আমাদের ভারতীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আশা আকাঙ্ক্ষার পরিচয় দাও? অথবা, ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য গুলি কিরূপ ছিল?

মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আশা-আকাঙ্ক্ষা

ঐতিহাসিক বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন ও বি. বি. মিশ্র মনে করেন যে, ব্রিটিশ শাসনকালে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফল ছিল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থান। মধ্যবিত্তের মধ্যে বাংলার গন্ধবণিক, মাদ্রাজের চেটি, গুজরাটের হিন্দু বনিক, কেরালার মোপলা, রাজস্থানের মাড়োয়ারি প্রভৃতি বণিক সম্প্রদায়গুলি ছিল খুবই ধনী। অবশিষ্ট মধ্যবিত্তরা যেমন ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত, উকিল, সাংবাদিক, ডাক্তার, ও অন্যান্য সরকারি চাকরিজীবীর অত্যন্ত বিত্তশালী না হলেও যথেষ্ট সচ্ছল ছিল। ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যেসব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণের প্রয়াস চালায় সেগুলি সম্পর্কে নীচে আলোচনা করা হলো-

১. আধুনিক ভাবধারার গ্রহণ

শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রাশ্চাত্য যুক্তিবাদ, গণতান্ত্রিক, আদর্শ ও মানবতাবাদ প্রভৃতি আধুনিক ভাবধারার মনে প্রাণে গ্রহণ করেন। এর ফলে তারা ভারতীয় সমাজের ক্ষতিকারক কুসংস্কার ও প্রথা সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে এবং এগুলি দূর করতে তৎপর হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে প্রাথমিক সর্বাধিক অগ্রগণ্য ভূমিকা নেন আধুনিক ভারতের অগ্রদূত রাজা রামমোহন রায়। মধ্যবিত্তের আধুনিক ভাবধারার ক্রমে উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়।

২. চাকরির সন্ধান

শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের সর্বাধিক পছন্দের পেশা ছিল সরকারি চাকরি। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে প্রতিবছরে উচ্চশিক্ষিত যুবকের সংখ্যা যথেষ্ট হারে বাড়তে থাকে। কিন্তু সেই হারে সরকারি চাকরি না বাড়ায় তারা সমস্যার মুখে পড়ে। তবে এই সময় থেকে প্রাশ্চাত্য ধাচে নতুন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস আদালত প্রভৃতি সংখ্যায় বাড়তে থাকলে শিক্ষিত যুবকরা কিছু চাকরি পেতে থাকে। তবে ভারতীয়রা যোগ্যতা অনুসারে উচ্চশিক্ষা লাভে বঞ্চিত হয়।

৩. ভূমি কেন্দ্রিক পেশা

মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের একটি অংশ ভূমি থেকে উপার্জিত আয়ের দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতেন। ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করলে বহু মধ্যবিত্ত অকৃষি জমিকে কৃষি জমিতে রূপান্তরের উদ্যোগ নেয়। কৃষি পণ্যের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধির ফলে মধ্যবিত্তদের কাজে জমিদারের পরিচালনা একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়। শহুরে বাঙালি চাকরিজীবী ও অন্যান্য ধনীর মধ্যবিত্তে কেউ কেউ নিলামে জমি কিনে লাভজনক ব্যবসায় প্রবেশ করতে থাকে।

৪. গণতান্ত্রিক অধিকার

শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পাশ্চাত্য শিক্ষা সংস্কৃত সংস্পর্শে এসে গণতান্ত্রিক অধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, সংবাদপত্রে স্বাধীনতা প্রভৃতি একনিষ্ঠ সমর্থককে পরিণত হয়। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসকরা ভারতীয়দের স্বেচ্ছায় এসব অধিকার দেবেনা- এই কথা শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা ভালোভাবেই অনুভব করে। ব্রিটিশ সরকার অস্ত্র আইন ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে, দেশীয় সংবাদপত্র আইন ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে, নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে প্রণয়ন প্রভৃতির মাধ্যমে মধ্যবিত্ত সেই ধারণা স্পষ্ট হয়। ফলে ব্রিটিশ সরকার শাসন নীতির বিরোধিতা করে তারা এসব অধিকার আদায়ের তৎপর হয়।

৫. রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা

পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা প্রথম দিকে ভারতে ব্রিটিশ শাসককে স্বাগত জানালেও কিছুকাল পর তারা ভারতীয়দের রাজনৈতিক অধিকার অর্জন সরব হয়। তারা ব্রিটিশ ভারতের শাসন কার্যে অংশগ্রহণ এবং স্থানীয় স্বায়ত্ত শাসনে অধিকার দাবি জানায়। তারা কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভা গুলিতেভের সংখ্যায় ভারতীয় সদস্য গ্রহণের দাবি জানায়। এছাড়া তারা মনোনয়নের ভিত্তি নয়, নির্বাচনের মাধ্যমে আইনসভা সদস্য গ্রহণের দাবি জানান। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার ১৮৬১ ও ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত আইনে ভারতীয়দের রাজনৈতিক অধিকার প্রতি খুব বেশি নজর না দেওয়ায় মধ্যবিত্ত শ্রেণী ক্ষুব্ধ হয়।

উপসংহার

উপনিবেশিক ভারতের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি ভারতে জাতীয়তাবাদের অগ্রদূত। তাদের প্রচারের ফলে ভারতীয়দের মধ্যে দেশপ্রেম তীব্রতর হয়। ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের প্রসারে এবং সরকারের কাছ থেকে রাজনৈতিক দাবী দাওয়া আদায়ের জন্য নেতৃত্বের প্রয়োজন ছিল। প্রথম দিকে নেতৃত্বের অভাব থাকলেও শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের উত্থানের পর তারা সেই নেতৃত্বে দিয়ে নেতৃত্বের অভাব দূর করে। তাদের নেতৃত্বে পরবর্তীকালে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম জোরদার হয়ে ওঠে।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment