ঔপনিবেশিক আমলে গ্রামীণ কৃষক সমাজের শ্রেণীবিভাজন
ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতের গ্রামীণ কৃষক সমাজে বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটে। এক শ্রেণীর কৃষক বিপুল পরিমাণ এক শ্রেণীর কৃষক বিপুল পরিমাণ জমিজমা ও অর্থ সম্পদের মালিক হয়ে ওঠে। তারা পতিত জমির উদ্ধার, অর্থকারি ফসল উৎপাদন, কৃষি-খামার প্রতিষ্ঠান, সুদের ব্যবসা প্রভৃতির মাধ্যমে এই সম্পদের মালিক হয়। মাহাোজনী কারবারো ও ধনী কৃষকদের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের ফলে ভারতের গ্রামীণ কৃষক সমাজে তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই শ্রেণিগুলি সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো-
১. ধনী কৃষক
ব্রিটিশ শাসনকালে এক শ্রেণীর গ্রামীণ কৃষক বিপুল পরিমাণ অর্থ সম্পদের মালিক হয়ে ওঠে। তাদের মধ্যে অনেকেই ছিল গ্রাম প্রধান বা গ্রামের মোড়ল স্থানীয় লোক। ধনী কৃষকরা তাদের বিপুল পরিমাণ অর্থ মহাজনি কারবারে নিয়োজিত করে দরিদ্র কৃষকের উচ্চ সুদের ঋণ দেয়। গ্রামীণ মহাজন এর সংখ্যা কম হলেও গ্রামীন অর্থনীতিতে তারা সর্বাধিক প্রভাব বিস্তারকারী শ্রেণী হিসেবে উঠে আসে। এই ধোনী কৃষক ও মহাজন শ্রেণীর সঠিক সংখ্যা জানা যায় না। তবে অনুমান করা হয় যে, যথেষ্ট সংখ্যক মানুষ এই কারোবারের সঙ্গে যুক্ত ছিল। গ্রামীন কৃষকদের ঋণের অনন্ত ৭৫ শতাংশ মহাজনের কাছ থেকে আস্ত বলে ব্যাংকিং এনকোয়ারি কমিটি রিপোর্টার ১৯২৯-৩১ খ্রিস্টাব্দে থেকে জানা যায়। এই সময় সময় বাংলার অনন্ত ৩০ শতাংশ ধনী কৃষক এই কারবারে সঙ্গে যুক্ত ছিল।
২. ভাগচাষি
গ্রামীন কৃষক সম্প্রদায়ের দ্বিতীয় শ্রেণী ছিল ভাগ চাষী বা বার্গদার শ্রেণী।
(১) ভাগ চাষীর আবির্ভাব : ধনী কৃষকরা সরকারি তাদের জমি চাষের কাজে যুক্ত ছিল না। তাদের কৃষি জমি চাষের দায়িত্ব দেওয়া হত ভাগ চাষীদের হাতে। নিজেরা চাষের কাজে নিযুক্ত হওয়ার পরিবর্তে তারা মহাজনি কারবার ও উৎপাদিত কৃষি পণ্য বিক্রির ব্যবসায় নিযুক্ত হতো। বহু দরিদ্র কৃষক মহাজনের ঋণের অর্থপরিষদ পরিষদে ব্যর্থ হলে মাহাজন তাদের জমি জমা দখল করে নিত। এভাবে জমি হারিয়ে তারা ভাগ চাষিতে পরিণত হয়।
(২) ফসল প্রাপ্তি : ভাগচারীরা নিজেদের খরচের মালিকের জমি চাষ করতো এবং এর বিনিময় তারা উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক ভাগ পেত। তারা ফসলের মাধ্যমে তাদের খাজানা পরিষদ করত।
৩. ভূমিহীন কৃষক-মজুর
(১) অবস্থান : ব্রিটিশ শাসনকালে গ্রামীণ কৃষক সম্প্রদায়ের তৃতীয় স্থানে অবস্থান কত ভূমিহীন কৃষক শ্রেণী। তারা ছিল প্রধানত ক্ষেতমজুর। তারা ধনী কৃষকদের জমিতে রমজানের বিনিময়ে নিজেদের জীবন জীবিকা নির্বাহ করত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমাজে নিম্ন স্তরের দলিত ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ ভূমিহীন ক্ষেতমজুরের পরিণত হয়েছিল। মহাজনের ঋণ এর অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে বহু কৃষক ভূমিহীন ক্ষেতমজুরে পরিণত হয়।
(২) পরিসংখ্যান : মহাজনদের শোষণের ফলে ভারতের গ্রাম সমাজে ভূমিহীন কৃষক মজুরের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে। হান্টারের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ২৪ পরগনা জেলায় খেতমজুরের সংখ্যা ছিল খুবই সামান্য। কিন্তু ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে এই সংখ্যা যথেষ্ট বৃদ্ধি পায় এবং পরবর্তীকালেও এই বৃদ্ধির গতি আবাহন থাকে। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে আদমশুমারি রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, এই সময় বাংলা, বিহারও উড়িষ্যার অনন্ত ১৭.৫ শতাংশ কৃষকই ছিল ভূমিহীন ক্ষেতমজুর।
উপসংহার
ব্রিটিশ শাসনাধীন গ্রামীণ সমাজের ধনী কৃষক সম্প্রদায় ও মোড়ল বিজয় সরকারের সমর্থক শ্রেণীতে পরিণতি হয়। অন্যদিকে তাদের নিজের স্তরে অবস্থানকারী ভাগচাষী ও ভূমিহীন কৃষক মজুররা সুদখোর মহাজন ও সরকারের শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সামিল হয়। প্রতিবাদী এই কৃষকের শ্রেণীর বিভিন্ন বিদ্রোহী ছিল ভারতের ব্রিটিশ সরকারের আর্থিক শোষণের বিরুদ্ধে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বিদ্রোহ।