উনবিংশ শতকের শেষ দিকে থেকে ভারতের সাম্প্রদায়িকতার প্রসার বিবরণ দাও?

ভারতের সাম্প্রদায়িকতার পোশাক

প্রথম পর্বের ব্রিটিশ বিরোধী কৃষক আন্দোলন গুলি সাম্প্রদায়িক বিভেদ খুব একটা লক্ষ্য করা যায়নি। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকার ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহের পর থেকে সাম্প্রদায়িক বিভেদ নীতির মাধ্যমে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন দুর্বল করার উদ্যোগ নেন। মাউন্টস্টুয়ার্ট এলিফিনস্টোন ব্রিটিশ সরকারকে পরামর্শ দেন যে, প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের প্রধান নীতি ছিল বিভাজন ও শাসন, আমাদের এই নীতি গ্রহণ করা উচিত। সেই উদ্দেশ্যে সরকার শাসন কার্য বিভাজন ও শাসন নীতি প্রয়োগ করে বিভিন্ন সময় হিন্দু, মুসলিম বা অনগ্রসর শ্রেণীকে তোষণ করতে থাকে। এর ফলে উনবিংশ শতকের শেষ দিকে থেকে ভারতের সাম্প্রদায়িক বিভেদের ধারাবাহিক প্রসার ঘটে। ব্রিটিশ ভারতের সাম্প্রদায়িকতার প্রসার সম্পর্কে নিজে আলোচনা করা হলো –

১. দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রসার

ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায় এ দেশে তাদের ধর্মীয় আদর্শকে খুব গুরুত্ব দিত। এদেশে হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রসারে যেমন কখনো কখনো মুসলিম বিরোধিতা লক্ষ্য করা যায়, তেমনই মুসলিম জাতীয়তাবাদে ও হিন্দু বিরোধিতা লক্ষ্য করা যায়। আলীগড় আন্দোলন প্রতিষ্ঠাতা স্যার সৈয়দ আহমদ খান দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রচার করে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ প্রচারী গড়ে তোলেন। তিনি মুসলিম সম্প্রদায়কে বোঝাতে সচেষ্ট হন যে, হিন্দু ও মুসলিম দুটি পৃথক জাতি। এদের সুসম্পর্ক ও সহাবস্থান সম্ভব নয়। তিনি মুসলিম সম্প্রদায়কে জাতীয় কংগ্রেস ও হিন্দু সম্প্রদায় থেকে দূরে থাকতে পরামর্শ দেন। ভারতীয় রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক বিভেদৃষ্টির উদ্দেশ্যে এটিই প্রথম কার্যকরী উদ্যোগ। তারা এই প্রচার হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে বিভেদের বীজ বপন করে।

২. সরকারি উস্কানি

ব্রিটিশ সরকার ভারতের নিজেদের শাসন নিরাপদ ও দীর্ঘস্থায়ী করতে এ দেশের সাম্প্রদায়িক বিভেদের বীজ বপন করে। এই বিবেক বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সরকার বিভিন্ন প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেয়।

(১) লর্ড ক্রসের আইনি ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে দ্বারা সরকার ভারতের সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্বের নীতি চালু করে।

(২) কার্জনের স্বরাষ্ট্র সচিব রিজলে ঘোষণা করেন ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে যে, ভারতের প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠলে উচ্চ বর্গের হিন্দুদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। এজন্য তিনি বিভিন্ন ধর্ম গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের পৃথক প্রতিনিধিত্বের সুপারিশ করেন।

(৩) ঢাকায় নবাব সালিমল্লাহ সরকারের বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনা সমর্থন করার লর্ড মিন্টো তাকে ১৪ লাখ টাকা সরকারি ঋণ দেন।

(৪) ফ্রান্সিস রবিনসন উল্লেখ করেন যে, ইংরেজ আমলরা যুক্ত প্রদেশের উচ্চ বর্গের মুসলিমদের স্মরণ করাতেন যে, ভারতে ইসলামের অস্তিত্ব বিপন্ন, উর্দু ভাষা আক্রান্ত, শিক্ষা ব্যবস্থাকে মুসলিম সংস্কৃতি প্রভাব মুক্ত করতে হিন্দুদের সচেষ্ট ইত্যাদি। যুক্তি প্রদেশ বহু ইংরেজ আমল মুসলিম সম্প্রদায়কে বোঝানোর চেষ্টা করে যে, হিন্দুদের আগ্রাসনের ভারতে ইসলামের ভাষা, সংস্কৃতি ও অস্তিত্ব বিপন্ন।

