কিংবদন্তি বা বীরগাথা (Legends)-র সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব লেখ? পৌরাণিক কাহিনী বা কিংবদন্তির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পার্থক্য লেখ?

কিংবদন্তি সংজ্ঞা

সাধারণ বিশেষ কোন অঞ্চলে সংঘটিত কোন ঘটনা বা চরিত্র কেন্দ্রিকাহিনী যার সেই অঞ্চলের মানুষ প্রজন্ম পরম্পরায় মনে রাখে এবং বিশ্বাস করে ও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে প্রচার করে, তাকে কিংবদন্তি বলে। মৌখিক ইতিহাসের প্রধান উপাদান হলো কিংবদন্তি কাহিনী বা বীরগাথা (Legends) । সত্য, মিথ্যা, সম্ভাবনা এই তিনের মিলিত সমষ্টি কিংবদন্তি। পুরা কালে বিশেষ কোন ভোট উৎসবে কোন সন্ন্যাসী বা ধর্মগুরু যে সমস্ত জীবন বৃত্তান্ত কথিত বা গীত হতো তাকে কিংবদন্তি বলা হত। ডক্টর রিচার্ড ক্যাভেডিস তার ‘Legend of the world’ গ্রন্থে লিখেছেন -“কিংবদন্তি হল সুন্দর গল্প, যা যা নিজস্ব শৈলীতে মনোগ্রাহী এবং এগুলি প্রায়শই বর্ণনা করে, যা প্রকৃত ঘটেছে, তার পরিবর্তে, যা ঘটা উচিত ছিল সেই বিষয়কে।”

ব্লুমসবেরি ইংরেজি অভিধানে কিংবদন্তি সম্বন্ধে বলা হয়েছে- কিংবদন্তি হল এমন এক গল্প যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে উপস্থাপিত হয়েছে ইতিহাস রূপে, আসলে যা সত্যি নয়। মারিয়া লিচ সম্পাদিত ‘Standard Dictionary of Folklore, Mythology and Legend’ গ্রন্থে বলা হয়েছে “কিংবদন্তি একটি বর্ণিত বিষয়ের উপর প্রচলিত হয়েছে, যার ঘটনার ওপরে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে, এর সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে ঐতিহ্য গত উপাদান, যাতে কোন ব্যক্তি, থান অথবা ঘটনার কথায় বলা হয়।”

কিংবদন্তির বৈশিষ্ট্য

(১) উদ্ভবগত

অনেকের ধারণায় মানুষের সামাজিক বিবর্তনের পথ ধরেই কিংবদন্তির উদ্ভব হয়েছে। বিভিন্ন দেশের পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক কল্পনা কাহিনী চরিত্রগুলি থেকে কিংবদন্তির জন্ম বলে মনে করা হয়। মূলত পুরা কাহিনীর পরবর্তীকালে কিংবদন্তি জন্ম। যে সময় মানুষ আদিম জীবন থেকে অনেক দূরে এগিয়ে এসেছে সেই সময় থেকে কিংবদন্তি সূচনা।

(২) বিরত্বমূলক কাহিনী নায়ক

কিংবদন্তি বা বীরগাথায় আসলে বীরত্ব মূলক কাহিনী নায়কের দ্বারা অতীতের কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তি বর্গের বীরত্বপূর্ণ ও অবিশ্বাস্য কর্মকাণ্ডের পরিচয় তুলে ধরা হয়। অনেক সময় এই বিরক্ত পুণ্য কাহিনীগুলি নায়ক ঈশ্বরের মতোই সীমাহীন শক্তির অধিকারী রূপে প্রকাশিত হয়। তাই বলা হয় কিংবদন্তি কোন প্রামাণ্য চরিত্র নয়।

(৩) লোকমানসজাত গল্প

লোকসংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত হল কিংবদন্তি। লোকের মুখে মুখে বিভিন্ন কথা বা বিশ্বাসের মাধ্যমে কিংবদন্তি ছড়িয়ে পড়ে। লোকো কাহিনীর যাবতীয় বৈশিষ্ট্য কিংবদন্তির মধ্যে রয়েছে তাই লোক বিজ্ঞানী ডক্টর রইচআর্ড এম.ডরসন বলেছেন, ‘আসলে এ তো এক প্রকারের লোকও কাহিনী বা যুগ যুগান্তর, কাল কালান্তর ধরে আকাশের তারার মতো লোক চিত্র ফুটতে থাকে।’ কিংবদন্তি লোককায়ত জীবনের যথার্থ প্রতিফলন, এতে লোক বিশ্বাস ও সংস্কার লুকিয়ে থাকে।

