দলিত সম্প্রদায়ের অবস্থা
খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে বৈদিক সভ্যতার যুগ থেকে ভারতের শূদ্র নামে অস্পৃশ্য দলিত জাতির আত্মপ্রকাশ ঘটে। পরবর্তীকালে আরও বহু অনগ্রসর ও অস্পৃশ্য জাতির উদ্ভব ঘটে। এই অনগ্রসর, শোষিত ও নির্যাতিত সম্প্রদায়ের ব্রিটিশ শাসনকালের দলিত নামে পরিচিত হয়। এই সময় তারা উচ্চ বর্ণের নানা শোষণ ও অত্যাচারের শিকার হয়। তাই দলিতদের কাছে ইংরেজ বিরোধিতার চেয়ে নিজেদের সামাজিক মর্যাদা লাভের বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
১. অবহেলার শিকার
ব্রাহ্মণ তথা উচ্চ বর্ণের মানুষ নিজেদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃত ভাষার মর্যাদা রক্ষার পাশাপাশি ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ এগিয়ে আসে এবং প্রাশ্চাত্য শিক্ষা সংস্কৃতির অনুরাগী হয়ে ওঠে। শিক্ষা সংস্কৃতিতে পিছিয়ে থাকা গ্রাম গঞ্জে দলিত শ্রেণীর মানুষ সংস্কৃত বা ইংরেজি ভাষা জানতো না বলে তারা নিজেদের কথ্য ভাষায় ভাবের আদান-প্রদান করত। উচ্চবর্ণের দলিতদের এই কথ্য ভাষাকে খুবই অবজ্ঞা করতো। ব্রাহ্মণরা দক্ষিণ ভারতের তামিল ভাষাকে যথেষ্ট ঘৃণা চোখে দেখত।
২. কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গি
জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম থেকে সামাজিক স্পর্শকাতর বিষয়গুলির থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করে। কংগ্রেসের উচ্চবর্ণের নেতাদের প্রাধান্য ছিল। তারা অনেকেই জাতিভেদ প্রথা সমর্থক ছিল। কংগ্রেস নেতাদের এরূপ মনোভাবের ফলে দলিতদের সঙ্গে কংগ্রেসের দূরত্ব বাড়তে থাকে এবং তারা ক্রমে কংগ্রেসের বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গির চেষ্টায় সক্রিয় চেষ্টা চালায়। অবশ্য কংগ্রেসের নেতৃত্বে মহাত্মা গান্ধী উত্থানের পথ থেকে কংগ্রেসের এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটতে থাকে। তিনি হরিজন আন্দোলন শুরু করে কংগ্রেসের প্রতি দলিতদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেন। কিন্তু গান্ধীজীর সাবধানী উদ্যোগেদলিতদের সন্তুষ্টি করতে পারেনি।
৩. বাংলায় দলিত সক্রিয়তা
উনবিংশ শতকে বাংলায় দলিত নমঃশূদ্র সম্প্রদায় ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য ও শোষণের বিরুদ্ধে সরব হয়। প্রথম দিকে মতুয়া ধর্মের প্রবর্তক হরিচাঁদ গুরুচাঁদ ঠাকুর এবং পরবর্তীকালে প্রথম রঞ্জন ঠাকুর, যোগেন্দ্র নাথ মন্ডল প্রমুখোলিত নেতা উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে আদমশুমারি উত্তরবঙ্গের রাজবংশী ও কোচদের তপশিলি জাতিভুক্ত করলে এর বিরুদ্ধে তারা সামাজিক আন্দোলন শুরু করে।
৪. দলিত সংগঠন
দক্ষিণ ভারতে তামিল ভাষা ও সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে অব্রাহ্মণদের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়। এর ফলে জাস্টিস পার্টি ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে নামে দলিতদের রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের নাগপুরে অনুষ্ঠিত দলিত নেতাদের সম্মেলনের দলিত আন্দোলনের গতি আসে। এখানে সর্বভারতীয় নিপীড়িত সমিতি গঠিত হয়। এস. সি. রাজা এই সমিতির সভাপতির নির্বাচিত হন। ডক্টর আম্বেদকর ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে সর্বভারতীয় নিপীড়িত শ্রেণীর কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। তার নেতৃত্বের দলিতদের অধিকার রক্ষার আন্দোলনে তীব্র গতি সঞ্চারিত হয়। তিনি দলিতদের পৃথক নির্বাচনের অধিকার দাবি করেন।
৫. আম্বেদকরের ভূমিকা
গান্ধীজী সহ অন্যান্য কিছু নেতার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা অস্পৃশ্যতা বিরোধী দলিত নেতা আম্বেদকর এর কাছে বিশেষ মূল্যবান ছিল না। দলিতদের মন্দিরে প্রবেশ বা উচ্চ বর্ণের সঙ্গে মেলামেশার অধিকারের চেয়ে তিনি দলিতদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি ঘটানো বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দেন। তিনি ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে দলিতদের নিয়ে মহারাষ্ট্রে সত্যাগ্রহ আন্দোলন করে এবং প্রকাশ্যে ‘মুনস্মৃতি’ গ্রন্থটি পুড়িয়ে তিনি ব্রাহ্মণ ধর্মের বিরোধিতা করেন। তিনি দলিতদের শিক্ষা সংগঠন ও বৃক্ষ আন্দোলনের উপর বেশি গুরুত্ব দেন।
৬. পুনা চুক্তি
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ম্যাকডোনাল্ড তার সম্প্রদায়িক বাটোয়ারা ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের নীতির মাধ্যমে দলিতদের পৃথক নির্বাচনের অধিকার দিলে গান্ধীজীর এর তীব্র প্রতিবাদ করে অনশন শুরু করেন কুড়ি সেপ্টেম্বরে, ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে। স্ত্রী মনে করতেন যে দলিতদের পৃথক নির্বাচনের অধিকার হিন্দু ধর্ম ও দলিত উভয়েরই স্বার্থ বিরোধী। শেষ পর্যন্ত পুনা চুক্তির ২৮ শে সেপ্টেম্বর, ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের মাধ্যমে আম্বেদকর এর দলিতদের পৃথক নির্বাচনের অধিকারের দাবি থেকে সরে আসেন এবং গান্ধীজি ও দলিতদের আরো বেশি সংখ্যক আসন সংরক্ষণের দাবি মেনে নেয়।
উপসংহার
অমলেট করে নেতৃত্বে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে সর্বভারতীয় তপশিলি জাতি ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠা হয়। এরপর থেকে দলিত আন্দোলনকে জাতীয় কংগ্রেস ও গুরুত্ব দিতে শুরু করে। স্বাধীনতা লাভের প্রাক মুহূর্তে দলিত নেতা আম্বেদকর কে সংবিধানের খসড়া রচনা কমিটির সভাপতি নির্বাচন করা হয়। একজন দলিত নেতা নেতৃত্বাধীন কমিটির স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনার অধিকার পায়। তার নেতৃত্বে রচিত নতুন সংবিধানে অস্পৃশ্য তাকে বেআইনি বলে ঘোষণা করা হয়।