ঔপনিবেশিক শক্তির উদ্যোগে বিদেশে পাঠানো চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করো? চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের বিদেশে প্রেরণের কারণ কি ছিল?

চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের অভিপ্রায়ণ

ঊনবিংশ ও বিংশ শতকে উপনিবেশিক শক্তির একটি পূর্ণাঙ্গ ঔপনিবেশিক ছিল ভারত এবং আধা উপনিবেশ ছিল চীন। উপনিবেশিক শক্তি গুলি এই সময় দরিদ্র ও জনবহুল রাষ্ট্র ভারত ও চীন থেকে বহু চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক নির্দিষ্ট মেয়াদে বিদেশে কাজে প্রেরণ করতো। চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক বলতে কোন নিয়োগকর্তার অধীনে চুক্তিতে আবদ্ধ শ্রমিক শ্রেণীকে বোঝায় যারা নির্দিষ্ট বেতনের বিনিময়ে বিদেশে নির্দিষ্ট সময়ে কাজ করার চুক্তিতে আবদ্ধ হতো। ভারত ও চীন থেকে বিদেশে পাঠানো চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। এই বৈশিষ্ট্য গুলি হল-

১. দারিদ্র্য

উপনিবেশিক শাসনকালে ভারত ও চীনের বিপুল জনসংখ্যা অধিকাংশ ছিল অত্যন্ত দরিদ্র। অষ্টাদশ শতক থেকে ভারতের জনগণের ওপর ইউরোপীয় বণী কম্পানি গুলির সীমাহীন শোষণ শুরু হয়। উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে থেকে ভারতে প্রত্যক্ষ ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। চীনের প্রত্যক্ষভাবে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেও সে দেশে ব্রিটেনসহ উপনিবেশিক শক্তি গুলি তীব্র সাম্রাজ্যবাদী শোষণ চালায়। এই ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হলে এই দারিদ্রতা আরো বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া দেশের কাজে অভাব, ঘনঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি ঘটনা তাদের দারিদ্র্য কে আরো প্রকট করে তোলে। ফলে এসব দেশে দারিদ্র পরিবারগুলি আর্থিক কারণে বিদেশে কাজ করতে যেত।

২. অভিপ্রায়ন

ইউরোপের বিভিন্ন ঔপনিবেশিক শক্তি উনবিংশ শতকে ভারত ও চীনের দরিদ্র শ্রমিকদের খুব সস্তায় বিভিন্ন কাজে নিয়োগ করার উদ্যোগ নেয়। এদের মধ্যে সর্বাধিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল ব্রিটিশরা। তারা ভারত ও চীন থেকে বিপরীত সংখ্যক সুফল শ্রমিক সংগ্রহ করে তাদের বিভিন্ন উপনিবেশ পাঠায় এবং সেখান থেকে বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত করত। এসব দরিদ্র শ্রমিক রা নিজেদের জীবন জীবিকার উদ্দেশ্যে ইংরেজদের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে তাদের চুক্তিবদ্ধ শ্রমিককে পরিণত হতো।

৩. কাজ

ব্রিটিশরা ভারত ও চীনের যুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের বিদেশে পাঠিয়ে বিভিন্ন উৎপাদন মূলক কাজের নিয়োগ করত। ইউরোপীয়দের বিভিন্ন উপনিবেশে এসব চুক্তিবদ্ধ ভারতীয় ও চীনা শ্রমিকরা আখ ও অন্যান্য বাণিজ্যপূর্ণ উৎপাদিত কাজে নিযুক্ত হয়। আখ থেকে তারা চিনি তৈরি করত। আখ চাষ ছাড়াও তারা উপনিবেশ গুলিতে খনিজ উৎপাদন, সেচের কাজ, অট্টালিকা, সড়ক ও রেলপথ নির্মাণ প্রভৃতি কাজে নিযুক্ত হতো।

৪. বেতন

বিদেশে কর্মরত এসব ভারতীয় ও চীনা চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকদের মাছ মাইনে ছিল আট টাকা। এছাড়া তারা রেশন পেতো। সাধারণভাবে এসব চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের প্রতিদিন ৯ ঘন্টা এবং সপ্তাহে ছয় দিন কাজ করতে হতো। তারা সামান্য খাদ্য, পোশাক-পরিচ্ছন্দ, আশ্রয় ও ওষুধপত্র পেত।

চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক প্রেরণের কারণ

ভারত ও চীন থেকে বিদেশে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক প্রেরণের বিভিন্ন কারণ ছিল। এই কারণগুলি হল-

১. ক্রীতিদাস প্রথা অবসান

ইউরোপের বিভিন্ন উপনিবেশিক শক্তি গুলি তাদের আফ্রিকা ও অন্যান্য অনগ্রসর উপনিবেশ গলির উৎপাদন মূলক কাজে ক্রীতদাস শ্রমিক নিয়োগ করত। কিন্তু ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে মতান্তরে ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ উপনিবেশিক সাম্রাজে ক্রীতদাস প্রথার অবসান ঘটলো উপনিবেশিক গুলিতে শ্রমিকের সংকট দেখা দেয়। এই সংকট পাঠাতে বিদেশ থাকে শ্রমিক আমদানি অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

২. খামার মালিকদের ক্ষতি

পর্যাপ্ত সংখ্যক শ্রমিকের অভাবে উপনিবেশ গুলিতে আখ, চিনি প্রভৃতি উৎপাদনে যথেষ্ট সমস্যা দেখা দেয়। এতে সেখানকার খামার মালিকরা প্রচুর পরিমাণে আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়। এই পরিস্থিতিতে বিদেশ থেকে শ্রমিক আমদানি করে উৎপাদন সচ্ছল রাখার উদ্দেশ্যে খামার মালিকরা ব্রিটিশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।

৩. সরকারি সিদ্ধান্ত

আফ্রিকার চিনি উৎপাদন ব্যাহত হলে চিনি শিল্পের বাজারে সংকট সৃষ্টি হয়। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকার চিনি উৎপাদনের কাজ সচ্ছল রাখার উদ্দেশ্যে ভারত ও চীন থেকে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর থেকে ভারত ও চীনের চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকরা ইউরোপীয় দেশ গুলির বিভিন্ন উপনিবেশ আখ ও চিনি উৎপাদনের উদ্দেশ্যে যেতে থাকে।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment