বাংলা সাময়িকপত্রের ইতিহাসে ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’ পত্রিকার গুরুত্ব আলােচনা করাে
বাংলা সাহিত্য বিকাশে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত সংবাদ সাময়িকপত্রগুলির ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। ধর্মীয় আদর্শ প্রচারের জায়গায় সাহিত্য বিকাশের দিকটিকে যে সমস্ত পত্র পত্রিকা গুরুত্ব দিয়েছিল, তাদের মধ্যে ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’ অন্যতম।
ঐতিহাসিক ও পুরাতত্ত্ববিদ রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সম্পাদনায় ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’ পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকা প্রকাশের পেছনে ছিল ইংল্যান্ডের পেনি ম্যাগাজিন’-এর আদর্শ। ‘জীবনস্মৃতি গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’ সম্বন্ধে তার ছেলেবেলাকার উচ্ছাস চিরস্থায়ীরূপে প্রকাশ করে গেছেন। এই পত্রিকার উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
- পুরাতত্ত্ব, মনীষীদের জীবনকথা, তীর্থক্ষেত্র-পরিচিতি, ব্যাবসাবাণিজ্য, সাহিত্য সমালােচনা ইত্যাদি নানা বিষয় এই পত্রিকার পাতায় স্থান পেত।
- পত্রিকাটিতে বিভিন্ন ধরনের ছবি ছাপা হত। এটি ছিল। বাংলার প্রথম সচিত্র পত্রিকা।
- মধুসূদন দত্তের ‘তিলােত্তমাসম্ভব কাব্য’-এর প্রথম সর্গ এই পত্রিকাতেই প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই পত্রি জিস্ব কোনাে ছাপাখানা ছিল না এবং এর প্রকাশ ছিল বেশ অনিয়মিত। রাজেন্দ্রলাল মিত্রের পর কিছুদিন এই পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ।
বাংলা সংবাদ ও সাময়িকপত্রের ইতিহাসে পরিচয় পত্রিকার গুরুত্ব আলােচনা করাে
বাংলা সাহিত্যে মার্কসবাদী আদর্শ প্রচার নিয়ে সচেতনভাবে প্রথমে ‘পরিচয় পত্রিকার যাত্রা শুরু হয়েছিল। পাশাপাশি বিশুদ্ধ সাহিত্য সৃষ্টির ব্যাপারটিকেও এই পত্রিকা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছিল।
১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সম্পাদনায় পরিচয়’ পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয়। এটি ছিল একটি মাসিক পত্রিকা। মােট বারাে বছর এই পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের নাম পাওয়া যায়। এই পত্রিকার কয়েকটি উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য হল-
- ‘পরিচয়’ পত্রিকা প্রকাশিত হলে বাংলা সাহিত্যে একটি নবযুগের সূচনা হয়। সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা ছিল এই পত্রিকার অন্যতম উদ্দেশ্য।
- এই পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাগুলিতে দেখা যায় প্রগতিশীল সমাজ ও সাহিত্যচিন্তার প্রকাশ।
- গােষ্ঠীদ্বন্দ্ব থেকে এই পত্রিকা ছিল একেবারেই মুক্ত।
- পরিচয়-এর প্রথম সংখ্যার পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ১৪৫।
- শােষক ও শােষিতের বিষয়টিকে পরিচয় পত্রিকা প্রথম বুদ্ধিজীবী সমাজের কাছে স্পষ্টরূপ তুলে ধরেছিল।
নীরেন্দ্রনাথ রায়, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখােপাধ্যায়, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, দিলীপকুমার রায়, সমর সেন, অন্নদাশঙ্কর রায়, সমরেশ বসু, প্রবােধচন্দ্র বাগচি, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ এই পত্রিকায় প্রায় নিয়মিত লিখতেন।
