কবি ঘনরাম চক্রবর্তীর জীবন ও কবি-প্রতিভা | ধর্মমঙ্গল কাব্যের কাহিনি | বাংলা মঙ্গলকাব্যের ধারায় শিবায়ন কাব্যটির গুরুত্ব

কবি ঘনরাম চক্রবর্তীর জীবন ও কবি-প্রতিভা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলােচনা করাে

ঘনরাম চক্রবর্তীর জীবনকথা: ধর্মমঙ্গল কাব্যের সর্বাধিক প্রচারিত ও শ্রেষ্ঠ কবির নাম ঘনরাম চক্রবর্তী। বর্ধমান জেলার দামােদর নদের তীরে কৃয়পুর কুকুড়া (কুগড়াে) গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম গৌরীকান্ত, মাতার নাম সীতাদেবী। গুরু শ্রীরামদাসের আদেশ অনুসারে তিনি ধর্মমঙ্গল কাব্য রচনায় ব্রতী হন। তাঁর প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে বর্ধমানের রাজা তাকে কবিরত্ব’ উপাধিতে ভূষিত করেন। অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে (১৭১১ খ্রি.) তিনি এই কাব্যটি রচনা করেন। তিনি তার ভণিতায় এই কাব্যকে ‘শ্রীধৰ্ম্মমঙ্গল’, ‘শ্রীধর্মসঙ্গীত’, ‘অনাদিমঙ্গল’, ‘মধুর ভারতী প্রভৃতি বিভিন্ন নামে অভিহিত করেছেন।

ঘনরাম চক্রবর্তীর কবিপ্রতিভা: ঘনরাম চক্রবর্তীর কাব্যে মহাকাব্যোচিত আভিজাত্যের প্রকাশ ঘটেছে। সেখানে রামায়ণ’, ‘ভাগবত’, ‘মহাভারত প্রভৃতির ছায়া যেমন দেখা যায়, তেমনি পাণ্ডিত্য ও কবিত্বের অদ্ভুত মিলনও লক্ষ করা যায়। বিভিন্ন চরিত্রচিত্রণের ক্ষেত্রে তার সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণশক্তি এবং বাস্তববােধের গভীর পরিচয় পাওয়া যায়। লাউসেন চরিত্রটিকে তিনি গড়ে তুলেছেন বলিষ্ঠ পৌরুষ ও বীরত্বের প্রতিমূর্তিরূপে। তাঁর সৃষ্ট নারী চরিত্রগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল রঞ্জাবতী, কলিঙ্গা, কানাড়া, লখ্যা। এঁদের কেউ স্নেহময়ী জননী, কেউ বীরাঙ্গনা, কেউ বা আবার লাবণ্যময়ী প্রেমিকা। হাস্যরস পরিবেশনেও কবি মধ্যযুগীয় ভাঁড়ামি ও স্থূলতাকে যথাসম্ভব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। শব্দ-নির্বাচন এবং ছন্দ-অলংকার প্রয়ােগেও তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।

ধর্মমঙ্গল কাব্যের কাহিনি সংক্ষেপে বর্ণনা করাে

ধর্মমঙ্গল কাব্যের কাহিনিতে গৌড়ের রাজা নিজের শ্যালিকা রঞ্জাবতীর সঙ্গে বিপত্নীক সামন্তরাজা কর্ণসেনের বিয়ে দেন। কিন্তু রঞ্জাবতীর দাদা মহামদ এই বিয়ে মেনে নেননি।

ধর্মঠাকুরের কৃপায় রঞ্জাবতী পুত্রসন্তান লাভ করলে সেই পুত্রের নাম রাখা হয় লাউসেন। মহামদ যুবক লাউসেনের ক্ষতি করার জন্য বারবার তাকে বিভিন্ন ঝুঁকিবহুল যুদ্ধে পাঠাবার চক্রান্ত করলেও তিনি ধর্মঠাকুরের কৃপায় সর্বত্রই জয়লাভ করেন। ধর্মঠাকুরের কৃপায় যুদ্ধে নিহত হন ইছাই ঘােষ। তারপরেও মহামদের প্ররােচনায় গৌড়ের রাজা লাউসেন ধর্মঠাকুরের প্রকৃত ভক্ত কি না তাতে সন্দেহ প্রকাশ করেন। তিনি লাউসেনকে পশ্চিম দিকে সূর্যোদয় ঘটিয়ে ধর্মঠাকুরের ভক্ত হওয়ার প্রমাণ দিতে বলেন। ‘হাকন্দ নামে একটি জায়গায় লাউসেন এই অসাধ্য সাধন করেন। লাউসেন যখন তপস্যারত, তখন সেই সুযােগে মহামদ ময়নাগড় আক্রমণ করেন। নিহত হন কালু ডােম এবং লাউসেনের প্রথমা স্ত্রী কলিঙ্গা। লাউসেন ময়নাগড়ে ফিরে ধর্মঠাকুরের স্তব শুরু করলে সকলেই বেঁচে ওঠে। মহাপাপের জন্য মহামদ কুষ্ঠরােগে আক্রান্ত হলে লাউসেন ধর্মঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করায় তিনি রােগমুক্ত হন। এভাবে ধর্মঠাকুরের পূজা প্রচার করে লাউসেন তাঁর পুত্র চিত্রসেনের হাতে রাজ্যভার দিয়ে যথাসময়ে স্বর্গারােহণ করেন।

