ভূমিকা
আজাদ হিন্দ সিনার দিল্লী পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি ঠিকই, কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে আজাদ হিন্দ বাহিনীর অবদান ভারতের ইতিহাসে পাতায় চিরকাল সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। আজাদ হিন্দ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু তার শেষ নির্দেশ নামায় ঘোষণা করেছিলেন -পৃথিবীতে এমন কোন শক্তি নেই যা ভারতকে প্রধানত করে রাখতে পারে। ভারত স্বাধীন হবে এবং তা হবে অনতি কালের মধ্যে।
আজাদ হিন্দ বাহিনীর প্রেক্ষিতে সুভাষচন্দ্রের অবদান
১. সুভাষচন্দ্রের দেশে ত্যাগ
সুভাষচন্দ্র বসু দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, শান্তিপূর্ণ আলাপ আলোচনার মধ্যে ইংরেজরা কোনদিনই ভারতকে স্বাধীনতা দেবে না। তাই তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ১৯৩৯-১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের সময় বৈদেশিক শক্তির সহায়তা ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এজন্য যুদ্ধ শুরু হলে ভারত রক্ষা আইনের গ্রেফতার করে 1940 খ্রিস্টাব্দের দুই জুলাই পরে সুভাষচন্দ্র কে কলকাতার এলগিন রোডে তা নিজেদের ঘরের অন্তরীন রাখা হয় ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে ৫ ডিসেম্বর। ব্রিটিশের করা প্রহরে এড়িয়ে ভাইপো শিশির বসুর সাহায্যে মোহাম্মদ জিয়া উদ্দিন এর ছদ্মবেশে সুভাষচন্দ্র দেশত্যাগের জন্য বেরিয়ে পড়েন। ডক্টর অমলেশ ত্রিপাঠি লিখেছেন -“রবীন্দ্রনাথ যাকে দেশনায়ক বলে বরণ করেছিলেন, ভাগ্যের পরিহাসে তাকে দেশ ত্যাগ করতে হলো।”
২. বিদেশের সাহায্য লাভের প্রচেষ্টা
(১) রাশিয়ায় : সুভাষচন্দ্র সিনর অরল্যান্ডো ম্যাৎসোটা ছদ্মবেশ নিয়ে কাবল থেকে বার্লিন যাওয়ার পথে মস্কোতে কিছুদিন অবস্থান করেন। মস্কোয় তিনি রুশো নেতাদের কাছে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য সাহায্য প্রার্থনা করে। কিন্তু এসব রাষ্ট্রপ্রধান স্টালিনের কাজ থেকে কোনরকম সহযোগিতার আশ্বাস পাইনি। আসলে এ সময় দৃশ্য রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে স্টালিন সম্ভাব্য জার্মান আক্রমণ প্রতিরোধে লক্ষে ব্রিটেন মিত্রতা গড়ে তোলায় অধিক আগ্রহী ছিলেন। INA (Indian National Army) রং প্রকাশনা ও প্রচার সচিব এস. এ. আয়র বলেছেন- কাবুল থেকে বার্লিনের পথে মস্কোয় অবস্থানকালে যদি রাশিয়া তাকে কিছুটা আশ্বাস দিত, তবে তিনি কর্মক্ষেত্রে হিসেবে মস্কোকেই বেছে নিতেন।
(৩) জার্মানিতে :; সুভাষচন্দ্র এর পর বিমান যোগে জার্মানির বার্লিন এসে পৌঁছায় ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে ২৮ মার্চ।। বারিনি তিনি গিরিজা মুখার্জি, এম. আর. ব্যাস ও এ. সি. এন. নাম্বিয়ার সহ কজন ভারতীয় কে নিয়ে গড়ে তোলেন ‘free India centre’ । পরবর্তী কিছু দিনের মধ্যেই তিনি ইউরোপ ও উত্তর আফ্রিকায় ভারতীয় যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে গঠন করেন ‘Indian Legion’ বা ‘Free India Army ‘ ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে। সুভাষচন্দ্র হিটলারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিবেনট্রপ এর সঙ্গে দেখা করেন ও ভারতীয় মুক্তিযুদ্ধের বিষয়কে এক পরিকল্পনায় পেশ করেন। স্থির হয় –
