বাঙলা সনেটের উদাহরণ সহযোগে কবিতার এই শাখার স্বরূপবৈশিষ্ট্যের পরিচয় দাও।

মধুসূদনের ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’ (১৮৬৬) বাঙলা কাব্যভাষায় সনেটের আঙ্গিক গঠনে চমকপ্রদ কৃতিত্বের নিদর্শন। গীতিকবিতার তরল, স্বচ্ছন্দ-প্রবাহিত ভাবোচ্ছ্বাসকে যে চতুর্দশ পংক্তির গাঢ় বন্ধনরূপে সংহতভাবে প্রকাশ করা যায়, মধুসূদনের সনেট রচনার পূর্বে বাঙলা কাব্যসাহিত্যে তার কোনও উদাহরণ দেখা যায় না।

সনেট সম্পর্কে ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় যথাযথই বলেছেন : “ইহাদের মধ্যে আবেগের তীব্রতা অপেক্ষা জীবন সম্বন্ধে পরিণত চিন্তা, প্রজ্ঞা ও মননের মাধ্যমে মুহূর্তের অনুভবের স্থায়িত্ববিধান, অতীত স্মৃতিচারণা অবলম্বনে চেতনার গভীর স্তরে অবতরণ ইত্যাদি প্রধান রস। এক অখন্ড ভাব ও চিন্তার স্তরহীন রসপরিণতি ও সনেটের অষ্টক, ষটক—এই দুই অংশে ইহার বিবর্তনের পরিপাটি বিন্যাস ইহার বিশিষ্ট রূপাবয়ব।”

বাল্যস্মৃতি, হিন্দুদের বিভিন্ন পুজো ও উৎসব, পূর্বসূরী কবিদের স্মৃতিতর্পণ ও বৈশিষ্ট্য, কবিতা ও কাব্যের রসবিশ্লেষণ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মধুসূদন সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতা রচনা করেছেন। তাঁর ইয়োরোপ প্রবাসকালে এই বিষয়গুলি তাঁর কবিকল্পনাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ডঃ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই উক্তি এই প্রসঙ্গে স্মরণীয় : “মধুসূদনের অবিচ্ছিন্ন বীররস অনুশীলনের মধ্যে করুণ রসের উৎস যে কোথায় লুকানো ছিল, রাজপরিবেশের ঐশ্বর্যময় বর্ণনার অন্তরালে গার্হস্থ্য জীবনের শান্ত-মধুর স্মৃতি কোথায় আত্মগোপন করিয়া ছিল, রক্ষঃকুললক্ষ্মীর দেব মহিমার মধ্যে কোজাগরী পূর্ণিমার শরৎলক্ষ্মী তাঁহার জ্যোৎস্নার শুভ্র, চোখ জুড়ানো শ্রী ও বরদানের ঝাঁপি লইয়া কেমন প্রচ্ছন্ন ছিলেন তাহারই ইঙ্গিত আমরা এখানে পাই।”

পেত্রার্কের সনেটের বাহ্যিক গঠন মধুসূদন তাঁর ‘চতুর্দশপদী’ কবিতাবলীতে অনুসরণ করেন নি, যদিচ সর্বসমেত ১০২টি কবিতার মধ্যে তেতাল্লিশটিতে পেত্রার্কের অনুযায়ী অষ্টম-ষটক বিভাগ (ক থ ক খ ক খ ক খ + গ ঘ গ ঘ গ ঘ) চোখে পড়ে। এ বিষয়ে মধুসূদনের পথিকৃৎ ছিলেন মিল্টন, তিনি পেত্রার্কীয় সনেটের অষ্টপংক্তিক স্তবক (Octave) ও ষড়পংক্তিক স্তবকের (Sestet) বিভাগকে একমাত্র ও চরম মানদন্ডরূপে গ্রহণ করেন নি। মিল্টনের কবিতায় অষ্টকে দুটি মিল, মধুসুদনের রচনারও তাই। মিল্টনের সনেটের দুটি কি তিনটি মিলের বিন্যাস মধুসূদন অনুসরণ করেছেন। চতুর্দশপদী কবিতাগুলির মধ্যে পাঁচটির ষটকে তিনটি মিল, একটিতে অষ্টক-ষটক মিলে তিনটি মিল, আর অবশিষ্ট ছিয়ানব্বইটি কবিতার ষটকে দুটি করে মিল লক্ষ্য করা যায়। পাঁচটির ঘটকে তিনটি মিলের উদাহরণ তাঁর ‘বঙ্গভাষা’ কবিতাটি—

হে বঙ্গ, ভান্ডারে তব বিবিধ রতন :

তা সবে, অবোধ আমি! অবহেলা করি,

পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ

পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।

কাটাইনু বহুদিন সুখ পরিহরি।

অনিদ্রায়, নিরাহারে সঁপি কায়, মনঃ,

মজিনু বিফল তপে অবরণ্যে বরি;

কেলিনু শৈবালে; ভুলি কমল-কানন!

স্বপ্নে তবে কুললক্ষ্মী কয়ে দিলা পরে –

“ওরে বাছা মাতৃ-কোষে রতনের রাজি,

এ ভিখারী-দশা তবে কেন তোর আজি?

যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যারে ফিরি ঘরে।”

পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালে

মাতৃ-ভাষা-রূপ খনি, পূর্ণ মণিজালে।।

রবীন্দ্রনাথের সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতার গাঢ়বন্ধ ভাবপরিমিতি সৃষ্টির নৈপুণ্যের পরিচয় মেলে তাঁর ‘কড়ি ও কোমল’ এর কয়েকটি সনেটে। তিনি এই প্রথম সনেট রচনা করেন, সনেটগুলিই এই কাব্য-সংকলনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। ‘কড়ি ও কোমল’-এর ‘প্রাণ’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথের সনেট রচনার দক্ষতার পরিচয় পাই—

মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, 

মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।। 

এই সূর্যকরে এই পুষ্পিত কাননে 

জীবন্ত হৃদয় মাঝে যদি স্থান পাই। 

ধরায় প্রাণের খেলা চিরতরঙ্গিত, 

বিরহ মিলন কতহাসি অশ্ৰু-ময় 

মানবের সুখে দুঃখে গাঁথিয়া সংগীত 

যদি গো রচিতে পারি, অমর আলয়। 

তা যদি না পারি তবে বাঁচি যত কাল 

তোমাদেরি মাঝখানে লভি যেন ঠাই, 

তোমরা তুলিবে বলে সকাল বিকাল 

নব নব সংগীতের কুসুম ফুটাই। 

হাসিমুখে নিয়ো ফুল, তার পরে হায়

ফেলে দিয়ো ফুল, যদি সে ফুল শুকায়।।

সনেট রচনায় দেবেন্দ্রনাথ সেনের সহজাত নৈপুণ্য ছিল। তাঁর সনেটের ভাষায় মধুসুদনের এবং নির্মাণে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব সত্ত্বেও মৌলিকতা সুস্পষ্ট। মোহিতলাল মজুমদারও সনেট রচনায় তাঁর দক্ষতার পরিচয় রেখে গেছেন। মোহিতলালের সনেট সম্পর্কে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই উক্তি স্মরণীয় : “মোহিতলালের বলিষ্ঠ মনন ও ভাস্কর্যোপম আঙ্গিক গঠন একক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা বেশী সার্থক হইয়াছে তাহা সনেট রচনার ক্ষেত্র। এই সনেটের পদ-বিন্যাসে তিনি একেবারে সিদ্ধহস্ত। গীতিকবিতাতে যে মননভারক্লিষ্ট মন্থরতা পীড়া দেয়, সনেটে তাহাই স্বাভাবিক ভাবচ্ছন্দরূপে পাঠকের অবিমিশ্র প্রশংসা ও রসোপভোগের অভিনন্দন লাভ করে। বস্তুত মোহিতলালের ক্ল্যাসিক্যাল গঠনশিল্প, সুবিন্যস্ত ভাবসজ্জা, জীবনসত্য প্রকাশের বলিষ্ঠ ভঙ্গী ও ছন্দের ভাবনা-নিয়ন্ত্রিত অলক্ষ্যপ্রায় প্রবাহ এই যুগের অন্যান্য কবির আঙ্গিক শিথিলতা, ভাবের অজস্র উৎসার ও ছন্দোবিলাসের আতিশয্যের একটি অসাধারণ ব্যতিক্রম ও মননদৃপ্ত প্রতিবাদ।”