(৪) অতিরঞ্জন

কিংবদন্তিতে কাহিনী বা ঘটনার বিবরণ গুলিকে অতিরঞ্জিত করা হয়। কিংবদন্তি চরিত্র বা ঘটনা গুলির মধ্যে মানবিক কাল্পনিক ঘটনা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। বলা যায় কিংবদন্তি হলো বাস্তব ও কল্পিত ঘটনার সংমিশ্রনে গঠিত খন্ড খন্ড অবয়ব। কিংবদন্তির কাহিনী বা ঘটনার সত্য মিথ্যা যাই হোক না কেন এগুলি মানুষের বিশ্বাস করে থাকে। আসলে কিংবদন্তি চরিত্র এবং ঘটনা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লৌকিক হওয়ায় তার বিশ্বাসযোগ্যতা বেশি।

(৫) বিস্ময় ও কল্পনা

কিংবদন্তির প্রেক্ষাপট রচনা সাহায্য করে থাকে বিস্ময় ও কল্পনা। কিংবদন্তির চরিত্র বা কাহিনীগুলি আমাদেরকে বিস্মিত করে এবং আমাদেরকে এক কল্পনা জগতে নিয়ে যায়। কিংবদন্তি হল বস্তুর সাধারণ মানুষের ভাবনা ও আগ্রহের বিকশিত রূপ যাতে কালে কালে নতুন কল্পনার রং মিশে তাকে কাল্পনিক করে তোলে।

(৬) ইতিহাস ধর্মিতা

অনেক সময় কিংবদন্তির মধ্যে সত্য ইতিহাস ভিত্তিক কাহিনী লুকিয়ে থাকে। সংস্কৃতি নৃবিজ্ঞানীগণ মনে করেন কিংবদন্তির মধ্যে ক্ষীণভাবে হলেও ইতিহাসের সূত্র রয়ে যায়। যদিও মৌখিক ঐতিহ্য রূপান্তরী হওয়ার পরও কিংবদন্তির মধ্যে অনেক বেশি কাল্পনিক প্রলয় পড়ে। ফলে তখন আর ইতিহাসকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই ঐতিহাসিক সরকার থমসন তার ‘The Folk’ গ্রন্থে লিখেছেন প্রাথমিক অবস্থা কিংবদন্তির মধ্যে কিছু ঐতিহাসিক বিশিষ্ট থাকলেও পরবর্তীকালে পল্লবিত হতে হতে ইতিহাসের প্রকৃত ঘটনা মুছে যায়, রোজা শুধুমাত্র সম্ভব অসম্ভবের অপরূপ কাহিনী।

কিংবদন্তি গুরুত্ব

কিংবদন্তির ঐতিহাসিক সত্যতা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও তা একেবারেই গুরুত্বহীন নয়।

(১) ঐতিহাসিক তথ্যের উৎস

বেশ কিছু কিংবদন্তি থেকে আমরা ঐতিহাসিক তথ্যের উৎস পেয়ে থাকি। লোকমুখের পুরুষানুক্রমে কাহিনী প্রচারিত হলেও প্রাথমিকভাবে সেগুলির মধ্যে ইতিহাসের তথ্যসূত্র লুকিয়ে থাকে। কিংবদন্তির পেক্ষাপটে পূর্ববঙ্গের সীতারকোট-এর উঁচু টিভিতে পরীক্ষামূলকভাবে খননকার্য চালিয়ে প্রাচীর বৌদ্ধ বিহারের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে।

(২) আনন্দদান

কিংবদন্তি চরিত্র বাঘ ঘটনা গুলির অলৌকিক কাহিনী পাঠ করে পাঠকূল আনন্দ পেয়ে থাকে। বেশ কিছু কিংবদন্তি আজও জনপ্রিয়। অনেক সময় কল্পনা প্রবণ হলেও পাঠকের কাছে তা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে বলে কিংবদন্তি পাট আনন্দ দান করে।

(৩) প্রবাহমান ঐতিহ্য

নৃতাত্ত্বিক বিচারে একটি দেশ বা জাতি অঞ্চলে একটি বিশেষ পরিমণ্ডলের মধ্যে আবদ্ধ না থাকলে কিংবদন্তি দেশ দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ে। এক বিশেষ অঞ্চলের ঐতিহ্যের মধ্যে কিংবদন্তি গড়ে উঠলেও তাই পরবর্তীকালে প্রবাহমান ঐতিহ্য রূপান্তরিত হয়।

(৪) শিক্ষাদান

কিংবদন্তি চরিত্রগুলি কর্মকাণ্ডে আমাদেরকে নৈতিকতার শিক্ষা দান করে বলা চলে। সত্যের প্রতি নিষ্ঠা, অমনীয় দৃঢ়তা, সাহসিকতা, ত্যআগ, তিতিক্ষা, উদারতা, মানবিকতা এসবের প্রতি গুরুত্ব দান নৈতিকতা শিক্ষাকে সমৃদ্ধ করে।

কিংবদন্তি ও পৌরাণিক কাহিনী পার্থক্য সমূহ

কিংবদন্তি

(১) মূল চরিত্র : মানুষের মূল চরিত্র। এতে কাহিনীর মূল চরিত্র মানবতার উপর আরোপিত। মূল চরিত্রটি মানুষের বীরত্ব মূলক কর্মকান্ড বা বীরগাথার পরিচায়ক।

(২) ভিত্তি : এর কাহিনীগুলি ঐতিহাসিক, সামাজিক বা সংস্কৃতিক ভিত্তি থাকে। কোন একটি বিশেষ অঞ্চলের সংস্কার, লোকু বিশ্বাস ওপর নির্ভর করে কিংবদন্তি গড়ে ওঠে।

(৩) বিষয় : লোকসাহিত্য, লোকো কাহিনী, গাথা-গীতিকা, বিচিত্র জনশ্রুতি, লোকবিশ্বাস ইতিহাস, প্রেম-বিরহের গাথা, আধ্যাত্মিক বিষয়ক কাহিনী, সন্ন্যাসী-ডাকাত-পড়ি-ভূত প্রভৃতির ঘটনা এর বিষয়বস্তু।

(৪) শ্রেণীবিভাগ : সংস্কৃতি বিজ্ঞানীরা কিংবদন্তিকে কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করেছেন যথা- (i) ব্যক্তি কেন্দ্রিক (ii) স্থান কেন্দ্রিক (iii) বস্তু কেন্দ্রিক (iv) আধ্যাত্মিক ও লৌকিক প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক (v) প্রকৃতি কেন্দ্রিক (vi) আদর্শ ও অলৌকিক বিষয়ক ভিত্তিক (vii) দেব দেবীকেন্দ্রিক (viii) মেলা ও উৎসব কেন্দ্রিক প্রভৃতি।

(৫) কালপঞ্জি : ইতি বর্তমানে সময় নিরীক্ষে যথাযথভাবে ঘটনাভিত্তিক সময়কালের উল্লেখ বা কালপঞ্জি থাকে।

(৬) ঐতিহাসিক : নীতি রচনা কালে ক্ষীন ভাবে হলে ঐতিহাসিক সূত্র থাকে। অনেক সময় এগুলির মধ্যে ইতিহাসের আদি ঘটনার প্রামাণ্য তথ্য সূত্র মেলে।

পৌরাণিক কাহিনী

(১) মূল চরিত্র : অলৌকিক দেবদেবী এর মূল চরিত্র। এতে কাহিনী চরিত্র ঈশ্বর বা ঐশ্বরিক শক্তির ওপর আরোপিত। মূল চরিত্রটি ঈশ্বরের অলৌকিক লীলা কাহিনী বা কর্মকাণ্ডের রূপকার।

(২) ভিত্তি : এর কাহিনীগুলি মূলত ধর্মভিত্তিক। ধর্মীয় বিশ্বাস, ধর্মীয় সংস্কার, রীতিনীতি, পুজো প্রার্থনা, ধর্ম উৎসব উপচার ইত্যাদির ভিত্তিতে পৌরাণিক কাহিনীগুলি গড়ে ওঠে।

(৩) বিষয় : বিশ্ব সৃষ্টি রহস্য, দেবতা মানবের জন্ম, মহাপ্লাবন, দেবতা-দানব-মানবের দ্বন্দ্ব, জন্ম-মৃত্যু-আত্মা-পুনর্জন্ম-অবতার, স্বর্গ-নরক, পাপ পুণ্য সমস্ত কিছুই হলো এর বিষয়ে।

(৪) শ্রেণীবিভাগ : সংস্কৃতি বিজ্ঞানীরা বিশ্ব জননেতার নিরিখে পৌরাণিক কাহিনী কে কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করেছেন যথা- (i) সৃষ্টি তত্ত্বমূলক (ii) মানুষের উদ্ভব মূলক (iii) সৃষ্টি মূলক (iv) প্রলয় সূচক (v) আগুনের অধিকার বিষয়ক (vi) সংস্কৃতির বিকাশ বিষয়ক (vii) চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্র কেন্দ্রিক (ix) ধর্মাচার সম্পর্কিত (x) সংস্কৃতিধাতা (Culture Hero) বিষয়ক প্রকৃতি।

(৫) কালপঞ্জি : এতে বর্তমানে সময়ের নিরিখে ঘটনা ভিত্তিক ধারাবাহিক সময়কালের উল্লেখ বা কালপঞ্জি থাকে না।

(৬) ঐতিহাসিকতা : এর মধ্যে ইতিহাসের প্রামাণ্য তথ্যসূত্র মেলেনা। এটি মূলত ধর্মীয় কল্পকথা ও এতে লোকে কল্পনার আধিক্য থাকে।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment