সূচনা : দেওয়ানী লাভের (১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দ) ফর ইংরেজরা ধীরে ধীরে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে নিজেদের রাজনৈতিক কৃতিত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে শুরু করে। তৎকালীন ভারতবর্ষের সমাজব্যবস্থা ও ভারতবাসীর জীবনযাত্রার বিভিন্ন দিকগুলি সম্পর্কে ধারণা লাভ করা ইংরেজদের কাছে জরুরি হয়ে ওঠে। পাশাপাশি ইংরেজি শক্তি শাসক হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর উন্নততর শাসন, আই নো ভুমি বন্দোবস্ত প্রবর্তনের ভারত ইতিহাস চর্চা শুরু করে। ওয়ারেন হোস্টিংসের আমলে থেকে শুরু হয় দেশের ইংরেজদের ভারতীয় ইতিহাস চর্চা।
ঔপনিবেশিক ইতিহাস নির্মাণ বা চর্চা
১. বিভিন্ন রূপ
(১) প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা ভিত্তিক : ঔপনিবেশিক শাসন গড়ার দিকে ভারতে নিয়োজিত ব্রিটিশ প্রশাসন ও উচ্চপদস্থ কর্মচারীগণ ভারত ইতিহাস চর্চা শুরু করেন। ওয়াটস, বোল্টস, স্ক্র্যাফটন, ওরমে ভেরেলস্ট ও শোর নিজেদের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে ভারত ইতিহাস লেখেন। এরা কেউই পেশাদারী ঐতিহাসিক ছিলেন না, ছিলেন প্রশাসক ঐতিহাসিক। এর কেউই এদেশীয় পাঠকদের জন্য নয়, মূলত ইউরোপীয়দের কথা মনে রেখেই ভারত ইতিহাস লেখেন এবং তাদের লেখা মূলত ভারতের পশ্চাৎপদ, অনুন্নত, কুসংস্কার গ্রস্ত সমাজ সভ্যতার দিকটি তুলে ধরেন। তথাপি এদের লেখা চিঠিপত্র সংবলিত ইতিহাস চর্চা ভারত ইতিহাসের উপাদান হিসেবে যথেষ্ট মূল্যবান।
(২) মানবতাবাদী ভাবনাভিত্তিক : মানবতাবাদী ভাবনায় প্রভাবিত হয়ে বেশ কয়েকজন ভারত ইতিহাস নির্মাণ বা চর্চায় মনোনিবেশ করেন। উইলিয়াম জোন্স, উইলসনের মতো মতবাদী পন্ডিতগণ তাদের লেখার মধ্যে দিয়ে প্রাচীন হিন্দু সভ্যতার সরবমোচন করেন। এরা সকলেই প্রাচীন হিন্দু সভ্যতা সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন। বিশেষত উইলিয়াম জোন্সের ভারতীয় সভ্যতার ধারণা ইউরোপীয়দের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণায় আঘাত দেয়।
(৩) সম্প্রদায়িক ভাবনাভিত্তিক : সাম্প্রদায়িক ভাবনায় প্রভাবিত হয়েছে জেমস মিল তিন খন্ডে বিভক্ত ‘হিস্ট্রি অফ ব্রিটিশ ইন্ডিয়া’নামে ভারতের ইতিহাস রচনা করেন। এটিই ছিল ভারত প্রসঙ্গে লিখিত পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস। এই গ্রন্থে মিলে সম্প্রদায়িক ভিত্তিতে ভারত ইতিহাস কালকে হিন্দু যুগ, মুসলিম যুগ ও ব্রিটিশ যুগ এই তিন পর্বে ভাগ করেন। তিনি ভারতীয়দের রাজনৈতিক মূল্যবোধহীন, নিকৃষ্ট ও বর্বর এক জাতি হিসেবে বর্ণনা করেন। এইচ. এইচ. উইলসন বিস্তারিত পাদটীকা-সহ মিল-এর এই গ্রন্থে একটি সংরক্ষণ প্রকাশ করেন এবং এই গ্রন্থের বিষয়বস্তু ১৮০৫ থেকে ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দের পর্যন্ত প্রসারিত করেন। এছাড়া আলেকজান্ডার গাও, বিশপ হেবার প্রমো ব্রিটিশ লেখকগণ ভারতে হিন্দু মুসলিম সভ্যতা কে পৃথক হিসেবে তুলে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা চালান।
(৪) ধর্মভিত্তিক : কোলব্রুক, বার্নুফ, ম্যাক্স মুলার প্রমক প্রাচীন ভারতীয় ধর্মগ্রন্থ গুলির ভিত্তিতে তাদের ভালো ইতিহাস চর্চাকে এগিয়ে নিয়ে যান। কোলব্রুক তার লেখার মধ্য দিয়ে প্রাচীনতম হিন্দি গ্রন্থ বেদের সঙ্গে ইউরোপীয়দের পরিচয় করিয়ে দেন। বার্নুফ ঋগ্বেদ ও জেন্দ আবেস্তার মধ্যে মিল গুলি উল্লেখ করেন ও আর্য জাতি ইতিহাসের সংস্কৃতি গুরুত্ব গুলি বর্ণনা করেন। ম্যাক্স মুলার সিক্রেট বুক অফ দা হিস্ট্রি গ্রন্থ রচনা দ্বারা সংস্কৃত সহ অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় লেখা ধর্ম নির্ভর সাহিত্য গুলি সঙ্গে ইউরোপীয়দের পরিচয় করান।
(৫) সাম্রাজ্যবাদ কেন্দ্রিক : উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের স্থায়িত্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে অনেক ইতিহাস রচনার কাজে হাত দেন। আনফ্রেড লয়াল, হেনরি জেইন, উইলিয়াম হান্টার প্রমুখ ভারতের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের স্বপক্ষে মত প্রকাশ করেন। তারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গৌরবোজ্জ্বল দিকগুলির ওপর আলোকপাত করেন। এক্ষেত্রে তারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দোষ ত্রুটিগুলি এড়িয়ে যান। তারা ওয়ারেন হোস্টিং এর সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকার প্রশংসা করেন
