আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অর্থ
সমাজে মানুষের সঙ্গে মানুষের যেমন একটা পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে আন্তর্জাতিক সমাজে রাষ্ট্রগুলির মধ্যেও তেমনই একটা পারস্পরিক সম্পক দেখা যায়। আধুনিক পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনো রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না। নিজেদের অস্তিত্বের কারণ আন্তর্জাতিক সমাজে রাষ্ট্রগুলিকে পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলা হয়। রাষ্ট্রগুলির এই পারস্পরিক সম্পর্ককে সাধারণভাবে ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্ক’ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে।
[1] বিভিন্ন লেখকের বক্তব্য: অধ্যাপক কে জে হলসটি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বলতে রাষ্ট্রসমষ্টি নিয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার পর্যালোচনাকে বুঝিয়েছেন। অনেকে অবশ্য আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে শুধুমাত্র রাষ্ট্রসমষ্টির পারস্পরিক সম্পর্ক বলে অভিহিত করতে চাননি। এই প্রসঙ্গে পামার ও পারকিনস, স্ট্যানলি হ্যান প্রমুখ লেখকের কথা উল্লেখ করা যায়। পামার ও পারকিনস মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি বৃহত্তর ধারণা। এর মধ্যে শুধুমাত্র রাষ্ট্রগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক একমাত্র আলোচ্য বিষয় হতে পারে না। পামার ও পারকিনস-এর মতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্বের সব মানুষ ও গোষ্ঠীর যাবতীয় সম্পর্ককে বোঝায় (International Relations is a term properly embracing the totality of the relations among people and groups in the world society)1। স্ট্যানলি হ্যান আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে শুধুমাত্র রাষ্ট্রসমূহের সম্পর্ক বলে মেনে নিতে চাননি। তাঁর মতে, আন্তর্জাতিক সমাজে রাষ্ট্রই যে একমাত্র প্রভাববিস্তারকারী হিসেবে কাজ করে তা নয়, রাষ্ট্রের পাশাপাশি ব্যক্তি, মতাদর্শ, স্বার্থগোষ্ঠী প্রভৃতির ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
[2] আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে অনেকে সমার্থক বলে মনে করেন। হ্যান্স জে মর্গেনথাউ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিবর্তে আন্তর্জাতিক রাজনীতি কথাটি ব্যবহার করেছেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতি জড়িত থাকলেও এদের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি বলতে আন্তর্জাতিক সমাজের রাজনীতিকে বোঝায়। তুলনামূলকভাবে আন্তর্জাতিক রাজনীতির আলোচনার ক্ষেত্র সুনির্দিষ্ট ও সংকীর্ণ। এখানে রাষ্ট্রগুলির সম্পর্কের একমাত্র আলোচ্য বস্তু হল রাজনীতি। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এদিক থেকে দেখতে গেলে বস্তু বিস্তৃত একটি ধারণা। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক রাষ্ট্রগুলির মধ্যে রাজনীতি ছাড়াও অন্যান্য সম্পর্ক নিয়েও আলোচনা করে। এর মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক, সামাজিক সম্পর্ক, সাংস্কৃতিক ও মানবিক সম্পর্ক প্রভৃতি। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক সম্পর্ক শুধুমাত্র রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক, বিভিন্ন রাষ্ট্রের পারস্পরিক সমস্যা ইত্যাদি আলোচনায় সীমিত থাকে না। রাষ্ট্র ছাড়াও অ- রাষ্ট্রীয় সংগঠন ও বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠানের বিষয়েও আলোচনা করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক। যেমন, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনায় বহু আগেই সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের মতো আন্তর্জাতিক সংগঠনের আলোচনাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরে আঞ্চলিক সংগঠনগুলিও এর আলোচ্যসূচির আওতায় আসে যেমন-জোটনিরপেক্ষ গোষ্ঠী, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, আরব লিগ, আফ্রিকান ঐকা সংস্থা, আসিয়ান, সার্ক প্রভৃতি। বর্তমানে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা, আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার, বিশ্বব্যাংকও এর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া বিশ্ব মানবাধিকার গোষ্ঠীর কার্যকলাপ, এমনকি সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর কার্যকলাপও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচ্যসূচিতে স্থান পেয়েছে। কাজেই, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি বিস্তৃত ধারণা। যে বিষয়গুলি আন্তর্জাতিক সমাজকে প্রভাবিত করে, সেগুলি এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। এক্ষেত্রে বলা যায় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি দ্রুত পরিবর্তনশীল বিষয়।
[3] গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা: সবশেষে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা যায়, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক হল এমন একটি বিষয় যা পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্ক, অ-রাষ্ট্রীয় সংস্থা, আন্তর্জাতিক সংগঠন, যুদ্ধ ও শান্তি, নিরস্ত্রীকরণ, জোটগঠন, আণবিক সন্ত্রাস-সহ সমগ্র আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার যাবতীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করে।