‘সবুজপত্র’ পত্রিকার গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য আলােচনা করাে
১৩২১ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে, অর্থাৎ ইংরেজি ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় বাংলা সাময়িকপত্রের ইতিহাসে আলােড়নকারী একটি সাহিত্য পত্রিকা সবুজপত্র। পত্রিকা- সম্পাদক প্রমথ চৌধুরী প্রথম সংখ্যার মুখপত্রে পত্রিকা প্রকাশের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘বাঙালির মন যাতে বেশি ঘুমিয়ে না পড়ে’, তার জন্যই তার এই পত্রিকা প্রকাশ। এই পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
- সাধুভাষার পরিবর্তে চলিত ভাষাকে সাহিত্যিক ভাষার মর্যাদা দান।
- যৌবনের বন্দনা করা, সর্বপ্রকার কৃত্রিমতা ও জড়তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করে মানুষের মনকে ঝাকিয়ে দেওয়া।
- ভাবালুতা বর্জন করে ঋজু বাংলা গদ্য রচনায় নবীন লেখকদের উৎসাহ দান করা।
- এই পত্রিকা বাংলাভাষায় একটা স্বচ্ছেন্দতার দিক দেখাতে পেরেছিল। উইট, এপিগ্রাম, উপমা, রূপকের ব্যবহারে বাগবৈদগ্ধ্য সৃষ্টি এবং ভাষার সৌকর্য বৃদ্ধি ছিল এই পত্রিকার লেখকদের অন্যতম উদ্দেশ্য।
এই পত্রিকাকে কেন্দ্র করে একটি শক্তিশালী লেখকগােষ্ঠী গড়ে উঠেছিল। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখােপাধ্যায়, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। রবীন্দ্রনাথের ‘সবুজের অভিযান’ কবিতা, ‘অপরিচিত’, ‘হৈমন্তী গল্প’, ‘ঘরে বাইরে’, ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাস, বাতায়নিকের পত্র প্রবন্ধ, অতুলচন্দ্র গুপ্তের ‘কাব্যজিজ্ঞাসা’ এই পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যে ‘কল্লোল’ পত্রিকার গুরুত্ব আলােচনা করাে
বাংলা কবিতায় বাস্তববাদী চেতনা নিয়ে নতুন কাব্যভাবনা শুরু করেছিল ‘কল্লোল’ পত্রিকা।
১৩৩০ বঙ্গাব্দের ১ বৈশাখ, গােকুলচন্দ্র নাগ ও কবি দীনেশরঞ্জন দাশের যুগ্ম-সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় মাসিক পত্রিকা কল্লোল। এই পত্রিকা প্রকাশের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যগুলি হল-
- বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার আমদানি করে তাকে সাবালক করে তােলা।
- বিদেশী ভাব-ভাবনাকে দেশীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে নতুন ঘরানার সাহিত্য রচনা করা।
- সাহিত্যের মধ্য দিয়ে সমস্তরকম বাধাবন্ধের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করা।
- রবীন্দ্রনাথের রােমান্টিক আদর্শের তীব্র বিরােধিতা করাই এদের লক্ষ্য ছিল।
- পাশ্চাত্য কবি টি.এস.এলিয়ট এবং তার দি ওয়েস্ট ল্যান্ড কাব্যভাবনার দ্বারা এই পত্রিকাগােষ্ঠীর লেখকরা প্রভূত পরিমাণে প্রভাবিত হয়েছিলেন।
কল্লোল পত্রিকাকে কেন্দ্র করে একটি শক্তিশালী লেখকগােষ্ঠী গড়ে উঠেছিল, যাঁদের বেশিরভাগই ছিলেন রবীন্দ্র ভাবাদর্শের বাইরে। এঁদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, মােহিতলাল মজুমদার, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, নজরুল ইসলাম, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, মনীশ ঘটক (যুবনাশ্ব ছদ্মনাম), প্রবােধকুমার সান্যাল, অজিত কুমার দত্ত প্রমুখ। বুদ্ধদেব বসুর বন্দীর বন্দনা, নরেন্দ্র দেবের যাদুঘর’, প্রেমেন্দ্র মিত্রের প্রথমা’, জীবনানন্দ দাশের ঝরা পালক এই পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়।