার মধ্যে যুদ্ধ অবশ্যম্ভামি হয়ে ওঠে।
৫. দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর উত্তর কোরিয়ার আক্রমণ
জাতিপুঞ্জের অস্থায়ী কমিশন এবং নিরাপত্তা পরিষদ উত্তর কোরিয়াকে আক্রমণকারী বলে চিহ্নিত করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিপুঞ্জ দক্ষিণ কোরিয়ার পাশে দাঁড়ালে রাশিয়া ও চীন উত্তর কোরিয়ার পক্ষ নেয়। ফলে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ বাঁধে।
কোরিয়ার সংকট সৃষ্টিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা
« সংকটের অংশগ্রহণ
উত্তর কোরিয়া ছিল রাশিয়ার দখলে। রাশা এখানে তাদের অনুগত একটি কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিল। অপরদিকে দক্ষিণ কোরিয়া ছিল মার্কিনী অধীনস্থ। তাই উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনী দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রবেশ করলে মার্কিন সরকার সাম্যবাদের প্রসার নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে।
মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যান কোরিয়ার যুদ্ধে আমেরিকা কে সর্বতোভাবে জড়িয়ে দেন। উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনীর দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বযুদ্ধে আক্রমণ শুরু করলে আমেরিকা দক্ষিণ কোরিয়াকে সব ধরনের সাহায্য দেওয়া শুরু করে। জাতিপুঞ্জ উত্তর কোরিয়াকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং মার্কিন সেনাপতি ডগলাস ম্যাকআর্থার জাতিপুঞ্জ বাহিনী সেনাপতি করে আমেরিকা করিয়া যুদ্ধে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।
« সংকট সৃষ্টিতে দায়িত্ব
১. রাষ্ট্রপুঞ্জকে প্রত্যক্ষ মদত দান
আমেরিকার প্রত্যক্ষ যোগদানের জন্য করিয়া যুদ্ধ বা করিয়া সং তন্ত্র ও সাম্যবাদের ঠান্ডা লড়াইয়ের আবর্তে রূপান্তরিত হয়। আমেরিকা প্রচ্ছন্ন মদতেই জাতিপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদ উত্তর কোরিয়াকে আক্রমণকারী দেশ রূপে চিহ্নিত করেছিল।
২. সেনা প্রেরণে
মার্কিন রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্রুম্যান দক্ষিণ কোরিয়াকে সব ধরনের সাহায্য করতে প্রতিশ্রুতি দেন ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে ২৫ জুন। এই উদ্দেশ্যে তিনি মার্কিন সেনা নায়ক জেনারেল ম্যাক আর্থার কেন বাহিনী ও বিমান বাহিনী প্রস্তুত রাখার নির্দেশ দেয়। জাতির পঞ্চ সমর্থক থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কোন অসুবিধা হয়নি। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে সেপ্টেম্বর জেনারেল ম্যাক আর্থারের নেতৃত্বে জাতিপুঞ্জ বাহিনী দক্ষিণ কোরিয়ায় শতকরা ৯৫ ভাগ অঞ্চল দখল করে নেয়।
অত্যাধুনিক অস্ত্র ও ট্যাংকে সজ্জিত ৫০ হাজার পদাধিক বাহিনীকে আমেরিকা দক্ষিণ কোরিয়ায় অবতরণ করায়। এই যুদ্ধে ৫০০ টি বিমান ও তিনশো রণতরিকে আমেরিকা কাজে লাগিয়েছিল। রাষ্ট্রসঙ্ঘের সেনাবাহিনীতে শতকরা ৫০ ভাগ মার্কিন সেনা, নৌবাহিনী শতকরা ৮৬ ভাগ এবং বিমান বাহিনীর শতকরা ৯৩ ভাগ ছিল আমেরিকা সেনা। জাতিপুঞ্জের সেনাপ্রধান ম্যাক আর্থারের মতে কোরিয়ার যুদ্ধ ছিল নতুন যুদ্ধ।
৩. যুদ্ধ বিরতিতে
মার্কিনি সেনাপতি আঁধারে নেতৃত্বে জাতিপুঞ্জ বাহিনী সমিতির রক্ষানাত্মাক রণনীতি পরিহার করে আরো আক্রমণাত্মক কর্মসূচি গ্রহণ করে। উত্তর কোরিয়ার কিছু অঞ্চল অধিকার করে জাতিপুঞ্জ শান্তিরক্ষার সেনারা চীন সীমান্তে উপস্থিত হয়। কিন্তু ট্রুম্যান জার্নি যে সেনাবাহিনী আরও অগ্রসর হোক। যুদ্ধ বিরতির ব্যাপারে ট্রুম্যান ম্যাক আর্থারের সংযত করতে না পেরে তাকে সেনা নায়ক দায়িত্ব থেকে আবাহতি দিয়ে যুদ্ধ বিরোধী সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর দীর্ঘ আলাপ আলোচনার পর অবশেষে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে ২৭ জুলাই উত্তর কোরিয়া রাজধানী পানমুনজম উভয় পক্ষের মধ্যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
৪. সীমারেখা স্থিরীকরণে
এই শান্তি চুক্তির দ্বারা ৩৮ ডিগ্রি অক্ষরেখাকে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার সীমারেখা বলে ঘোষণা করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্ররোচনাতে এই যুদ্ধ ত্বরান্বতি হয়েছিল, আবার তারাই প্রচেষ্টায় এই যুদ্ধের বিরতি ঘটেছিল। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে জুন থেকে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জুলাই পর্যন্ত ৫৭৫ টি বৈঠকের পর এই যুদ্ধবিরতি ঘটে। এত দীর্ঘায়িত আলোচনার পরিণতি প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ল্যাংসাম ও মিচেলের মতে দীর্ঘ ৩৭ মাসের যুদ্ধের পর আপাত দৃষ্টিতে কমিউনিজমের প্রসার কে নিয়ন্ত্রণ করা গেল।