প্রমথ চৌধুরীর সনেটের সংকলন ‘সনেট-পঞ্চাশৎ’ ও ‘পদচারণ’ বাঙলা ভাষায় সনেট রচনার উল্লেখযোগ্য প্রয়াস হিসেবে বিশেষভাবে স্মরণীয়। ডঃ সুকুমার সেন যথার্থই বলেছেন: “সমসাময়িক বাঙ্গালা কবিতার (রবীন্দ্রনাথের ছাড়া) কৃত্রিম ভাবালুতা, গতানুগতিক প্রকৃতি বর্ণনা অথবা বই পড়া তত্ত্বকথার নিরর্থ শব্দপ্রচুর ভাষার এবং শিথিল সাহিত্যকর্মের বিরুদ্ধে প্রমথবাবুর প্রতিক্রিয়া ও আপত্তি এই কবিতাগুলিতে প্রকাশিত। শব্দচয়নের শ্রমসাধ্য নিপুণতায়, ভাষা ও ভঙ্গির কঠিন দীপ্তিতে এবং রচনাবন্ধের গাঢ়তায় প্রমথবাবুর সনেটগুলিতে নূতন স্বাদ পাওয়া গেল। পদ্যবন্ধে গদ্যের ভারবহতা দেখা দিল। স্বতঃস্ফূর্তির অভাব থাকিলেও তাহা নির্মাণ কৌশলে চাপা পড়িয়া গিয়াছে। প্রমথবাবুর দৃঢ়পিনদ্ধ কাব্যশিল্পের উপযুক্ত আধার এই সনেট।”

‘সনেট পঞ্চাশং’ পড়ে রবীন্দ্রনাথ প্রমথ চৌধুরীকে যে কথা বলেছিলেন তাতেই তাঁর কবিতার স্বরূপ-বৈশিষ্ট্য নির্দেশিত হয়েছে : “বাংলায় এ জাতের কবিতা আমি ত দেখিনি। এর কোন লাইনটি ব্যর্থ নয়, কোথাও ফাঁকি নেই–এ যেন ইস্পাতের ছুরি, হাতির দাঁতের বাটগুলি জহুরির নিপুণ হাতের কাজ করা, ফলাগুলি ওস্তাদের হাতের তৈরি—তীক্ষ্ণধার হাস্যে ঝকঝক করচে, কোথাও অশ্রুর বাষ্পে ঝাপ্‌সা হয় নি–কেবল কোথাও যেন কিছু কিছু রক্তের দাগ লেগেছে। বাংলায় সরস্বতীর বীণায় এ যেন তুমি ইস্পাতের তার ছড়িয়ে দিয়েছ।”

প্রমথ চৌধুরীর সনেটের গঠন বৈশিষ্ট্যে ইটালীর অপেক্ষা ফরাসী সনেটের সঙ্গে সাদৃশ্য বেশি, বিশেষ ঘটকের প্রথম দুই ছত্র দ্বিপদীতে। ‘সনেট-পঞ্চাশতে’র অর্ধেকেরও বেশি কবিতায় মিলের বিন্যাস এই— ক খ খ ক ক খ খ ক গ গ ঘ ঙ ঘ ঙ। একটি ছাড়া আর কোথাও অষ্টকের মিলে ব্যতিক্রম দেখা যায় না। অষ্টকের দ্বিপদীতে কোথাও ব্যতিক্রম নেই, ষটকের শেষ চতুষ্পদী ছাড়া। স্তবকবন্ধেও বিভিন্ন বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়।। প্রমথ চৌধুরীর শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলির কাব্যকৌশলে নিটোল ভাব ও তীক্ষ্ণ পরিমিত ভাষা অলংকারের দীপ্ত কারুকার্যের নিদর্শন এই কামিনী কাঞ্চনের রূপক—কবিতাটি :

কখনো অন্তরে মোর গভীর বিরাগ, 

হেমন্তের রাত্রি হেন থাকে ‘গো’ জড়িয়ে, 

-যাহার সর্বাঙ্গে যায় নীরবে ছড়িয়ে 

কামিনী ফুলের শুভ্র অতনু পরাগ।।

বাসনা যখন করে হৃদয় সরাগ, 

শিশিরে হারানো বর্ণ লীলায় কুড়িয়ে, 

চিদাকাশে দেয় জ্বেলে, বসন্ত গড়িয়ে 

কাঞ্চন ফুলের রক্ত চঞ্চল চিরাগ।।

কভু টানি, কভু ছাড়ি, মনের নিঃশ্বাস। 

পক্ষে পক্ষে ঘুরে আসে সংশয় বিশ্বাস।।

বসন্তের দিবা আর হেমন্ত যামিনী, 

উভয়ের দ্বন্দ্বে মেলে জীবনের ছন্দ। 

দিবাগাত্রে রঙ আছে, নিশাবক্ষে গন্ধ, 

সৃষ্টির সংক্ষিপ্তসার কাঞ্চন-কামিনী।।


অনার্স বাংলা পঞ্চম পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment