জ্যোতিবা গোবিন্দরাও ফুলে ও সমাজ সংস্কার
উপনিবেশিক শাসনকালে বাংলার বাইরে ভারতের সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে মহারাষ্ট্রের পিছিয়ে পড়া ও নিপীড়িত মানুষের নেতা মহাত্মা জ্যোতি বা গোবিন্দরাও ফুলে ১৮২৭-১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের অবদান অনস্বীকার্য। তিনি মহারাষ্ট্রের এক সম্পন্ন কুনবী কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং একটি স্কটিশ মিশনারী বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার ফলে সেখানকার প্রভাব তার মনে ব্রাহ্মণ আধিপত্য-বিরোধী মনোভাব গড়ে তুলতে সহায়তা করে। জ্যোতিবা ফুলের সমাজের নিম্ন শ্রেণীর মানুষের উন্নতি এবং তাদের মধ্যে আধুনিক প্রাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটানোর জন্য আজীবন চেষ্টা চালিয়েছেন। তিনি সাম্য ও যুক্তির দ্বারা মানুষের সামাজিক সমস্যা ও কুসংস্কার গুলি দূর করতে চেয়েছিলেন।
১. ব্রাহ্মণ্যশ্রেণীর বিরোধিতা
জ্যোতিবা ফুলে মহারাষ্ট্রের সমাজ জীবনে ব্রাহ্মণ শ্রেণীর একচেটিয়া আধিপত্যে তীব্র বিরোধিতা করেন। তিনি প্রচার করেন যে, শূদ্রদের সামাজিক দাসত্ব বজায় রাখার জন্য ব্রাহ্মণ শাস্ত্র গ্রন্থ গুলি রচিত এবং হিন্দু ধর্মের ইতিহাস হল শূদ্রদের ওপর ব্রাহ্মণদের অত্যাচারের ইতিহাস। তিনি ব্রাহ্মণ বাদ কে চ্যালেঞ্জ করে ‘গুলামগিরি’, ‘ব্রাহ্মণাচে কসাব’ , ‘শ্বেতকার্যচ অসুদ’ প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন। ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে তিনি কুনবী, মালি, মাঙ, মাহার তথাকথিত নিম্নবর্গের মানুষকে সচেতন করেন। এভাবে তিনি দক্ষিণ ভারতে ব্রাহ্ম বিরোধী আন্দোলনের প্রসার ঘটান। ব্রাহ্মণবাদের আধিপত্য থেকে নিম্নবর্গের মানুষকে রক্ষার জন্য তিনি ব্রিটিশ শাসনের সহায়তা নিতেও দ্বিধা করেননি। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহের সময় তিনি ইংরেজদের সমর্থন করেন, কারণ তার মতে, বিদ্রোহীরা সফল হয়ে ভারতে আবার ব্রাহ্মণ রাজ প্রতিষ্ঠিত হতো।
২. সমাজ সংস্কার
মহারাষ্ট্রের সামাজিক জীবনে প্রচলিত জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা, কুসংস্কার, বহুবিবাহ, নারীদের দুর্দশা প্রভৃতি ঘটনার জ্যোতিবা ফুলের খুবই ব্যথিত হন। তিনি এসব সামাজিক অনাচার ও কু-প্রথার বিরুদ্ধে যে হাত ঘোষনা করে এসবের বিরুদ্ধে তীব্র প্রচার চালান। যদিবা ফুলের স্ত্রী সাবিত্রী বাই তার সমাজ সংস্কার কাজে খুব অসমতা করে।
৩. নিম্নবর্গের উন্নতি
সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং নিম্নবর্গ ও সমাজে পিছিয়ে পড়া মানুষের উন্নতির উদ্দেশ্যে জ্যোতিবা ফুলে ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের সত্যশোধক সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। এই সমাজের মুখপত্র ‘দীনমিত্র’ । নিম্নবর্গের মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির উদ্দেশ্যে এই সমাজ আন্দোলন চালিয়ে যায়। এই সমাজে প্রকাশিত প্রথম রিপোর্টে বলা হয় যে, ব্রাহ্মণদের দাসত্ব থেকে শূদ্রদের সুরক্ষিত করার উদ্দেশ্যে এই সংগঠন গড়ে উঠেছে। গেইল ওমভেট মনে করেন, সত্যশওধক আন্দোলনে এলিস্ট্রিট রক্ষণশীল ধারার সঙ্গে গণভিত্তিক রাডিক্যাল ধারার সমন্বয় লক্ষ্য করা গিয়েছিল।
৪. শিক্ষা সংস্কার
জ্যোতিবা ফুলে সমাজে নিম্ন বর্গের মানুষের মধ্যে ইংরেজি ও আধুনিক প্রাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তিনি অনুভব করেন যে কেবলমাত্র উচ্চ বর্ণীয় রাই আধুনিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে। নিম্নবর্নের মানুষ উচ্চশিক্ষার সুযোগ লাভে বঞ্চিত হওয়ায় তিনি সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন। সদাশিব, পরআঞ্জপএ, বল্লাল প্রমুখ সংস্কার জ্যোতিবার শিক্ষামূলক কাজে বিশেষ সহায়তা করেন।
৫. নারী কল্যাণ
নারী সমাজের দুর্দশা মোচন করে তাদের কল্যাণের উদ্দেশ্যে জ্যোতিবা ফুলে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি নারীর বাল্যবিবাহ, শিশুকন্যা হত্যা প্রভৃতি তীব্র বিরোধিতা করেন। তিনি বিধবা বিবাহের সমর্থনে মহারাষ্ট্রে প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলেন। নিম্ন বর্ণে নারীদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারণ ঘটনার উদ্দেশ্যে তিনি ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে বেশ কয়েকটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিল তার স্ত্রী সাবিত্রী বাই কর্তৃক পুনাতে প্রতিষ্ঠিত পশ্চিম ভারতের প্রথম বালিকা বিদ্যালয় ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে।
৬. কৃষকদের উন্নতি
জ্যোতিবা ফুলের কৃষকদের উন্নতির বিষয়েও যথেষ্ট চিন্তা ভাবনা করেন। তিনি শ্বেতকার্যচ অসুদ গ্রন্থে কৃষকদের দুর্দশ এর কাহিনী ও এর কারণ সমূহ সবিস্তারে তুলে ধরে। কৃষকদের বিভিন্ন সমস্যা গুলি সমাধানের উদ্দেশ্যে তিনি সরকারকে কৃষি সংস্কারের পরামর্শ দেন। তিনি কৃষকদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারের দাবি করেন।
উপসংহার
মহারাষ্ট্র তথা দক্ষিণ ভারতের সামাজিক সংস্কার ও নিম্ন বর্ণের অগ্রগতির ক্ষেত্রে জ্যোতি বা ফুলে অসামান্য অবদানের স্বাক্ষর রাখেন। ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি মহাত্মা উপাধিতে ভূষিত হন। তার অনুগামী সত্যশোধক নেতা নারায়ণ মেধা জি, লোখাণ্ডে পরবর্তীকালে মহারাষ্ট্রের শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। এম. আর. লেভারেল বলেছেন, “ফুলের সাম্য ও যুক্তিবাদের ভিত্তিতে নির্মিত এক নতুন সামাজিক কাঠামোর জন্য কাজ করে গেছেন”। স্কুলের প্রতি প্রশংসা জানিয়ে তার জীবনিকার অধ্যাপক পাওয়ার বলেছেন, “সমাজ ও শিক্ষা সংস্কারের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন ভারতের একজন প্রকৃত বিপ্লবী”।