‘মহাকাব্য’ এই শব্দটি আমরা সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্র থেকে গ্রহণ করেছি। সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্রে মহাকাব্যের যে লক্ষণগুলি নির্দেশ করা হয়েছে তাদের মধ্যে প্রধান লক্ষণগুলি হল এইঃ কোনও প্রধান দেবতা, সদ্বংশজাত যশস্বী ক্ষত্রিয় সম্রাট, অথবা চন্দ্রসূর্যবংশের মত কোন উচ্চ রাজবংশচরিত অবলম্বনে ছন্দ রচিত রচনা মহাকাব্য পদবাচ্য। মহাকাব্যে পর্বত, সমুদ্র, নগর, প্রান্তর, চন্দ্র, সূর্যের উদয়াস্ত প্রভৃতি স্বভাব বা প্রকৃতির সৌন্দর্য, রাজা বা সেনাপতিদের মন্ত্রণায় সৈন্যচালনা ও যুদ্ধ, জন্ম, মৃত্যু ও বিবাহ ও মিলন, ধর্ম-অর্থ-কাম মোক্ষ এই চতুর্বর্গ উৎসব, পার্বণ, ঋতু বর্ণনা প্রভৃতির মধ্যে সমুদয় অথবা কোনও বিষয় মূল আখ্যানবস্তুর সঙ্গে সন্নিবিষ্ট হয়, গ্রন্থসমূহ অন্যূন সংখ্যায় বিভক্ত হয়ে থাকে, সর্গগুলি নাতিদীর্ঘ ও নাতিহ্রস্ব হয়, কবি স্বীয় ইষ্টদেবতার স্তুতি, বন্দনা বা সাধারণের মঙ্গলকামনায় কাব্য আরম্ভ করেন; প্রত্যেক সর্গে পরবর্তী সর্গে বর্ণিত বিষয়ের আভাষ প্রদত্ত হয়, সর্গগুলি একরূপ ছন্দে অথবা বিভিন্ন ধরনের ছন্দে রচিত হয়, কোনও সর্গের বর্ণিত বিষয়ে প্রধানতম বিষয়সূচক নামের শেষে পর্বের নামকরণ হয়ে থাকে। মহাকাব্যে বীর, করুণ, আদি ও শান্ত এই চারটি রসের মধ্যে কোনও একটি রসের প্রাধান্য থাকে, অন্য তিনটি স্থায়ী এবং হাস্য, রৌদ্র প্রভৃতি রস অপ্রধান ও অস্থায়ীভাবে বিদ্যমান থাকে। বর্ণনীয় বিষয় অথবা নায়ক নায়িকার নামে মহাকাব্যের নামকরণ হয়।
সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্রের এই সংজ্ঞা বা লক্ষণ অনুযায়ী কালিদাসের ‘কুমারসম্ভব’, ‘রঘুবংশ’; ভারবির ‘কিরাতর্জুনীয়ম্’: মাঘের ‘শিশুপালবধ’ প্রভৃতি মহাকাব্যরূপে চিহ্নিত হয়েছে, কিন্তু তাদের মানদন্ডে রামায়ণ ও মহাভারতের মত আদিম, মৌলিক মহাকাব্যরূপে স্বীকৃত রচনাকে মহাকাব্য আখ্যা দেওয়া যায় না, এই প্রসঙ্গ অনিবার্যভাবেই আমাদের স্মরণ করতে হয়। অন্যদিকে, মহাকাব্য বলতে আধুনিক যুগে আমরা কোনও না কোনও ধরনের জাতীয় জীবনের গৌরবগাথামূলক, ভাবগত সমুন্নতিতে (sublimity) মহিমান্বিত, গাম্ভীর্যমন্ডিত ছন্দোবদ্ধ রচনাকে বুঝে থাকি। ‘কুমারসম্ভব’, ‘রঘুবংশ’, ‘কিরাতর্জুনীয়ম’, ‘শিশুপালবধ’ প্রভৃতি সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্রের লক্ষণ বিচারে মহাকাব্য পদবাচ্য রচনাগুলিতে পাওয়া যাবে না। সুতরাং অলংকারশাস্ত্রোক্ত ঐ প্রধান লক্ষণগুলি থাকলেই যে কোনও রচনা মহাকাব্যের অভিধা পাবার যোগ্য—আমরা সেই সুনিশ্চিত সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি না।
ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার সবথেকে প্রতিভাবান কবি মধুসূদনের মহাকাব্যরূপে পরিচিত ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র কথাই ধরা যাক। এই কাব্যের নায়ক সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্র নির্দিষ্ট কোনও প্রধান দেবতা, সদ্বংশজাত যশস্বী ক্ষত্রিয় সম্রাট নয়, কিংবা এই কাব্য চন্দ্রসূর্যবংশের মত কোনও উচ্চবংশ-চরিত অবলম্বনে রচিত হয় নি। ইন্দ্রজিৎ বা মেঘনাদের নামে মধুসূদন এই কাব্যের নামকরণ করলেও তার নায়ক লংকার রাক্ষসকুলাধিপতি রাবণ, অধর্মাচারী রাক্ষসরূপে যে চিরনিন্দিত। সুতরাং মধুসূদন সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্র-নির্দেশিত মহাকাব্যের প্রধানতম লক্ষণ বা শর্তটিকেই অনুসরণ করেন নি একথা বললে খুব কম করে বলা হয়। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর মহাকাব্য বিষয়ক আলোচনাকে অনুসরণ করে আমরা বলতে পারি, তিনি তা উৎকটভাবেই লংঘন করেছেন। কবি তাঁর কাব্যের স্থানগত পটভূমি লংকার বর্ণনায় সমুদ্র, নগর, সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত বর্ণনা করেছেন, কিন্তু সেই সমস্ত বর্ণনা সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্রসম্মত মহাকাব্য পদবাচ্য রচনার মত স্বতন্ত্রভাবে চমৎকারিত্ব সৃষ্টির প্রয়াসে আমাদের দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে না, তারা কাব্যের মূল বিষয়বস্তুর অঙ্গরূপে তার চিত্রণের প্রয়োজনেই সন্নিবিষ্ট হয়েছে, আমাদের অনুভব না করে কোনও উপায় থাকে না। ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ সৈন্যচালনা ও যুদ্ধের চিত্র আছে, ‘জন্ম, মৃত্যু ও বিবাহ, বিরহ ও মিলন’— এই লক্ষণগুলির মধ্যে মৃত্যু ও বিরহ বর্ণিত হলেও সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্রের এই সূত্রে বা সংজ্ঞায় ঘটনার যে অনুক্রম (sequence) বা পারস্পর্য নির্দেশিত হয়েছে, মধুসুদন তাকে অনুসরণ করেন নি, মৃত্যু ও বিরহকে বর্ণনা করেছেন তাঁর কাহিনী বিন্যাসের নিজস্ব প্রয়োজনে, সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্রের শর্তকে বিন্দুমাত্র পরোয়া না করে।
‘মেঘনাদবধ কাব্য’কে দশ সর্গে শেষ করার ইচ্ছা মধুসুদনের ছিল, কিন্তু তিনি নবম সর্গেই কাব্যটির উপসংহার রচনা করেছেন; সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্র নির্দিষ্ট মহাকাব্যের ন্যূনতম সংখ্যা এটাই, কিন্তু এটি মহাকাব্যের এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ নয়। কাব্যের প্রারম্ভে কবির নিজের ইষ্টদেবতার স্তুতি, বন্দনা বা সাধারণের