চিনে বিদেশি বাণিজ্যের সমস্যা
একদা চেন ছিল সুখ প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি। গর্বিত চীন রা নিজেদের দেশকে স্বর্গীয় দেশ এবং চীন সম্রাটকে স্বর্গের সন্তান বলে মনে করত। উনবিংশ শতকের সূচনা রাজবংশ- শাসিত চীন ছিল সর্বাধিক থেকে পিছিয়ে পড়া একটি দেশ। আধুনিক যুগের শুরুতে সামন্ততান্ত্রিক চীনের রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি, শিল্প, বিজ্ঞান, কারিগরি জ্ঞান, সামরিক বাহিনী সবকিছুই ছিল পাশ্চাত্যপদ। চীনের জনসংখ্যায় ৪/৫ অংশই কৃষি কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এরুপ পরিস্থিতিতেও চীনরা বহির বিশ্ব থেকে নিজেদের সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রাখতে চাইতো। গর্বিত চীনরা মনে করতো যে বিদেশীরা হলো বর্বর এবং বিদেশীদের কাছ থেকে তাদের কিছু শেখার বা গ্রহণ করার নেই। এইজন্য চিনি বিদেশি বাণিজ্যে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হতো, যেমন-
১. বিদেশি বাণিজ্যের নিষেধাজ্ঞা
চীনাদের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিজের দেশেই পাওয়া যেত বলে তা বিদেশ থেকে আনতে হতো না।। বিদেশি বিলাসবহুল পণ্যের প্রতি ও চীনদের বিশেষ আগ্রহ ছিল না। এজন্য চীনের সাধারণ মানুষ ও সরকার চিনে বিদেশীদের আগমন ও বাণিজ্যের অধিকার দেওয়ার তীব্র বিরোধী ছিল। চীনের মাঞ্চু শাসকগণা ১৬৫৬, ১৬৬২ ও ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে বৃথা ঘোষণার মাধ্যমে চীনদের বৈদেশিক বাণিজ্যের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করে জানান যে, সম্রাটের বিশেষ অনুমতি ছাড়া কোন ইউরোপীয় চীনে প্রবেশ করতে পারতো না।
২. নজরানা পদ্ধতি
চিনে বাণিজ্য অধিকার পাওয়ার উদ্দেশ্যে কোন বিদেশি দুধ চীনে সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হলে তাকে বশ্যতা নির্দেশন সড়ক দুটি অপমানজনক কাজ করতে বাধ্য করা হতো –
(১) চীন সম্রাট কে নজরানা বা উপঢৌকন দিতে এবং
(২) কাও তাও প্রথা অনুসারে সম্রাটের সামনে তাকে ভুমি পর্যন্ত নত হতে হত।
৩. বল প্রয়োগ
ইউরোপীয় বণিক দের কাছে চীনের মূল্যবান সাদা রেশম, সবুজ চা ও অন্যান্য খনিজ পদার্থের বিপুল চাহিদা ছিল। কিন্তু বিদেশীরা নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে চীনের বাণিজ্য করার অনুমতি পেত না। তাই সহজ পথে চীনে প্রঘবেশ বাণিজ্য করার সুযোগ না পেয়ে সুযোগ আদায় করতে বিদেশী বণিকরা পরবর্তীকালে চীনের ওপর বল প্রয়োগ ও সামরিক অভিযান চালায়। এর দ্বারা তারা চীনের বিভিন্ন অংশে নিজেদের প্রভাবধীন অঞ্চল গড়ে তোলে। চীনের ওপরে বিভিন্ন অসম চুক্তি চাপিয়ে দিয়ে বিদেশি শক্তিগুলো চীনের কাছ থেকে নানা বাণিজ্যিক সুবিধা আদায় করে নেয়।
চীনের বিদেশি পুঁজির অনুপ্রবেশ
