‘মুক্তধারা’ নাটকে বাঁধের অভ্রভেদী লৌহযন্ত্রের মাথা এবং ভৈরব মন্দির চূড়ার ত্রিশূলের প্রতীকের মধ্যে নাটকের মূলতত্ত্ব বিধৃত। অভ্রভেদী লৌহযন্ত্রের মাথা যন্ত্রবাদ, যন্ত্রসভ্যতার দন্ত ও মদমত্ততার প্রতীক। মন্দির চূড়ার ত্রিশূল দেববাদ ও অধ্যাত্ম শক্তির প্রতীক। এই দুই প্রতীক কীভাবে নাটকের মূল তত্ত্বকে ব্যাখ্যা করেছে তার যথার্থ আলোচনা করেছেন—রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ প্রমথনাথ বিশী— “উত্তরকূটের দেবতা মানুষের জন্য যে ঝর্ণা দিয়াছেন, উত্তরকূটের যন্ত্রবাজ তাহাকে বাঁধিয়া নিজেদের প্রয়োজনের জন্য সংযত করিয়াছে। … দুই বিপরীত দিকে দুইটা প্রতীককে স্থাপন করিয়া কবি যেন ইহাদের মধ্যে বিরোধটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাইয়া দিতে চাহেন।” নাটকের কথাবস্তু বিশ্লেষণে উক্তিটির সার্থকতা প্রমাণিত হয়।
নাটক শুরু হয়েছে উত্তরকূটের একজন নাগরিকের সঙ্গে জনৈক বিদেশি পথিকের কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে। পথিক প্রতিবারের মতো এবারেও ভৈরব মন্দিরের আরতি দেখতে ও নৈবেদ্য দিতে এসেছে। কিন্তু এবার অসুরের মাথার মতো মাংসহীন, চোয়াল ঝোলা যন্ত্রটিকে দেখে সে ভীত সন্ত্রস্ত। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সে জানিয়েছে—“ও যে ওমন করে মন্দিরের মাথা ছাড়িয়ে গেল এটা যেন স্পর্ধার মতো দেখাচ্ছে।” উত্তরকূটের নাগরিকদের দেবলঙ্ঘী স্পর্ধার এখানেই প্রথম পরিচয় ; ভৈরব যে জল মানুষের জন্য দিয়েছেন উত্তরকূটের অধিবাসীরা নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য তাকে বেঁধেছে। রাজা রণজিং তাই গর্বের সঙ্গে বলে ওঠেন, “এতদিন মুক্তধারার জলকে আবদ্ধ করে বিভূতি ওদের বশ মানাবার উপায় করে দিলে।”
ভৈরব যিনি সকলেরই দেবতা তাকে কেবল নিজেদের দেবতা মনে করার দুঃসাহস উত্তরকূটের অধিবাসীদের হয়েছে। দেবতা যখন বিশেষ জাতির দেবতা বলে গণ্য হন, তাঁর দান যখন বিশেষ জাতির ওপর বর্ষিত বলে মনে করা হয়, তখন সেই বিশেষ জাতি একমাত্র নিজেদেরই দেবতার অনুগৃহীত বলে মনে করে। তখন তারা অন্য জাতির ওপর দেবতার প্রতিনিধি রূপে স্বার্থ-পাশ নিক্ষেপ করে দেবতার অভিনয় করতে থাকে। প্রকৃত দেবতাকে মনে করে আলাদিনের প্রদীপের মতো অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন স্বার্থ সাধনের উপকরণ এবং তখনই ভৈরব মন্দিরের চূড়ায় ত্রিশূলের চেয়ে বড়ো হয়ে ওঠে বাঁধের লৌহযন্ত্রের মাথা।
একেই বলে অদৃষ্ট। যিনি মানুষের জন্য মুক্তধারা সৃষ্টি করেছেন, বাঁধ বেঁধে তার বিধানকে লঙ্ঘন করার অর্থ বিশ্বনীতি দ্রোহিতার পরিচয় প্রদান করা। আবার সেই লঙ্ঘনের গৌরবে আনন্দিত হয়ে তাকে সন্তুষ্ট করার জন্য পূজা সমারোহ। খুড়া মহারাজ বিশ্বজিৎ তখন মহারাজ রণজিৎকে তীব্রস্বরে বলে ওঠেন—“ভৈরব আজকের পূজা গ্রহণ করবেন না।” কিন্তু শক্তি মোহে আচ্ছন্ন রণজিতের কাছে দেবতা স্বার্থসাধনের যন্ত্রমাত্র। তাই তিনি প্রত্যুত্তরে বলেছেন—“তৃথ্বার শূলে শিবতরাইকে বিদ্ধ করে তাকে তিনি উত্তরকূটের সিংহাসনের তলায় ফেলে যাবেন।” তখনই বিশ্বজগতের কণ্ঠে নাটকের চরম সত্যই ধ্বনিত হয়—“তবে তোমাদের পূজা পূজাই নয়, বেতন।”
দেবতার পূজা যখন বেতন হয়ে ওঠে, দেবতা যখন স্বার্থ-সাধনের উপকরণে পরিণত হন, তখন অহংকৃত যন্ত্ররাজ বিভূতি দেব পদবী অধিকারের চেষ্টা করেন, বলেন—“যন্ত্রের জোরে দেবতার পদ নিজেই নেব, এই কথা প্রমাণ করবার ভার আমার ওপর।” যন্ত্রের সাহায্যে দেবতা হয়ে ওঠার চেষ্টায়, নির্মিত মুক্তধারার বাঁধের ফলে কোনও চাষির কোনো ভুট্টার খেত নষ্ট হবে একথা ভাবার সময় তাঁর ছিল না। উত্তরকূটের বাঁধ নির্মাণে মজুর যখন অপ্রতুল তখন চণ্ডপত্তনের প্রত্যেক ঘর থেকে আঠারো বছর অতিক্রান্ত যুবকদের তিনি নিযুক্ত করেছেন বাঁধ নির্মাণে। তাদের অনেকেই শেষ পর্যন্ত ঘরে ফেরেনি। পুত্রহারা মাতা অম্বা, দৌহিত্রহারা বৃদ্ধ বটুর সেই হাহাকার পাঠককে আচ্ছন্ন করে ফেলে। বটু কান্নার সুরে বলে ওঠে—‘বলি দেবে নর বলি’। তার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে এটুকু সে বুঝেছে, ভৈরবের নামে শত শত যুবকের প্রাণ যে নেওয়া হয়েছে তা ভৈরব কিছুতেই অনুমোদন করবেন না।
প্রাণের পরিবর্তে যদি প্রাণ না মেলে, মৃত্যু দিয়ে যদি মৃত্যুকেই ডাকা হয় তবে ভৈরব এত বড়ো ক্ষতি সহ্য করবেন কেন? অম্বাও বুঝি নিজের অজ্ঞাতেই এক বিরাট সত্যবাক্য উচ্চারণ করে–“আমাদের পূজা বাবার কাছে পৌঁচচ্ছে না—পথের থেকেই কেড়ে নিচ্ছে। কে কেড়ে নিচ্ছে? যে আমার বুকের থেকে সুমনকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল সে। সে যে কে এখনও তো বুঝলুম না।”
উত্তরকূটের দেবতা ভৈরবের আসনে অধিষ্ঠিত হবার আকাঙ্ক্ষায় যন্ত্ররাজ বিভূতি মায়ের বক্ষ থেকে সন্তানকে ছিনিয়ে নিতেও দ্বিধা করেন না। বিভূতির মনোগত অভিপ্রায় এবং তার উক্তি নাটকে যেভাবে প্রকাশিত তা বিভিন্ন যান্ত্রিক প্রতীকে রূপায়িত আর অম্বা ভিন্ন জীবনদর্শনের প্রবক্তা। সে মঙ্গল, করুণা, মানবতা ইত্যাদি শুভবোধের প্রবক্তার ভূমিকায় সমাসীন। ধনঞ্জয় এবং অভিজিৎও তার জীবন সত্যকে ব্যক্ত করে। রবীন্দ্রনাথ জীবন এবং জীবন বিরোধী তত্ত্বকে ভৈরব মন্দির চূড়ার ত্রিশূল এবং অভ্রভেদী লৌহ যন্ত্রের মাথার প্রতীকে রূপায়িত করেছেন।