বাংলা মঙ্গলকাব্যের ধারায় শিবায়ন কাব্যটির গুরুত্ব আলােচনা করাে

শিব আর্য দেবতা হলেও, অস্ট্রিক সংস্কৃতিজাত কৃষিদেবতার প্রতীক হিসেবে যে শিবের পুজো গ্রামবাংলার লােকসমাজে প্রচিলত ছিল, তাকে নিয়েই সপ্তদশ শতাব্দী থেকে রচিত হতে থাকে শিবমঙ্গল বা শিবায়ন। মঙ্গলকাব্যের ধারা মেনেই শিবের মাহাত্মপ্রচার এই কাব্যের উদ্দেশ্য। কিন্তু মঙ্গলকাব্যের গঠনরীতি শিবায়নে অনুসরণ করা হয়নি। নামকরণেও কবিরা মঙ্গল শব্দটিকে ব্যবহার করেননি। কোনাে শাপভ্রষ্ট দেবদেবীর কাহিনিকেও এখানে জায়গা দেওয়া হয়নি। প্রথমাংশে শিবের কিছু পৌরাণিক আখ্যানের বর্ণনা থাকলেও দ্বিতীয়াংশে শিব একান্তভাবেই লৌকিক চরিত্র। তাঁর ভিক্ষুকজীবন, কৃষিকাজে আত্মনিয়ােগ, অবৈধ প্রেম, দাম্পত্য কলহ কাব্যমধ্যে তুলে ধরা হয়েছে। গ্রামবাংলার কৃষিনির্ভর জীবনের রােজনামচা শিবের জীবনচর্যার মধ্যে দিয়ে তুলে ধরাই যেন ছিল তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য।

সপ্তদশ শতাব্দীর রামকৃষ্ণ রায় এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর রামেশ্বর ভট্টাচার্য শিবায়নের দুজন উল্লেখযােগ্য কবি। শিবায়নের কবিগণ খুব উচ্চ প্রতিভার অধিকারী ছিলেন না। তা সত্ত্বেও রামকৃষ্ণ রায়ের কবিতায় পুরাণ এবং লােকজীবনের আদর্শ সমন্বয় দেখা যায়। ত্রিপদী ছন্দের ব্যবহারেও তিনি মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। অন্যদিকে রামেশ্বর ভট্টাচার্য তাঁর শিবায়নে ধর্মকে বহিরঙ্গে রেখে অষ্টাদশ শতকের সমাজজীবনের উচ্ছঙ্খলতা ও রুচিহীনতাকে তুলে ধরেছেন। কাহিনিবিন্যাসে এবং আলংকারিক কলাকৌশলের প্রয়ােগেও রামেশ্বর দক্ষতা দেখিয়েছেন।

বিদ্যাপতি বাংলা ভাষায় কিছু লেখেননি, তবু তাকে বাংলা সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয় কেন

বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাপতির অন্তর্ভুক্তির কারণ: মৈথিলি কবি বিদ্যাপতি বাংলাদেশের লােক ছিলেন না, এমনকি বাংলাতে তিনি কোনাে পদ রচনাও করেননি। অথচ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে শ্রদ্ধা ও ভালােবাসার সঙ্গে তাকে স্মরণ করা হয়। এর কারণ-

  • যেসব বাঙালি ছাত্র মিথিলায় ন্যায়শাস্ত্র পড়তে যেত, তারা দেশে ফেরার সময় বিদ্যাপতির অনেক উৎকৃষ্ট পদ শিখে আসত। এইভাবে তার বহু পদ বাঙালি রসিকজনের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।
  • রাধাকৃয়ের প্রেম-বিষয়ক রচনা বাঙালির কাছে পরম আদরের বস্তু বলেই বাঙালি ভক্ত ও রসজ্ঞদের কাছে বিদ্যাপতি সমাদর পান।
  • জানা যায়, স্বয়ং চৈতন্যদেব বিদ্যাপতির পদাবলি আস্বাদন করে আনন্দ পেতেন-

বিদ্যাপতি জয়দেব চণ্ডীদাসের গীত। আস্বাদয়ে রামানন্দ স্বরূপ সহিত।।

  • শুধু চৈতন্যদেবের কাছে নয়, বিদ্যাপতির পদ সমগ্র বৈয়বসমাজের কাছেই সমাদৃত হয়ে থাকে। চৈতন্যচরিতামৃত বইতে বিদ্যাপতির উল্লেখ আছে; ‘ক্ষণদাগীত চিন্তামণি’, পদকল্পতরু ইত্যাদি সংগ্রহে বিদ্যাপতির অন্তর্ভুক্তি তাঁর গ্রহণযােগ্যতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে।
  • বিদ্যাপতি যে ভাষায় রাধাকৃয় বিষয়ক পদ রচনা করেছেন তা বাংলা না হলেও ভাষাগত মিলের জন্য বাঙালি পাঠক ও শ্রোতার কাছে সেগুলির রস আস্বাদন করা তেমন কঠিন ছিল না।

এইসব কারণে মৈথিলি কবি বিদ্যাপতির পদাবলি বাংলায় লেখা না হওয়া সত্ত্বেও বাংলা সাহিত্যের পরম সম্পদরূপে গৃহীত হয়েছে।

বাংলা সব প্রশ্ন উত্তর (একাদশ শ্রেণি)

Leave a Comment