চীনে বিদেশি বণিকের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন বিদেশী রাষ্ট্র চীনে বাণিজ্যের মাধ্যমে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালায়। ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে পর্তুগালের রাফেয়েল পেরট্রোল ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথম চীনে বাণিজ্য করতে আসেন। এরপর অবশ্য অষ্টতার শতকের শেষ ভাগ থেকে একে একে বিভিন্ন ইউরোপীয় বণিক জাতি চীন প্রবেশ করতে থাকে। চীনে বিদেশীদের পুঁজির অনুপ্রবেশ প্রেক্ষাপট ছিল নিম্নরূপ-
১. মাঞ্চু শাসকদের অপশাসন
অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগে চিনের মাঞ্চু রাজবংশের অপশাসন, দুর্নীতি ও সামরিক দুর্বলতা অত্যন্ত প্রকাশ হয়ে ওঠে। ধনী অভিজাত ও ভূত স্বামীদের হাতে দেশে যাবতীয় সম্পদ কেন্দ্রীভূত হলে দরিদ্র কৃষকের অবস্থা করুন হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে অত্যাচারী মাঞ্চু শাসকদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন গুপ্ত সমিতি গড়ে ওঠে। শ্বেতপদ নামে গুপ্ত সমিতির উদ্যোগ চীনে প্রায় ৯ বছর ধরে কৃষক বিদ্রোহ চলে। চীনের বিভিন্ন স্থানে আরো চীনের বিভিন্ন স্থানে আরো ছড়িয়ে পড়ে।
২. পাশ্চাত্যের সঙ্গে যোগাযোগ
ষোড়শ শতক থেকে এশিয়া বিভিন্ন দেশে বাণিজ্য করতে আসা ইউরোপীয় বণিকের সঙ্গে চীনদের যোগাযোগ গড়ে ওঠে। ১৫১৪ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগালের মাধ্যমে চীনের সঙ্গে ইউরোপের বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এরপর একে একে স্পেনীয় ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে, ওলন্দাজ ১৬০৪ খ্রিস্টাব্দে, ইংরেজ ১৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে, ফরাসি ১৬৯৮ খ্রিস্টাব্দে, দিনেমার ১৭৩১ খ্রিস্টাব্দে, আমেরিকান ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে, প্রভৃতি যাতে চীন বাণিজ্য করতে আসে। সপ্তদশ শতকে ব্রিটিশ ওলন্দাজ বণিকের আধিপত্য বাড়লে চীন পর্তুগিজদের আধিপত্য হ্রাস পেতে থাকে।
৩. অনুপ্রবেশের পর্যায়ে
চীনে বিদেশি বণিকদের অনুপ্রবেশ তিনটি প্রধান পর্যায়ে লক্ষ্য করা যায়, যথা –
(১) প্রথম পর্যায় : অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দের প্রথম ইঙ্গ চীন যুদ্ধ বা প্রথম আফিম যুদ্ধ পর্যন্ত চীনে বিদেশি অনুপ্রবেশের প্রথম পর্যায়।
(২) দ্বিতীয় পর্যায় : ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে নানাকিং চুক্তি থেকে উনবি শতকে শেষ ভাগ পর্যন্ত চীনের বিদেশি অনুপ্রবেশ দ্বিতীয় পর্যায়ে।
(৩) তৃতীয় পর্যায় : উনবি শতকের শেষ থেকে ১৯৩০ এর দশক পর্যন্ত চীনে বিদেশি অনুপ্রবেশের তৃতীয় পর্যায়।
৪. আধা-উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা
ইংল্যান্ডের চীনের অপর নানকিং এর সন্ধি ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে আরোপ করার পর থেকে রুদ্ধচীন বিদেশীদের আধিপত্যের প্রসার চীন সরকার প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়। চিনে দুর্বল মাঞ্চু সম্রাট সিংহাসনের ক্ষমতাসীন থাকলেও সমাজতান্ত্রিক চীন ক্রমে আধা ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। চীন বিদেশীদের আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ ক্রমাগত বাড়াতে থাকে।