মঙ্গল কামনা – সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্রের এই মহাকাব্যোচিত লক্ষণ ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র সূচনায় সরস্বতীর কৃপা প্রার্থনা করে তাঁর বন্দনায় কাব্যের উপক্রমণিকা রচনা করেছেন, ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের মত সরস্বতী হিন্দুদের ইষ্টদেবতা নন। সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্র-নির্দেশিত লক্ষণ অনুসরণে কবি প্রত্যেক সর্গে পরবর্তী সর্গের বিপর্যয়ের আভাষ দেন নি। বীর, করুণ, আদি ও শান্ত এই চারটি রসের মধ্যে কোনও একটির প্রাধান্য অন্য তিনটি স্থায়ী এবং হাস্য, রৌদ্র প্রভৃতি রস অপ্রধান ও অস্থায়ীভাবে বিদ্যমান থাকবে—মহাকাব্যের রসপর্যায় সম্পর্কে সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্রের এই অন্যতম প্রধান বিধান অনুসরণের প্রয়োজনও মধুসূদন অনুভব করেন নি।
সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্রোক্ত মহাকাব্যের প্রধান লক্ষণগুলি ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ পাওয়া যায় না বলেই কি এই রচনাটিকে মহাকাব্যের গৌরবময় আখ্যা দেওয়া যাবে না—এই আলোচনায় অনিবার্যভাবেই সেই প্রশ্নটি ওঠে। আমরা এই আলোচনার প্রথম দিকে মহাকাব্য সম্পর্কে যে আধুনিক ধারণা উল্লেখ করেছি, তা যে ইউরোপীয় এপিকের দৃষ্টান্ত ও তৎসম্পর্কিত আলোচনা-বিশ্লেষণের ওপর প্রতিষ্ঠিত, নির্দেশ করার অপেক্ষা রাখে না। মধুসূদন ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ রচনায় ইয়োরোপীয় মহাকাব্যের আদর্শ ও ঐতিহ্যের দ্বারাই প্রভাবিত হয়েছিলেন। কাব্যটির সূচনায় কবি ‘গাইব, মা, বীররসে ভাসি, মহাগীত’— তাঁর এই সংকল্প ঘোষণায় বীররসাত্মক গম্ভীর ভাবোদ্দীপক Heroic tale রূপে মহাকাব্যের সেই ধ্রুপদী (classical) আদর্শ অনুসরণের কথাই বলেছেন। হোমার, ভার্জিল, মিল্টন প্রভৃতি ইউরোপীয় কবির মহাকাব্যের রচনার আদর্শ তাঁর সামনে ছিল। গম্ভীর ভাবোদ্দীপক বর্ণনায়, ধ্রুপদী সাহিত্যসুলভ চিত্রকল্পে ও অলংকারে অমিত্রাক্ষর ছন্দের উদাত্ত ধ্বনিগৌরবে মধুসূদন মহাকাব্যের গাম্ভীর্য ও বিশালতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বাঙালীর মজ্জাগত গীতিপ্রাণতা কবির সেই সচেতন লক্ষ্য ও প্রয়াসকে প্লাবিত করে চিত্রাঙ্গদা ও মন্দোদরীর বিলাপে, সীতার নির্বাসিত জীবনের বেদনায়, ইন্দ্রজিৎ ও প্রমীলার প্রেমের ট্র্যাজিক বিষাদে ও পুত্রবিয়োগে শোকাতুর রাবণের হাহাকারে, করুণরসের স্বতঃস্ফূর্ত ধারায় প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছে—অনেক সমালোচকই লক্ষ্য করেছেন। এই প্রসঙ্গে মোহিতলাল মজুমদারের উক্তি স্মরণীয় : “মেঘনাদবধ কাব্যের কবির চিত্তে একটা বড় দ্বিধা বা দ্বন্দ্ব ছিল—কবির মন যাহা চাহিয়াছিল, প্রাণ তাহা স্বীকার করে নাই। তাই এপিক আকারের তলে তলে অন্তঃসলিলা হইয়া লিরিকের ফল্গুস্রোত বহিয়াছে।” কবি নিজেই, রাজনারায়ণ বসুর কাছে লিখিত এক পত্রে গীতি-কবিতার প্রতি তাঁর প্রবণতার উল্লেখ করেছেন।
কিন্তু মহাকাব্যের লক্ষণগুলি ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ যান্ত্রিকভাবে মিলিয়ে দেখার পরিবর্তে আমরা যদি তার গম্ভীর ভাবোদ্দীপক সুর ও রূপের মূল বৈশিষ্ট্যটিকে অপেক্ষাকৃত উদার দৃষ্টিতে গ্রহণ করে এর আধুনিক যুগে, বিশেষত ঊনবিংশ শতাব্দীর বিদেশী শাসন-শৃঙ্খলিত বাঙালি জীবনের সীমাবদ্ধতায় যে ধ্রুপদী আদর্শের পূর্ণাঙ্গ মহাকাব্য রচনা সম্ভব ছিল না, যা সপ্তদশ শতাব্দীতে ইংরেজ কবি মিল্টন রচনা করতে সক্ষম হন নি স্মরণে রেখে মধুসূদনের রচনাকে বিশ্লেষণ করে দেখি, তবে তিনি যে তাঁর এই কাব্যকে অনেকটা পরিমাণেই মহাকাব্যের মর্যাদা দান করতে পেরেছিলেন, আমাদের স্বীকার করতেই হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপীয় সভ্যতা ও সাহিত্যের সংস্পর্শে ও প্রভাবে বাঙালি যে আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ধ্যানধারণা, মানবমহিমাবোধ ও স্বাজাত্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত জীবনাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিল, যার ফসল ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙলার নবজাগরণ, ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ তারই এক গৌরবময় মহিমাদীপ্ত প্রকাশ লক্ষ্য করি।
রামের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত বীরবাহুর জন্য শোকে অধীর হয়ে তার জননী চিত্রাঙ্গদা রাবণের রাজসভায় এসে তার জন্য তাকেই দায়ী করে সে নিজেই লঙ্কাপুরিতে কাল-অগ্নি প্রজ্বলিত করেছে সেই অভিযোগ জানিয়ে যায়। রাবণ নিজেই পুত্রশোকে কাতর ছিল, এই অভিযোগ তার মর্ম বিদ্ধ করে, আত্মীয়স্বজন অনুচরে ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ তার সাধের স্বর্ণলংকার ধ্বংস যে আসন্ন তার নিশ্চিত আভাষ পায়, তবু সে আত্মসমর্পণের কথা চিন্তা করতে পারে না, শোকে কাতর হয়ে ভেঙে পড়ে না। সংগ্রামের বজ্রনির্ঘোষে তাঁর শোককে প্রকাশ করে—
… শোকে, অভিমানে,
ত্যজি সুকনকাসন, উঠিলা গৰ্জ্জিয়া
রাঘবারি। “এতদিনে” (কহিলা ভূপতি)
“বীরশূন্য লঙ্কা মম। এ কাল সমরে,
আর পাঠাইব কারে? কে আর রাখিবে
রাক্ষসকুলের মান? যাইব আপনি।
সাজ হে বীরেন্দ্রবৃন্দ, লঙ্কার ভূষণ।
দেখিব কি গুণ ধরে রঘুকুলমণি।
অরাবণ অরাম বা হবে ভব আজি!”
নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে লক্ষ্মণের সঙ্গী হিসেবে বিভীষণকে দেখতে পেয়ে মেঘনাদ যখন ক্ষোভ প্রকাশ করে, তখন তার পিতৃব্য বলে, রাবণ তার কর্মদোষে নিজের সঙ্গে এই কনকলঙ্কার সর্বনাশ করছে। কালসলিলে তা নিমজ্জিত হতে চলেছে; নিজেকে রক্ষা করার জন্য সে রামের চরণাশ্রয়ী। ইন্দ্রজিৎ বিভীষণের সেই ব্যক্তিগত স্বার্থ ও নিরাপত্তাসন্ধানী ধর্মবোধকে এইভাবে ধিক্কার দেয়—
কহিলা বীরেন্দ্র বলী,-“ধর্মপথগামী,
হে রাক্ষসরাজানুজ, বিখ্যাত জগতে
তুমি ;–কোন্ ধৰ্ম্ম মতে, কহ দাসে, শুনি,
জ্ঞাতিত্ব, ভ্রাতৃত্ব, জাতি, – এ সকলে দিলা
জলাগুলি? শাস্ত্রে বলে, গুণবান্ যদি
পরজন, গুণহীন স্বজন, তথাপি
নির্গুণ স্বজন শ্রেয়ঃ, পরঃ পরঃ সদা!”
বিভীষণের বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে মেঘনাদের ক্ষোভ রোষ ও স্বাজাত্যবোধ এখানে বজ্রাগ্নির মত যে দীপ্তরূপ লাভ করেছে, সেটি যে মহাকাব্যোচিত মর্যাদা ও ওজস্বিতামণ্ডিত, তাতে আমাদের মনে কোনও সন্দেহের অবকাশ থাকে না। লক্ষ্মণের শরে নিজের প্রিয়তম পুত্র ও লংকাপুরীর সর্বশ্রেষ্ঠ বীর মেঘনাদের মৃত্যুর সংবাদে রাবণ শোকে কাতর হয়ে ভেঙ্গে পড়ে না, প্রকৃত বীরপুরুষের মত যুদ্ধে নিজের শোকাগ্নিকে নির্বাপিত করার দুর্দমনীয় সংকল্প প্রকাশ করে—
সরোষে–তেজস্বী আজি মহারুদ্রতেজে
কহিলা রাক্ষসশ্রেষ্ঠ, “এ কনক-পুরে,
ধনুর্দ্ধর আছ যত, সাজ শীঘ্র করি
চতুরঙ্গে। রণরঙ্গে ভুলিব এ জ্বালা
এ বিষম জ্বালা যদি পারিরে ভুলিতে।”
এখানে রাবণের উদ্ভিতে আমরা অমিত্রাক্ষর ছন্দের ডমরু ধ্বনিই শুনতে পাই। অমিত্রাক্ষর ছন্দের ধ্বনিগাম্ভীর্য ও মহোপমা রাবণের শোকের এই বিষাদ গম্ভীর মূর্তির চিত্রকে মহাকাব্যোচিত মহিমায় মণ্ডিত করেছে—
বাহিরিলা পদব্রজে রক্ষঃকুলরাজা
রাবণ বিশদবস্ত্র বিশদ উত্তরী,
ধুতুরার মালা যেন ধূর্জটির গলে :
চারিদিকে মন্ত্রিদল দূরে নতভাবে।
নীরব কর্ফুরপতি, অশ্রুপূর্ণ আঁখি,
নীরব সচিববৃন্দ, অধিকারী যত
রক্ষঃশ্রেষ্ঠ।
‘মেঘনাদবধ কাব্যের মহাকাব্যোচিত লক্ষণগুলি সম্পর্কে ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই বলেছেন: “মধুসুদন রাম-রাবণের যুদ্ধের মধ্যে এক যুগচেতনা আকাঙ্ক্ষিত নূতন তাৎপর্য সন্নিবেশ করিয়া ইহার আবেদন আরও ঘনীভূত করিয়াছেন। বাল্মীকি রামচন্দ্রকে নর-চন্দ্রমারূপে উপস্থাপিত করিয়াছেন; কৃত্তিবাস উহাকে অবতাররূপে কল্পনা করিয়া উহার দেবত্ব প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন ও ভক্তি রসোচ্ছলতায় উহাকে অভিষিক্ত করিয়া যুগ প্রয়োজনের দাবি মিটাইয়াছেন। বাল্মীকি ও কৃত্তিবাস উভয়ের নিকট রাম-রাবণের যুদ্ধ ধর্ম ও অধর্ম, ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে সংগ্রাম; এই সংগ্রামে রাবণের প্রতি যে সহানুভূতি জাগিতে পারে তাহা তাঁহাদের কল্পনাতীত ছিল। এই যুদ্ধ যে কোন দৃষ্টিভঙ্গীতে আততায়ীর বিরুদ্ধে জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের মর্যাদা ও ভাবাদর্শ লাভ করিতে পারে তাহাও তাঁহারা মনে করেন নাই। কিন্তু মধুসুদনের রচনায় যুগমানসের বিশেষ অভিলাষটি, যুগচেতনার কাম্যতম স্পন্দনটি স্ফুরিত হইয়া ইহাকে প্রকৃত মহাকাব্যের গৌরব দিয়াছে।… মহাকাব্যের সার্থক রচনা যুগমানসের প্রতিনিধিত্ব ছাড়াও কয়েকটি বিরল গুণের একাক্সিক (organic) সমাবেশের উপর নির্ভরশীল। মধুসুদনের কাব্যে এই সমস্ত গুণের বর্ণাঢ্য চিত্রসৌন্দর্য, রণসজ্জা ও যুদ্ধবিগ্রহের ধ্বনিগাম্ভীর্য ও কোলাহলমুখরতা—এই সমস্ত কাব্যবর্ণনার মধ্য দিয়া ফুটাইয়া তুলিতে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী।…..চিতাশয্যায় শায়িত ইন্দ্রজিৎ—প্রমীলার ভস্মীভূত দেহের সম্মুখে দাঁড়াইয়া রাবণের যে শোকোচ্ছ্বাস তাহা রাজচরিত্রানুযায়ী, রাজ্যের কল্যাণ চিন্তায় ব্যক্তিগত শোকের আতিশয্য হইতে নিয়ন্ত্রিত। মধুসুদনের মহাকাব্যের সর্বত্রই এই পরিমিতিবোধ ও কাব্যদর্শনের নিখুঁত অনুকরণ।”
সংস্কৃত মহাকাব্যের লক্ষণগুলি অনুসরণ না করা সত্ত্বেও আধুনিক জীবনবোধের প্রেরণায় মধুসূদন যে তাঁর ‘মেঘনাদবধ কাব্য’কে মহাকাব্যের চরিত্র গৌরব অর্পণে সফল হয়েছেন, রবীন্দ্রনাথের এই উক্তিতে সুন্দরভাবে পরিস্ফুট হয়েছে : “কবি পয়ারের বেড়ি ভাঙ্গিয়াছেন এবং রাম-রাবণের সম্বন্ধে অনেকদিন হইতে আমাদের মনে যে একটা বাঁধাবাঁধি ভাব চলিয়া আসিয়াছে স্পর্ধাপূর্বক তাঁহারও শাসন ভাঙিয়াছেন। এই কাব্যে রাম-লক্ষণের চেয়ে রাবণ-ইন্দ্রজিৎ বড়ো হইয়া উঠিয়াছে। যে ধর্মভীরুতা সর্বদাই কোন্টা কতটুকু ভালো মন্দ তাহা কেবলই অতি সূক্ষ্মভাবে ওজন করিয়া চলে তাহার ত্যাগ দৈন্য আত্মনিগ্রহ আধুনিক কবির হৃদয়কে আকর্ষণ করিতে পারে নাই। তিনি স্বতঃস্ফূর্ত শক্তির প্রচণ্ড লীলার মধ্যে আনন্দবোধ করিয়াছেন। যে শক্তি অতি সাবধানে সমস্তই মানিয়া চলে, তাহাকে যেন মনে মনে অবজ্ঞা করিয়া যে শক্তি স্পর্ধাভরে কিছু মানিতে চায় না, বিদায়কালে কাব্যলক্ষ্মী নিজের অশ্রুসিক্ত মাল্যখানি তাহার গলায় পরাইয়া দিল।”