২. নানা উদ্যোগ
(১) এশিয়াটিক সোসাইটি : ওয়ারেন হোস্টিং এর সহযোগিতায় উইলিয়াম জোন্স কলকাতায় ‘এশিয়াটিকে সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা করেন। মূলত প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ইতিহাস ও সাহিত্যের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনের লক্ষ্যেই এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে ভারতের ইতিহাস সম্পর্কে গবেষণা শুরু হয় এবং বেশ কিছু গবেষণামূলক পত্রিকা ও প্রকাশিত হয়। পাশাপাশি এটির উদ্যোগের সংস্কৃত সহ ভারতীয় ভাষায় লেখা বেশ কিছু প্রাচীন গ্রন্থ ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করা হয়।
(২) খ্রিষ্টান মিশন নারীদের উদ্যোগ ও কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ কলেজ : ইউরোপ থেকে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারে লক্ষ্য নিয়ে বেশ কিছু খ্রিস্টান মিশনারী ভারতে আসেন। তারা খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারের পাশাপাশি ভারতের বিভিন্ন ভাষা ও ইতিহাস চর্চায় হাত দেন। শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন অফ ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতদের প্রচেষ্টায় বেশ কিছু সাহিত্য ধর্মী ইতিহাস রচিত হয়। উইলিয়াম কেরি রচনা করেন ‘ইতিহাসমালা’, রাম রাম বসু রচনা করেন ‘রাজা প্রতাপাদিত্য রচিত’, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার রচনা করেন ‘রাজাবলি’, তারিনী চরণ মিত্র রচনা করেন ‘ওরিয়েন্টাল ফেবুলিস্ট’ প্রভৃতি গ্রন্থ।
৩. উল্লেখযোগ্য ইতিহাস
(১) উনিশ শতকের ইতিহাস কীর্তি : জেমস মিলের লেখা ‘হিস্ট্রি অফ ব্রিটিশ ইন্ডিয়া’ , ম্যাক্স মুলারে লেখা ‘সিক্রেট বুকস অফ দা ইস্ট’ গ্রন্থ গুলি ছাড়াও আরো অসংখ্য ইতিহাস ধর্মী গ্রন্থে এই ইতিহাস সৃষ্টি হলো মেকনের লেখা ‘পলিটিক্যাল হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া’, গ্রান্ড ডাফ এর লেখা ‘হিস্ট্রি অফ দা মারাঠাস ‘, এলিফিনস্টোনের লেখা ‘দ্য হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া’, উইলিয়াম হান্টারের লেখা ‘অ্যানালস অফ রুরাল বেঙ্গল’, ম্যালেসনের লেখা ‘দ্যা ডিসিসিভ ব্যাটেলস অফ ইন্ডিয়া’ প্রভৃতি গ্রন্থ।
(২) বিংশ শতকের ইতিহাস কীর্তি : বিশ শতকে ভারতের ওপর লেখা কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল ভিনসেন্ট স্মিথ রচিত ‘ আর্লি হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া’ এবং ‘অক্সপোর্ট হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া’ (১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ), পি. ই. রবার্টস রচিত ‘ হিস্ট্রি অফ ব্রিটিশ ইন্ডিয়া টু দা এন্ড অফ দ্য হিস্ট্রি ইন্ডিয়া কোম্পানি’ (১৯২১ খ্রিস্টাব্দ), ডডওয়েল রচিত ‘কেমব্রিজ হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া’ (১৯২৯ খ্রিস্টাব্দ) ,কিথ রচিত ‘ কনস্টিটিউশনাল হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া’ (১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ) প্রভৃতি।
উপসংহার
অষ্টাদশ শতকে ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরা পুরাতন বাণিজ্যিক ধারণা ত্যাগ করে সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব উদ্বুদ্ধ হয়ে ইতিহাস রচনা শুরু করেন। উনিশ শতকের ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরা অনেক নিরপেক্ষ বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাদের লেখাকে এগিয়ে নিয়ে যান। তারও পরবর্তীকালে ২০ শতকে ব্রিটিশ ঐতিহাসিকগণ ইউরোপে উদারনৈতিক মতবাদ এর দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং অনেকটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে ইতিহাস সৃষ্টি মনোনিবেশ করেন। আর. জি. কলিংউডের মতো অনুযায়ী বলা যায় যে, এই সময় ইংরেজ ঐতিহাসিকরা দলিল দস্তা বেজের উপর নির্ভর করে তাদের ঔপনিবেশিক ইতিহাস নির্বাচন করেন।