(i) বার্লিন থেকে তিনি ব্রিটিশ বিরোধী প্রচার চালাবেন।
(ii) জার্মানিতে বন্দি ভারতীয় সেনাদের নিয়ে স্বাধীন ভারতীয় সংঘ গড়ে তুলবেন।
(iii) জার্মানি ভারতের স্বাধীনতা কে স্বীকৃতি জানাবেন।
(iv) আফগানিস্তানকে ভারতীয় ইউরোপের মধ্যেকার যোগসূত্রের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হবে। জার্মান সরকার সুভাষচন্দ্রের পরিকল্পনার অন্যান্য সূত্র গুলি মেনে নিলেও ভারতের স্বাধীনতা সম্পর্কিত বিষয়ে কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে রাজি হয়নি।
(৩) জাপানে : ইতিমধ্যে এসে সম্পর্কে জাপানের রণীতির বদল ঘটে। প্রাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের কমল থেকে ভারতসহ এশিয়ার মুক্তি সংগ্রামে জাপান সাহায্যের নীতি গ্রহণ করে। এতে উৎসাহিত হয়ে সুভাষচন্দ্র জাপানের সাহায্যে মুক্তি সংগ্রামের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। সুভাষচন্দ্র জাপানের প্রধানমন্ত্রী মার্শাল তোজোর আমন্ত্রণে জাপান যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
(i) অনুপ্রবেশ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জার্মানি থেকে সমুদ্রপথে সাবমেরিনে করে জাপানে আশা ছিল অত্যন্ত বিপদ সংকুল। তবুও সুভাষচন্দ্র জীবনে ঝুঁকি নিয়ে দুঃখ সাহসিক সারমেরিন অভিযানে প্রায় কয়েক হাজার মাইল পথ অতিক্রম করে জাপানের টোকিওতে এসে পৌঁছান ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে ১৩ জুন। সেখানে তিনি প্রধানমন্ত্রী তোজোর সঙ্গে দেখা করলে জাপানি পার্লামেন্ট ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সর্বত্রভাবে সহায়তাধানে নীতি ঘোষণা করে। শুরু হয় সুভাষের স্বপ্নের অভিযান।
(ii) আই. এন. এ. -এর নেতৃত্ব গ্রহণ : ভারতের বিপ্লবীদের জনক রাসবিহারী বসু লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্ত হওয়ার পর পুলিশে চোখে ধুলো দিয়ে সুবাসের অনেক আগে জাপানে চলে এসেছিলেন। সেখানে তিনি এক মুক্তিবাহিনী গঠনের উদ্যোগ নেন। ব্যাংকক শহরে এক সম্মেলন ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ১৫ই জুন রাসবিহারী সভাপতি তে গড়ে ওঠে ভারতীয় স্বাধীনতা সংঘ বা ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগ। এরপর ক্যাপ্টেন মোহন সিং এর সক্রিয় সহযোগিতায় ২৫ হাজার ভারতীয় সেনা পরে বেড়ে হয় ৪০ হাজার নিয়ে ভারতীয় জাতীয় বাহিনী বা আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠিত হয়। সুভাষচন্দ্র জাপানি এলে রাসবিহারী বসুর সুভাষকে ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগের দায়িত্ব গ্রহণের আহ্বান জানান। সুভাষচন্দ্র সেই ডাকে সাড়া দিয়ে সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভা হ্রাসবিহারি বসুর হাত থেকে নেতৃত্ব গ্রহণ করেন ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে ২৫ আগস্ট।
