সূচনা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী কালে ক্যারিবিয়ান সাগরে অবস্থিত পশ্চিমে ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে সর্ববৃহৎ দীপ কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি নির্মাণকে কেন্দ্র করে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এক স্বল্পকালীন অথচ প্রবল দ্বন্দ্ব শুরু হয়। যার ফলে বিশ্ব এক পরমানবিক যুদ্ধের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। শেষ পর্যন্ত উভয় দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে শুভ বুদ্ধির উদয় হওয়ার বিধ্বংসী যুদ্ধের হাত থেকে বিশ্বরক্ষা পায়।
কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সংকট
১. পটভূমি
কি উপায় ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দের স্পেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার পর উন্নতির লক্ষ্যে মার্কিন মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে। এই সুযোগ নিয়ে মার্কিন পুঁজিপতিরা কিউবার অর্থনীতির মূল ভিত্তি আখের ক্ষেতে ৪০ ভাগ দখল করে নেয়। কিউবার ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমেরিকা তার অনুগামী ফ্যালজেনিকো বাতিস্তা কে ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রপতি পদে বসায়। কিন্তু তিনি মার্কিন পুঁজিবাদের তাবেদারে পরিণত হওয়ায় কিউবা বাসী বাতিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে চলে যায়।
২. ফিদেল কাস্ত্রোর ভূমিকা
বাঁচতে তা সরকারের জন বিরোধী কাজকর্মের প্রতিবাদে কিউবার তৎকালীন ছাত্র নেতা ফিদেল কাস্ত্রো তীব্র সরকার বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলেন। ক্রমশ জন সমর্থন আদায় করে বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের দ্বারা বাতিস্তা সরকারের পতন ঘটিয়ে কাস্ত্রো কিউবার ক্ষমতা দখল করেন ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে ১ জানুয়ারি। কিউবার রাষ্ট্রপতি কাস্ত্রো এরপর পুঁজিবাদী আমেরিকা দিক থেকে সরে এসে রাশিয়া, চিনো অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। এর উদ্দেশ্যে তিনি কিউবায় মার্কিন পুঁজিপ্রতিদের চিনি কলগুলি জাতীয়করণ করেন। তার পাশাপাশি মার্কিন পুঁজিপতি গোষ্ঠীর পরিচালনাধীন ব্যাংক ও অন্যান্য শিল্পকেন্দ্রিক দলীয় জাতীয়করণ করেন।
৩. কাস্ত্রো অপসারণে আমেরিকার ভূমিকা
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র কাস্ত্রো এর কম কার্যকলাপের অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে নানাভাবে কাস্ত্রো সরকারের পতনের পরিকল্পনা নেয়। মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগে গোপন সহায়তা ১,৪০০ ভাড়াটে সৈন্য মার্কিন জাহাজে করে কিউবার ফ্লোরিডা উপকূলের কাছে পিগ উপসাগরের পৌঁছয়। বিদ্রোহীদের সহায়তার জন্য মার্কিন বি-২৬ বিমান প্রস্তুত ছিল। কিন্তু কিউবার সেনাদল তাদের চূড়ান্তভাবে পরাজিত করলে মার্কিন চক্রান্ত ব্যর্থ হয়।
৪. কিউবায় ক্ষেপণাস্ত ঘাঁটি গঠন
কআস্ত্রও সরকার ৫০ লক্ষ কিউবা বাসিকে রোখা জন্য রাশিয়ার সাহায্যে কিউবাতে একটি ক্ষেপণাস্ত ঘাটি গড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে প্রথম দিকে কিউবা রাষ্ট্রপতি ফিদেল কাস্ত্রো রাশিয়া থেকে মাঝারি পার্লার ক্ষেপণাস্ত (IRBM অর্থাৎ Intermediate Range Balistic Missiles) গোপনে আমদানি করে কিউবাতে প্রতিস্থাপন করেছিলেন। এর আগে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত ঘাঁটির সবই ছিল তার দেশের মধ্যেই। তাছাড়া সেগুলি ছিল সীমিত শক্তির। কাজেই বিদেশের মাটিতে এটিই ছিল রাশিয়া প্রথম ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি।
৫. আমেরিকার প্রতিক্রিয়া
১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে আমেরিকা তার গুপ্তচর বিমানের তোলা ছবি থেকে জানতে পারে যে, কিউবার সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা রাশিয়ার একটি ক্ষেপণাস্ত ঘাটি তৈরি করেছে। কিউবা আমেরিকার দক্ষিণ সীমা ফ্লোরিডা থেকে মাত্র ১৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। কাজেই এখান থেকে নিক্ষিপ্ত ক্ষেপণাস্ত যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই, সমস্ত পশ্চিমী গোলার্ধের নিরাপত্তাই ব্যাহত করতে পারে। কিউবার বুকে রাশিয়ার এই প্রথম ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটিটি তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেনেডিকে অস্থির করে তোলে।
৬. কিউবা অবরোধ
কাল বিলম্ব না করে বিচলিত কেনেডি কিউবায় আর কোন ক্ষেপণাস্ত্র যাতে প্রবেশ করতে না পারে সেই জন্য তার চতুর্দিকে নৌ অবরোধের আদেশ দেন। সেই সঙ্গে ২২ অক্টোবর ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে এক বেতার ঘোষণা মারফত বিশ্ববাসীকে এই ব্যবসার কথা জানিয়েও দেন। তিনি আরো ঘোষণা করেন যে কিউবা আগামী সমস্ত জাহাজ এমনকি জাহাজ ও যথাযথ অনুসন্ধানের পরেই কিউবাই ধোকার অনুমতি পাবে। কেনেডি বলেন সমস্ত আক্রমণ নাটক সামরিক সরঞ্জাম এর বিরুদ্ধে কঠোর ভাবে বাধা দেওয়া হবে।
৭. রাশিয়ার প্রত্যুতর
কি উপায় অনুপ্রবেশ সংক্রান্ত মার্কিন রাষ্ট্রপতি কেনেডির ঘোষণায় রাশিয়া মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার দেখা দেয়। সোভিয়েত সরকার তার সেনাবাহিনীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকা নির্দেশ দেয়। সেনা বিভাগের কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয় এবং সবাইকে কাজে যোগ দিতে বলা হয়। এমনকি আসন্ন বিদায় কর্মচারীদের অবসর গ্রহণ সাময়িকভাবে স্থগতি রাখা হয়। সেই সঙ্গে রাশিয়া দৃপ্ত কন্ঠে জানিয়ে দেয় যে কিউবা আগামী কোন সোভিয়েত জাহাজ পথে মধ্যে বাধাপ্রাপ্ত হলে যেন সঙ্গে সঙ্গে গুলি চালানো হয়।
৮. রাষ্ট্রসঙ্ঘের উদ্যোগ
কিউবা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া তিন পক্ষই রাষ্ট্রসঙ্ঘের বিষয়টি উত্থাপন করে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের মহাসচিব উ-থান্ট এবং বিশ্বের জোট নিরপেক্ষ বিভিন্ন রাষ্ট্র দু’পক্ষের আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন কাছেই শান্তিরক্ষার অনুরোধ জানাতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ২৭ অক্টোবর ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে রুশো প্রধানমন্ত্রী ক্রুশ্চেভ মার্কিন রাষ্ট্রপতি কেনেডিকে জানান যে –
(১) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি কিউবা আক্রমণ না করার প্রতিশ্রুতি দেয়;
(২) কিউবা থেকে যদি নৌ অবরোধ প্রত্যাহার করা হয় এবং
(৩) তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্র ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি যদি অপসারণ করা হয় তাহলে রাশিয়া ও কিউবা থেকে সমস্ত সামরিক বাহিনী অপসারণ করবে।
ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের গুরুত্ব
কিউবা ক্ষেপণাস্ত্র সংকট সাময়িক হলে ওয়েটির গুরুত্ব সংকট সাময়িক হলে এটির গুরুত্ব ছিল অসামান্য। এই গুরুত্ব গুলি হল –
১. যুদ্ধোদ্যোগ হ্রাসে
এই সংকটের ফলে শেষ পর্যন্ত মস্কো ও ওয়াশিংটনের তরফে যুদ্ধোদ্যোগ হ্রাস পেতে থাকে।
২. মানবতার জয়ে
কিউবা সংকটে কেন্দ্র করে রুশো মার্কিন উভয় পক্ষই অমানবিক যুদ্ধের ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। ফলে হিংসার বিরুদ্ধে সংযম, শুভ বুদ্ধি ও মানবতা বাদ শেষ পর্যন্ত জয়যুক্ত হয়। ধ্বংসের হাত থেকে পৃথিবীর রক্ষা পায়।
৩. পারস্পরিক আলোচনায়
উভয় শক্তিগুলিকে এরপর থেকে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সমস্যা সমাধানের পথ গ্রহণ করে। উভয়ের মধ্যে সৌর্হার্দ্য পূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠতে শুরু করে।
৪. পরমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা নিরোধ চুক্তিতে
এই সংকটের এক গুরুত্বপূর্ণ পরিণতি হল পরমানবিক অস্ত্র পরীক্ষা নিরোধ চুক্তি স্বাক্ষর। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েদ ইউনিয়ন আমেরিকা ও ফ্রান্সের মধ্যে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়।
৫. হটলাইন স্থাপনে
এই সংকটের পরবর্তী সময় থেকে যেকোনো সংকটে সরাসরি সমাধানের জন্য হোয়াইট হাউস ক্রেমলিনের মধ্যে হটলাইট এর মাধ্যমে টেলি যোগাযোগ স্থাপিত হয়।
৬. কিউবায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা
ভৌগোলিক দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের এত কাছাকাছি একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাস নিঃসন্দে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উল্লেখ্য কিউবায় হল পশ্চিমী গোলার্ধের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র।
৭. রুশো-চীন সম্পর্কের তিক্ততাতে
কিউবা সংকটের এরূপ সমাধানের চিনে সোভিয়েত রাশিয়ার উপর অসন্তুষ্ট হয়। চীনের নেতা মাও-সে-তুঙ বলেন যে, আমেরিকার ভয়ে ভীতি হয়ে রাশিয়া এই চুক্তি সম্পাদন করেছে। তিনি মার্কিন শক্তিকে কাগুজে বাঘ বলে মন্তব্য করেন। এর উত্তরে ক্রুশ্চেভ বলেন যে কাগুজে বাঘের আণবিক দাঁত আছে। এই বাদানুবাদ বাদ এবং রাশিয়া ও চীনের মধ্যে আদর্শগত বিরোধ ২ দেশের সম্পর্কে তিক্ত করে।
উপসংহার
অবশেষে কুড়ি নভেম্বর ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত রাশিয়া কিউবা থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি সরিয়ে নিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কিউবার বিরুদ্ধে নৌ অবরোধ তুলে নেয়। এইভাবে দুই মহা শক্তিশালী রাষ্ট্রের শুভবুদ্ধির প্রভাবে বিশ্ব একটি সর্বনাশা মহাযুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা পায়। কিউবা সংকট মিটে যায় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে স্বস্তি ফিরে আসে। কিউবা সংকটের অবসানের পর থেকেই ওয়াশিংটন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ও ক্রোমলিন সোভিয়েতের ইউনিয়ন রাজধানীর মধ্যে ঠান্ডা লড়াইয়ের বরফ গলতে শুরু করে।