৩. বঙ্গভঙ্গ

জাতীয় কংগ্রেস ও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মূল কেন্দ্র ছিল বাংলা। এইজন্য সরকার বাংলা হিন্দু-মুসলিম বিভেদ সৃষ্টি করে কংগ্রেস ও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ধ্বংস করার উদ্যোগ নেন। হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সরকার মুসলিম তোষণ শুরু করে। সরকার পূর্ববঙ্গের মুসলিমদের বোঝানোর চেষ্টা করে যে, বাংলা দ্বিখণ্ডিত হলে পূর্ববঙ্গের মুসলিমদের বহু সুবিধা হবে। মুসলিম সম্প্রদায় তা বিশ্বাস করে বঙ্গভঙ্গ কে সমর্থন করে। বঙ্গভঙ্গের পর পূর্ববঙ্গের লেফটেন্যান্ট গর্ভনর স্যারের বামফিল্ড ফুলার ঘোষনা করেন যে, পূর্ববঙ্গে সরকারি চাকরি হিন্দুদের বাদ দিয়ে মুসলিমদের নিয়োগ করা হবে। অমলেশ ত্রিপাঠী বলেছেন যে, ফুলার কাছে মুসলিমরা প্রায় সুয়োরানীর আদর পেতে শুরু করেছিল।

৪. সিমলা ডেপুটেশন

মুসলিম নেতা আগা খাঁ র নেতৃত্বে ৩৫ জন ধনী অভিজাত মুসলিমদের একটি প্রতিনিধি দল ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে এক অক্টোবর সিমলার বড়লাট লর্ড মিন্টোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নিজের সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষার দাবিতে একটি স্মারকলিপি পেশ করে। এটি সিমলা ডেপুটেশন নামে পরিচিত। এই স্মারকলিপিতে সরকারি চাকরি বেশংখ্যক মুসলিমদের নিয়োগ, পরীক্ষা ছাড়া উচ্চপদে মুসলিমদের নিয়োগ, আইন সভায় মুসলিমদের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা, এই পৃথক মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় গঠন প্রভৃতি সাম্প্রদায়িক দাবি জানানো হয়। সরকার ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে মর্লে মিন্টো সংস্কার আইনে এই দাবি কার্যকরী করে।

৫. মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা

মুসলিম সম্প্রদায় তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে একটি সংস্থা গঠনের প্রয়োজন উপলব্ধি করে। কথিত আছে যে, লর্ড মিন্টোই নাকি মুসলিমদের এ ধরনের পরামর্শ দেন। ঢাকা নবাব সলিমুল্লাহর উদ্যোগে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় সর্বভারতীয় মুসলিম অধিবেশন বসে। সেখানে অনুষ্ঠানিকভাবে ৩০ ডিসেম্বরে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে মুসলিম লীগ সরকারের কাছে জাতীয় কংগ্রেস ও হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া পেশ করতে থাকে।

৬. হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা

মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা ও যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। দয়ানন্দ সরস্বতী আর্য সমাজ ও শুদ্ধী আন্দোলন, তিলকের গোরক্ষা সমিতির প্রতিষ্ঠা, শিবাজী ও গণপতি উৎসবের প্রচলন, বিপিনচন্দ্র পাল ও অরবিন্দ ঘোষের হিন্দু দেবীর প্রচার প্রভৃতি মুসলিম সম্প্রদায় সুনজরে দেখেনি। লালা লাজপত রায় এর মত নেতা ও মনে করতেন যে, জাতীয়তাবাদ আন্দোলন হিন্দুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। ভারত ধর্ম মন্ডল, পাঞ্জাব হিন্দু সভা, হিন্দু মহাসভা, হিন্দু সংগঠন উগ্র হিন্দুত্ববাদের প্রচার শুরু করে।

উপসংহার

ভারতের সাম্প্রদায়িকতার প্রসার এদেশের সমাজ সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যথেষ্ট কুপ্রভাব ফেলেছিল। স্বাধীনতার পরবর্তীকালে এই প্রভাবত রয়েছে। ডক্টর বিপাণচন্দ্র স্বীকার করেন যে, বর্তমানকালে সাম্প্রদায়িকতার শেখর নিহত রয়েছে উপনিবেশিক আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment