শক্তি বা ক্ষমতার উপাদান
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তি বা ক্ষমতার একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। অর্গানস্কি তাঁর World Politics শীর্ষক গ্রন্থে এই অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল ক্ষমতা বা শক্তি (Power) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি রাষ্ট্র কী ভূমিকা নেবে তা প্রধানত ক্ষমতা বা শক্তির দ্বারা নির্ধারিত হয় (One of the most important char- acteristics of a nation is its power, for power is a major determi- nant of the part that the nation will play in international relations)। হ্যান্স জে মর্গেনথাউ আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব হিসেবে (…a struggle for power) ব্যাখ্যা করেছেন। শক্তি বা ক্ষমতার উপাদান হিসেবে যেসব বিষয়ের কথা উল্লেখ করা হয় সেগুলি হল-
[ 1] ভৌগোলিক উপাদান: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশারদ মর্গেনথাউ-এর মতে, ভৌগোলিক উপাদান হল এমন এক স্থায়ী উপাদান যার ওপরে কোনো জাতির শক্তি নির্ভরশীল। ভৌগোলিক উপাদানের মধ্যে রয়েছে দেশেরঅবস্থান, আয়তন, ভূপ্রকৃতি এবং জলবায়ু।
1. অবস্থান: অনুকূল ভৌগোলিক অবস্থান দেশের সামরিক ও নিরাপত্তাজনিত ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। যেমন-বর্তমান একমেরু বিশ্বের অতিবৃহৎ শক্তি (Super power) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বদিকে তিন হাজার মাইল এবং পশ্চিমদিকে হু-হাজার মাইল জলপথ তাকে নিরাপত্তার দিক থেকে সুবিধাজনক জায়গায় রেখেছে। অবশ্য পরমাণু অস্ত্রের ক্রমবর্ধমান প্রসারের যুগে এই জাতীয় ভৌগোলিক অবস্থানের যথার্থ উপযোগিতা সম্পর্কে প্রশ্ন থেকেই যায়।
ii. আয়তন: ভূভাগের বিশাল আয়তন সামরিক দিক থেকে সুবিধাজনক অবস্থার সৃষ্টি করে বলে মনে করা হয়।
ii.ভূপ্রকৃতি: আধুনিক বিশ্বে জাতীয় শক্তির অগ্রগতির ক্ষেত্রে ভূপ্রকৃতিরও অবদান রয়েছে। যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ভূপ্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। পাহাড়-পর্বত, মরুভূমি, অরণ্য, সমুদ্র ও নদনদীর বাহুল্য যে-কোনো দেশের অর্থনৈতিক বিকাশ তথা রাজনৈতিক ঐক্য, এমনকি জাতীয় প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে।
Iv. জলবায়ু: জলবায়ু মানুষের কর্মক্ষমতা নির্ধারণ করে জাতীয় শক্তিকে প্রভাবিত করে থাকে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞদের মতে নাতিশীতোয় জলবায়ু কোনো দেশের বৃহৎ শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশের পক্ষে সহায়ক।
[2] জনসংখ্যা: জনসংখ্যা বা মানবসম্পদ জাতীয় শক্তির অন্যতম নির্ণায়ক উপাদান। প্রতিরক্ষা, আর্থিক বিকাশ এবং দেশগঠনের ক্ষেত্রে শক্তিশালী, দক্ষ ও শিক্ষিত জনগণের কার্যকরী ভূমিকা রয়েছে। অনেকের মতে, অর্থনৈতিক সম্পদের ব্যবহার ও আর্থিক বিকাশের জন্য জনসংখ্যা যেমন প্রয়োজন, তেমনই অতিরিক্ত জনস্ফীতিও আবার অর্থনৈতিক অবনমন ডেকে আনে।
[3] প্রাকৃতিক সম্পদ: আধুনিক বিশ্বে কোনো দেশকে শক্তিশালী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে গেলে তাকে অতি অবশ্যই প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ হতে হবে। আধুনিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় উচ্চমানের ইস্পাত, খনিজ তেল, ইউরেনিয়াম, প্লুটোনিয়াম প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদের অত্যন্ত প্রয়োজন। প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে কৃষিজ দ্রব্য ও খাদ্যশস্যেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। খাদ্যশস্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জন কোনো একটি দেশের জাতীয় শক্তি ও সামর্থ্য অর্জনের ক্ষেত্রে সহায়ক উপাদান হিসেবে স্বীকৃত। প্রযুক্তিবিদ্যার বিকাশ, শিল্পোন্নয়ন ইত্যাদির জন্য প্রাকৃতিক সম্পদের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য।
[4] অর্থনৈতিক সামর্থ্য: অর্থনৈতিক সামর্থ্য ছাড়া কোনো দেশের পক্ষে জাতীয় শক্তিতে সমৃদ্ধ হওয়া সম্ভব নয়। বর্তমান বিশ্বে শিল্পোন্নত দেশগুলি এই কারণে জাতীয় শক্তির দিক থেকে সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। বস্তুত যে- কোনো দেশের অর্থনৈতিক বিকাশের হার অনুকূল না হলে তার পক্ষে মানবসম্পদ ও প্রাকৃতিক সম্পদের সদ্ব্যবহার করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া এই সম্পদকে কাজে লাগানোর জন্য প্রযুক্তিবিদ্যার জ্ঞান প্রয়োজন। এই প্রযুক্তিবিদ্যাগত জ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতি ঘটিয়ে জাপান বর্তমানে নিজেকে অর্থনৈতিক দিক থেকে শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে।
[5] সামরিক ব্যবস্থা: বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে শক্তিশালী সামরিক ব্যবস্থা না থাকলে কোনো দেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। একটি দেশের সামরিক শক্তি কেবল গতানুগতিক স্থলবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর ওপর নির্ভর করে না। পারমাণবিক বোমা, আন্তর্দেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র ও অন্যান্য শক্তিশালী মারণাস্ত্রের ওপর বর্তমানে একটি দেশের সামরিক শক্তি নির্ভর করে। আধুনিক বিশ্বে পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত না হলে কোনো দেশের পক্ষে বৃহৎ শক্তিতে পরিণত হওয়া সম্ভব নয়।
[6] সরকারের প্রকৃতি: হ্যান্স জে মর্গেনথাউ-এর মতে, একটি উৎকৃষ্ট সরকার ছাড়া পররাষ্ট্রনীতির সার্থক রূপায়ণ সম্ভবপর নয়। সরকারের প্রকৃতির ওপর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা নির্ভর করে। অবশ্য সরকারের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি আমলাবর্গের সক্রিয়তার কথাও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।
[ 7] জাতীয় চরিত্র বা জাতীয় বৈশিষ্ট্য ও আত্মবিশ্বাস: কোনো দেশের শক্তি অর্জনের বিষয়টি সেই দেশের জনগণের জাতীয় চরিত্র বা জাতীয় বৈশিষ্ট্য ও আত্মবিশ্বাসের ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। জাতীয় চরিত্র বা জাতীয় বৈশিষ্ট্য ও আত্মবিশ্বাসের তারতম্যের ফলে জাতীয় শক্তির তারতম্য ঘটে বলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। প্রবল দেশপ্রেম ও সুদৃঢ় মনোবলের জন্যেই ভিয়েতনামের মতো দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বৃহৎ শক্তিধর দেশের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে সাফল্যের সঙ্গে লড়াই চালাতে পেরেছিল।
[8] কূটনীতি: অনেকে কূটনীতিকে জাতীয় শক্তির মস্তিষ্করূপে বর্ণনা করেছেন। মর্গেনঘাউ-এর মতে, যেসব উপাদান নিয়ে কোনো জাতির শক্তি গড়ে ওঠে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল কূটনীতি। কূটনীতির মাধ্যমে একটি দেশ তার জাতীয় শক্তির অন্যান্য উপাদানকে সার্থকভাবে প্রয়োগ করতে পারে।
উপসংহার: যে-কোনো একটি বা কয়েকটি উপাদানের বিশ্লেষণ থেকে শক্তি বা ক্ষমতার সামগ্রিক পরিচয় পাওয়া যায় না। জাতীয় শক্তির ক্ষেত্রে প্রতিটি উপাদানের কার্যকরী ভূমিকা রয়েছে। অবশ্য আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে শক্তি বা ক্ষমতার উপাদানগুলিরও পরিবর্তন ঘটে চলেছে।