সনেটের সংজ্ঞা ও নির্মাণ রীতির আলোচনা করে বাংলা সনেটের স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্যের পরিচয় দাও।

বাংলা সনেটের প্রবাদ পুরুষ প্রমথ চৌধুরী একদা সনেট সম্পর্কে বলেছিলেন :

“ভালোবাসি সনেটের কঠিন বন্ধন 

শিল্পী যাহে মুক্তি লভে অপরে ক্রন্দন।”

গীতি-কবিতার যেসব শাখা একটি বিশেষ রূপকৃতি বা শিল্প রূপের বন্ধনকে স্বীকার করে নিয়েছে এবং সেই রূপকৃতি হিসাবেই খ্যাতি লাভ করেছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতাবলি। এখানে গীতি-কবিতার আবেগকে চোদ্দো পঙ্ক্তির সীমিত আকারে এবং অন্যান্য কিছু নিয়মের মধ্যে আবদ্ধ রাখতে হয়। সম্ভবত এই সকল বন্ধনের জন্য বিদেশি সমালোচক ‘সিসিল ডে লুইস’ নামে এক কাব্য সমালোচক মনে করেছেন, সনেট গীতি-কবিতার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। কিন্তু প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সাহিত্যের খ্যাতিমান কবিগণ এই বন্ধনকে স্বীকার করেই সনেটের রূপকল্পে অসাধারণ কবিতা সৃষ্টি করেছেন। মূলত একটি বিশেষ রূপকৃতির কবিতা হিসাবে সনেটের উদ্ভব ইটালিতে, তবে উদ্ভবের স্বল্পকালের মধ্যেই ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় সনেটের প্রসার ও জনপ্রিয়তা ঘটে এবং সনেটের ইতিহাসে ইটালীয় সনেটের মতোই গৌরব লাভ করে ইংরেজি সনেট পরে সনেট নামটিই বাংলায় গৃহীত হয়।

ইতালীয় শব্দ Sonnette সনেটো শব্দের অর্থ হল ‘মৃদু ধ্বনি’ এই সনেটে শব্দ থেকে ‘Sonnet’ শব্দটির সৃষ্টি। বাংলায় যা ‘চতুর্দশপদী কবিতা’ নামে স্বীকৃত। সনেট এধরনের গীতি কবিতা, ইতালীয় মূল শব্দটির অর্থের মধ্যেই তার ইঙ্গিত নিহিত, তবে লিরিকের সঙ্গে এর তফাৎ হল কাব্য কায়া নির্মাণে পরিমিত বোধের সঙ্গে আবেগের মাত্রার–সনেট দৃঢ় পিনিদ্ধ শাসনে বদ্ধ, কিন্তু লিরিক অনেকটাই বন্ধনহীন, লিরিকে ভাবোচ্ছাসের তারল্য স্বাভাবিক, কিন্তু সনেটে ভাবগাম্ভীর্য প্রত্যাশিত। সনেট সম্বন্ধে মূল কথা হল—সনেট চোদ্দো চরণের একজাতীয় কবিতা, যার মধ্যে ভাবের সুসংহত প্রকাশ একমাত্র কাম্য বলা যায় ও যেন মহা সমুদ্রের সমূহ তরঙ্গোচ্ছ্বাস এক অনুগলির মধ্যে ধারা প্রয়াস। হৃদয়ের বিপুল অনুভবকে কয়েকটি ছত্রে ছন্দায়িত করা, এর জন্য চাই কবির গভীর অনুভব ও রস চেতনা। আবেগের প্রবাহের দৃঢ় শৃঙ্খলে বাঁধার জন্য চাই আত্মস্থ কবি কল্পনার পরিমিত বোধ। সনেটের আঁটো সাঁটো অবয়বের মধ্যে কাব্যের আত্মাকে প্রাণবন্ত করা চাই। সুগভীর ভাবপ্রকাশের উপযোগী প্রসাধনকল্প, এর জন্য চাই সুনির্বাচিত শব্দ, অলংকার এবং অনিবার্য বাকরীতির প্রয়োগ, একাজ দুরূহ। তাই বলা হয় সনেট হল—‘Moment’s Monument’ মুহূর্তের মিনার। সনেটের প্রেরণা নিঃসন্দেহে লিরিক কবিপ্রতিভা তবে স্বাভাবিক লিরিকের স্বভাব নিজ আবেগ তরঙ্গে ব্যপ্ত করা, আর সনেটে সেই লিরিক উচ্ছ্বাস সংহত হয় মাত্র ১৪টি চরণে।

ইতালীয় ভাষায় সনেটের পথিকৃত কবি পেত্রার্কের নাম অনুসারে পরিচিত পেত্রার্কীয় সনেট নামেই পরিচিত। পেত্রার্কীয় সনেটকে ধ্রুপদী সনেটও বলা হয়। এই রীতির সনেটে মোট চোদ্দো পক্তি থাকে এবং তা দুটি ভাগে বিভাজিত, প্রথম ভাগে থাকে অষ্টক, এর মিলের পদ্ধতি হল ক খ খ ক ক খ খক। দ্বিতীয় ভাগে থাকে ষটক। এর মিলের নিয়ম হল—গ গ, ঘ ঘ, চ চ কিংবা গ ঘ চ ইংরেজি সনেটে কেউ কেউ অবশ্য পেত্রার্কীয় সনেটের আদর্শ অনুসরণ করলেও শেকসপিয়র মূলত সনেটের অঙ্গ বিভাগ ও মিলে ভিন্ন রীতি প্রবর্তন করেছেন। যেমন সনেটের চোদ্দো চরণকে তিনি চারটি ভাগে বিভক্ত করেছেন। প্রথম তিনটি বিভাগ হল চৌপদী এবং বিন্যাস রীতি হল কখ কখ, গঘ গঘ, চছ চছ, চতুর্থ বিভাগের নাম দিপদী এর মিল রীতি জ জ। এছাড়া ফরাসি সনেট রূপে এক ধরনের সনেট সাহিত্যে প্রচলিত আছে তার বিন্যাস রীতির মধ্যেও কিছুটা ভিন্নতা লক্ষিত হয়। পেত্রার্কীয় রীতি অনুযায়ী প্রথম অষ্টকটি এতে লক্ষিত হলেও দ্বিতীয় বিভাগ ষটকটি ভেঙে দ্বিতীয় বিভাগে হয়েছে একটি চৌপদী গগ মিলের দ্বারা এবং তৃতীয় ধাপে রয়েছে একটি চৌপদী, তার মিল হল চছ চছ।

সনেটের বৈশিষ্ট্য :

সনেটের রূপগত ও ভাবগত সকল লক্ষণগুলি অনুভব করে সমালোচক শ্রীশচন্দ্র দাস সনেটের পাঁচটি প্রবাদ বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করেছেনঃ

১। সনেট সাধারণভাবে চতুর্দশ অক্ষর সমন্বিত চোদ্দো পঙ্ক্তির কবিতা।

২। অষ্টক ও ষটকের বিভাগ রক্ষা করাই সনাতন রীতি, যদিও অনেক কবি এ রীতি মানেননি।

৩। এতে একটিমাত্র ভাবে দ্যোতনা থাকে।

৪। এর ভাবে গভীরতা ও ভাষার ঋজুতা থাকবে।

৫ বিশেষ নির্মাণ রীতি অনুসরণ করতে হয় বলে গীতি-কবিতার অন্যান্য শাখার মতো এটি স্বতঃস্ফূর্ত নয়।

একটি বাংলা সনেট :

বাংলা সনেটের প্রবর্তক মাইকেল মধুসূদন দত্ত, তবে এর শ্রেষ্ঠ শিল্পী নিঃসন্দেহে রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু সে কারণে মধুসূদনের কৃতিত্বকে ছোটো করা যায় না, তিনি যে বাংলা সনেটের পথিকৃত তাই শুধু নয়, সেগুলি প্রায়ই সনেটের আদর্শ হয়ে আছে। এছাড়া দেবেন্দ্রনাথ সেন, অক্ষয় কুমার বড়াল, প্রমথ চৌধুরী, মোহিতলাল মজুমদার, প্রমথনাথ বিশী, অজিত দত্ত প্রমুখ কবিরা সনেট রচনায় বিশেষ দক্ষতা দেখিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে মধুসূদন দত্তের ‘বিজয় দশমী’ সনেটখানির নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। এতে সনেটের দেহ ও আত্মার যুগ্ম প্রকাশ ঘটেছে, এতে কবির আজবাশ্রিত ভাবলোেক কল্পনার মায়াঘন স্পর্শে রূপ প্রতিমা হয়ে উঠেছে, ভাবলোক ভাষা, ছন্দ ও অলংকারের সূক্ষ্ম বিন্যাসে সম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে।


অনার্স বাংলা পঞ্চম পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment