একটি স্বতন্ত্র পাঠ্যবিষয় হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশ
আধুনিককালে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সূচনা হয়েছে মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর। অবশ্য বহু আগে অনেক বিখ্যাত লেখক তাঁদের রচনায় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে কিছু মৌলিক চিন্তাভাবনার কথা তুলে ধরেছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন চিনের মেনসিয়াস, ভারতের কৌটিল্য, ইতালির মেকিয়াভেলি প্রমুখ।
[1] জাতি-রাষ্ট্রের উদ্ভব ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক: পন্ডিতদের মতে, আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার উৎপত্তির ফলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সূচনা হয়। এই কারণে ১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দকে এক বিশেষ সন্ধিক্ষণ বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে। তার আগে রাষ্ট্রব্যবস্থা যে ছিল না তা নয়, তবে প্রাচীন গ্রিস, চিন, ভারত ও মিশরে যে রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল তাকে কোনোভাবেই আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা বলা যায় না। যাকে আমরা ভূখণ্ডকেন্দ্রিক সার্বভৌম জাতি-রাষ্ট্র (Territorial Sovereign Nation State) বলছি, তার উৎপত্তি ঘটে ১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে। ইউরোপের নবজাগরণ ও ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ফসল হল আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। এই আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রগুলি নিজেদের সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে একে অপরের সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে যে পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে তোলে তা থেকেই প্রথম আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক বা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সূচনা ঘটে। তাই জাতি- রাষ্ট্রের উদ্ভবের সময়কে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আদিকাল বলে অভিহিত করা হয়।
[2] শিল্পবিপ্লব ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক: অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে যে শিল্পবিপ্লব ঘটে তা আন্তজাতিক সম্পর্কের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলে অনেকে মনে করেন। শিল্পবিপ্লবের ফলে এক রাষ্ট্রের সঙ্গে অন্য রাষ্ট্রের যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি ঘটে এবং এর ফলে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে তোলার বিষয়টি আরও সহজ হয়। রাষ্ট্রগুলি নিজেদের মধ্যে দূরত্বের বাধা অতিক্রম করে আরও কাছাকাছি চলে আসে। এর ফলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।
[3] প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক: আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৯) ও যুদ্ধ-পরবর্তী ঘটনাবলির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পর্যালোচনার বিষয়টি নতুন মাত্রা লাভ করে। এই সময় থেকেই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাত্ত্বিক আলোচনার সূত্রপাত ঘটে। শুরু হয় নতুন চিন্তাভাবনার।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন যে চোদ্দো দফা প্রস্তাব রেখেছিলেন তা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করে। উইলসনের চোদ্দো দফা প্রস্তাবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল-সমস্তরকম গোপন কূটনীতির অবসান, উপনিবেশগুলির স্বাধীনতা, সমস্ত রাষ্ট্রগুলিকে নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন গড়ে তোলা ইত্যাদি। উইলসনের এই চোদ্দো দফা প্রস্তাবকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে মনে করা হয়।প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে জাতিসংঘ (League of Nations)-এর প্রতিষ্ঠা, বৃহৎ শক্তিরূপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ, রুশ বিপ্লবের ফলস্বরূপ সোভিয়েত ইউনিয়নের উদ্ভব ইত্যাদি ঘটনার ফলে আলোচ্য বিষয় হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার (১৯২০ খ্রি.) পর থেকে শুরু হয়ে যায় প্রকাশ্য কুটনীতি (Open Diplomacy)-র যুগ। আন্তর্জাতিক সম্পর্কচর্চায় তার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। প্রসঙ্গত বলা যায়, বিষয় হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কচর্চ্চা এই সময় থেকেই শুরু হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালের এই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি স্বতন্ত্র পাঠ্যবিষয়রূপে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে পড়াশোনা আরস্ত হয়। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে লর্ড ব্রাইস আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপরে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমন্ত্রিত হন। পরের বছর তাঁর বক্তৃতামালা International Relations নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া প্রকাশিত হয় ই এ ওয়ালশ-এর সম্পাদনায় The History and Nature of International Relations (১৯২২ খ্রি.) এবং আর এল বিউয়েল-এর লেখা International Relations (১৯২৫ খ্রি.) প্রভৃতি।
[4] দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-৪৫ খ্রি.) পর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি স্বতন্ত্র পাঠ্যবিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই সময় আন্তর্জাতিক রাজনীতির আমূল পটপরিবর্তন ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২৪ অক্টোবর ৫১টি রাষ্ট্রকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ (UNO)। এই সময় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ইউরোপের প্রাধান্য খর্ব হয়। একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পুঁজিবাদী জোটের রাষ্ট্রগুলি এবং অন্যদিকে সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক জোটের রাষ্ট্রসমূহ-এই পরস্পরবিরোধী দুই জোটের মধ্যে আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিভক্ত হয়ে পড়ে। একে আন্তর্জাতিক রাজনীতির দ্বিমেব্রুকরণ বলা হয়। এক মেরুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অন্য মেরুতে সোভিয়েত ইউনিয়ন। দুই মহাশক্তিধর রাষ্ট্রের মধ্যে ক্ষমতা প্রদর্শন ও মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার যে রেষারেষি চলে তার ফলে এক ধরনের লড়াই দেখা দেয়। এই লড়াইকে বলা হয় ঠান্ডা লড়াই। ঠান্ডা লড়াই হল এমন এক অবস্থা, যাকে এককথায় বলা যেতে পারে না যুদ্ধ না শাস্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আরও এক ধরনের জোট দেখা দেয়, এদের নির্জোট বা জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলা হয়। যেহেতু এই রাষ্ট্রগুলি মার্কিন বা সোভিয়েত-কোনো জোটের মধ্যে যেতে চায়নি, তাই এদের নির্জোট বা জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলা হয়। ভারত, যুগোশ্লাভিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মিশর-সহ কয়েকটি দেশ এই নির্জোট বা জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন গড়ে তোলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই পটপরিবর্তন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। এই সময় থেকেই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এক স্বতন্ত্র বিষয়সূচি গড়ে ওঠে।
[5] নয়া বিশ্বব্যবস্থা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৪৬ বছর পরে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এক নতুন দিকে মোড় নেয়। এই সময় ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এক নতুন বিশ্বব্যবস্থা (New World Order) গড়ে ওঠে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিবর্তনে তার প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘকাল যাবৎ চলে আসা ঠান্ডা লড়াইয়ের পরিসমাপ্তি ঘটে এই সময়। সারা বিশ্বে একক মহাশক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ক্ষমতার ব্রুেকরণ একমুখী হওয়ায় এই সময় থেকে একমেব্রু বিশ্ব (Unipolar World)-এর আত্মপ্রকাশ ঘটে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনা আগে যেমন রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলোচনার মধ্যে সীমিত ছিল, এই সময় থেকে তারও পরিবর্তন ঘটে।রাষ্ট্রগুলির মধ্যে যে পারস্পরিক সম্পর্ককে এতকাল আন্তর্জাতিক সম্পর্কেl একমাত্র মূল আলোচ্য বিষয় হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছিল সেই দৃষ্টিভিlaÆ বদল ঘটে। যারা রাষ্ট্র নয় অথচ রাষ্ট্রের মতোই আন্তর্জাতিক সমাজকে প্রভাবিত করতে সক্ষম, সেইসব অ-রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের (Non- state actors )-ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয যেমন-সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ, আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার, বিশ্ববাণিজ্য সংসখ বিশ্বব্যাংক, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন প্রভৃতি।
[6] বিশ্বায়ন ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক: বিশ্বায়নের যুগে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিবর্তনে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক শুরু হয়েছিল জাতি-রাষ্ট্রের আলোচনাকে কেন্দ্র করো সেখানে এখন বহু বিষয় এর আলোচ্যসূচির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আসলে যে জাতি-রাষ্ট্রের প্রভাব এককালে বিশাল ছিল, তা এখন স্তিমিত হয়ে এসেছে। অনেকে মনে করেন বিশ্বায়নের যুগে রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতার বিষয়টি সংকটাপন্ন। বর্তমানে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা (WTO)-র নীতিনির্দেশ মেনে রাষ্ট্রগুলিকে আর্থিক নিয়মকানুন ঠিক করতে হয়। তাই রাষ্ট্র Bl কোনোভাবেই আলোচনার মূল কেন্দ্রে থাকতে পারে না। এই পরিস্থিতিয়ে বিশ্বায়নের যুগে অধ্যাপক জন বেইলি এবং স্টিভ স্মিথ আন্তর্জাতির সম্পর্কের আলোচনায় যেসব নতুন বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছেন তার মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অর্থতত্ত্ব, পরিবেশগত সমস্যাসন্ধু। পারমাণবিক অস্ত্রের প্রসারণ, সন্ত্রাসবাদ, আঞ্চলিকতাবাদ, বিশ্ববাণিজ্য। অর্থ, দারিদ্রা, উন্নয়ন ও ক্ষুধা, মানবাধিকার, নারী-পুরুষের বৈষম্য প্রভৃতি।
উপসংহার: আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিবর্তনের প্রক্রিয়া জাতি-রাষ্ট্রের উদ্ভবের যুগে শুরু হলেও বিশ্বায়নের এই যুগে এসে থমকে যায়নি। বিস্ত হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি গতিশীল বিষয়। তাই এর বিবর্তনের প্রক্রিয়া আজও চলমান।