(iii) আই. এন. এ. -এর পূর্ণ গঠন : আজাদ হিন্দ বাহিনী নেতৃত্ব গ্রহণ করার পর সুভাষচন্দ্র একে নতুন করে সাজিয়ে তোলেন। আজাদ হিন্দ বাহিনীকে তিনি গান্ধী ব্রিগেড, আজাদ ব্রিগেড, নেহেরু ব্রিগেড প্রভৃতি ব্রিগেডে ভাগ করেন। বালক, বালিকাদের নিয়ে বাল সেনাদল এবং নারীদের নিয়ে ঝাঁসির রানী ব্রিগেড গঠিত হয়। প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত অনুগামীদের অনুরোধে নেতাজি নিজের নামে সুভাষ ব্রিগেড গঠন করেন অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এই বাহিনীর সদস্য সংখ্যা হয় ৫০০০০। এখানে জাতি ধর্ম প্রাদেশিকতার মধ্যে সংকীর্ণতা স্থান ছিল না।
(iv) আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠা : ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে ২১ অক্টোবর নেতাজি আজাদ হিন্দ সরকার গঠন করার কথা ঘোষণা করে। এই সরকারের বিভিন্ন পদগুলিতে ছিলেন – (a) আজাদ হিন্দ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক, সমর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুভাষচন্দ্র বসু। (b) মহিলা সংঘ- ক্যাপ্টেন শ্রীমতি লক্ষ্মী স্বামীনাথন। (c) প্রকাশনা ও প্রচার- এস. এ. আয়ার। (d) অর্থ- লে. কর্নেল এ. সি. চ্যাটার্জি। (e) সচিব – এ. এস. সহায়। (f) সর্বোচ্চ উপদেষ্টা -রাসবিহারী বসো। (g) আইন উপদেষ্টা- এ. এন. সরকার।
(v) সরকারের লক্ষ্য : নেতাজি ঘোষণা করেনা আজাদ হিন্দ সরকারের প্রধান লক্ষ্য হলো ভারত থেকে ব্রিটিশ শাসনের উৎপাত করা। এই সরকারের রাষ্ট্রভাষা ছিল হিন্দুস্থানী হিন্দি ও উর্দুর মিশ্রণ। জাতীয় পতাকার ছিল কংগ্রেসের তেরেঙ্গা কতকার মাঝে উল্লম্ফনকারি বাঘের ছবি। জাতীয় সংগীত ছিল রবীন্দ্রনাথের জনগণমন এবং জয় হিন্দ হল পরস্পরের প্রতি সম্ভাষণ বাক্য।
স্বাধীন আজাদ হিন্দ সরকার কে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন থাইল্যান্ড, ইতালি, জার্মানি, জাপান, ক্রোয়েশিয়া, বার্মা, কুয়োমিন তাং-চিন, ফিলিপিসন, মাঞ্চুরিয়া প্রভৃতি মিশে নয়টি দেশ। আজাদ হিন্দ বাহিনী তাদের সংগ্রামের কথা প্রকাশ করবার জন্য সিঙ্গাপুর, রেঙ্গুন, ব্যাংকক থেকে বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় বেতার প্রচার শুরু করে এবং বিভিন্ন ভারতীয় ভাষা কয়টি দৈনন্দিন ও সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী তোজো ৬ নভেম্বর ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে আন্দামানে ও নিকোবরণ দ্বীপপুঞ্জ দুটি আজাদ হিন্দ সরকারের হাতে তুলে দেন। নেতাজি ৩১ ডিসেম্বর ওই দ্বীপের নাম দেন – ‘শহীদ ও স্বরাজ’। এরপর আজাদ হিন্দ সরকার ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।
৩. ভারত অভিযান
২৩ অক্টোবর ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে আজাদ হিন্দ সরকার খাদ্য স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে বৃটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। নেতাজি রেঙ্গুনি তার প্রধান সামরিক দপ্তর করে তোলেন ও শুরু করেন তার বহু কাঙ্খিত ভারত অভিযান। বির আজাদ হিন্দ সেনার তাইপোং থেকে যাত্রা শুরু করে পাহাড়, পর্বত নদীর টপকে প্রায় ৪০০ মাইল পথ পায়ে হেঁটে ভারতের সীমান্তের দিকে পাড়ি দেন। কক্রবাজার থেকে ৫০ মাইল দূরে মৌডক নামক স্থানে ব্রিটিশ ঘাঁটি লক্ষ্য করে আক্রমণ চালায় আজাদ হীন সেনার। ক্যাপ্টেন সুরজ মলের নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ সেনার মৌডক জয় করে। অবশেষে কোহিমা পর্যন্ত এসে ভারতের মাটিতে তেরেঙ্গা জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে ৬ এপ্রিল ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দ।
৪. আত্মসমর্পণ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রণাঙ্গনের মিত্রশক্তির কাছে অক্ষশক্তির পরাজয় ঘটতে থাকলে যাপান সাহায্যের হাত গুটিয়ে নেয়। আমেরিকা বিলুপ্ত শক্তি নিয়ে জাপানের দিকে এগিয়ে এলে কোন ভাষা জাপানি সেনা ও বিমান বাহিনীর রক্ষার্থে প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে রওনা হয়। জাপানের প্রত্যাবর্তন ও সামরিক বিপর্যয় আজাদহীন সেনাদের মনবল ভেঙে যায়। খাদ্য ও অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়াই ভারতীয় বাহিনীকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও কোহিমা ছেড়ে প্রবল বর্ষণ ও এক হাটু কাঁদার মধ্যে দিয়ে কয়েক শত মাইল পিছিয়ে যেতে হয়। অবশেষে জাপান মিত্রশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করলে আগস্ট ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে জাপানি দ্বারা অস্ত্র ও খাদ্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়।
খাদ্যা ভাব, প্রবল শীত, ম্যালেরিয়া, পার্বত্য অঞ্চলে বিষাক্ত পোকামাকড়ীর কামড় প্রকৃতি কারণে কয়েক হাজার আঘাত হিন্দ বাহিনীর সেনার মৃত্যু হয়। বলে আজাদ হিন্দ সেনা অস্ত্র ত্যাগ করতে বাধ্য হন। এই ঘটনায় ভেঙে না পড়ে দুচোখে নতুন স্বপ্ন নিয়ে বার্মা বর্তমানে মায়ানামার থেকে সায়গণ-এ পৌঁছন। সীমাহীন আশীর্বাদ নেতাজি বলেন,”আমরা অন্ধকারতম মুহূর্ত অতিক্রম করেছি, সূর্যোদয়ের আর দেরি নেই, ভারত স্বাধীন হইবে।” বলা হয় যে, ফরমোজার কাছে তাই হওকউতএ এক বিমান দুর্ঘটনায় 1945 খ্রিস্টাব্দে ১৮ ই আগস্ট তার মৃত্যু হয়- যদিও এই ঘটনা সত্যতা আজও সংশয়াতীত নয়।
উপসংহার
নেতাজি চরম আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে ভারতবাসী স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিলেন। তাই গান্ধীজীর আজাদ হিন্দ বাহিনী মূল্যায়নের বলেছিলেন যদিও আজাদ হিন্দ ফৌজ তাদের আশু লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারেনি, তবুও তারা এমন অনেক কিছু করেছে, যেই জন্য তারা গর্ববোধ করতে পারে। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ২৩ জানুয়ারি তিনি সুভাষচন্দ্র কে প্রথম ভারতীয় ও শেষ ভারতীয় বলে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “আজাদ হিন্দ ফৌজ আমাদের সম্মোহিত করেছে। নেতাজির নাম আমাদের জাদু মুগ্ধ করে। তার লক্ষ্য ছিল উচ্চ, কিন্তু তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। কে ব্যর্থ হয়নি?”