মধুসূদন দত্তের ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ প্রহসনে ইয়ংবেঙ্গলদের সভায় অনেকগুলি শব্দ উচ্চারিত হয়েছে। যেমন- হিয়র, হিয়র, আমি এ মোসন সেকেণ্ড করি, এতে দেখছি কারো অবজেকশন নাই, হিপ্ হিপ্ হরে হরে, ব্রাভো ব্রাভো, ব্রাভো হিয়ার ইত্যাদি। ঐ সমস্ত কথা দিনরাত সভায় উচ্চারণ করতে করতে নবকুমার ও তার সঙ্গীরা বাড়ীতেও ঐ সমস্ত শব্দ বলে ফেলতো। নবকুমারের ঘরে ব্র্যাণ্ডি আছে একথা জানালে কালীনাথ বলেছে ‘জষ্ট দি থিং’। নবকুমারের শয়নকক্ষে দ্বিতীয় অঙ্কের দ্বিতীয় গর্ভাঙ্কে যে দৃশ্যের উন্মোচন ঘটলো তার উক্তির প্রেক্ষাপটে নবকুমারের উপরি-উক্ত উক্তিকে অসংলগ্ন বলে মনে হলেও উক্তিটি কিন্তু যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ এবং এক অর্থে নবকুমারের অন্তর্গত ব্যক্তিসত্তার উন্মোচন। প্রহসনের ঘটনাটির আনুপূর্বিক অনুসরণ করলে মনে হবে উক্তিটি যথার্থ এবং অসংলগ্ন নয়।
নবকুমার ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী সভা’ থেকে মাতাল হয়ে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করলে এবং পত্নী হরকামিনীকে পয়োধরী মনে করে আলিঙ্গন করতে গেলে মাটিতে পড়ে যায়। হরকামিনী, প্রসন্ন প্রমুখরা ক্রন্দন করতে আরম্ভ করলে গৃহিণী প্রবেশ করেন এবং নবকুমারকে অবলোকন করে বলেন – ‘এ আমার সোনার চাঁদ যে মাটিতে গড়াচ্ছে’। নৃত্যকালী তার মুখে ‘বদগন্ধ বেরুচ্ছে’ বললে গৃহিণী পুনরায় বলেন- ‘ওমা এ কি সর্বনাশ! আমার দুধের বাছাকে কি কেউ বিষ টিস্ খাইয়ে দিয়েছে না কি? ও মা আমার কি হবে। এরপর প্রসন্নময়ীর সঙ্গে কর্তা প্রবেশ করেন। কর্তা ও গৃহিণীর মধ্যে যে সংলাপ হয় সেখানে কলকাতার নব্য সভ্যতা সম্পর্কে পাঠক/দর্শকের সবিশেষ ধারণা হয়।
নবকুমারের সংলাপ থেকে মনে হয় যে সে তার পিতার বক্তব্যকে সমর্থন করেছে। এই সমর্থন করার মধ্যে কি কোনো আপাতবিরোধিতা আছে? অথবা নবকুমার মনে করে যে পিতার সিদ্ধান্ত যথার্থ এবং সমর্থনযোগ্য। মনে হয়, আলোচ্য উক্তির মাধ্যমে অসংগতিজনিত হাস্যরসকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কথাটি হয়তো নবকুমার সভার চিন্তা ও রীতি অনুযায়ী সমর্থন করার কথা বলেছে। কিন্তু নবকুমারের বক্তব্যের মাধ্যমে তার পিতার বক্তব্যকেই সমর্থন জানানো হয়েছে; তৎকালীন নব্যযুবকদের কার্যকলাপকে নব সমর্থন করতে পারেনি। আর নবকুমারের এই সমর্থনকে তো একেবারে অস্বীকার করা যায় না। ইয়ংবেঙ্গলের স্বাধীনতার নামে যথেচ্ছাচারের প্রকৃত রূপটি ফুটিয়ে তুলে নাট্যকার পরিশেষে যেন একজন নব্য প্রতিনিধির মুখ দিয়েই এই ভয়ঙ্কর শহরের হাত থেকে মুক্ত হবার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করলেন। এমনকি প্রহসনের শেষে হরকামিনীর যে সর্বশেষ কটাক্ষ প্রকাশিত সেখানেও মধুসূদনের বক্তব্যই প্রকাশিত। প্রহসনকার তৎকালীন বাংলার নব্যযুবকদের উচ্ছৃঙ্খলতা, ভণ্ডামি, ঐতিহ্যের প্রতি অশ্রদ্ধা ইত্যাদি মনেপ্রাণে সমর্থন করতে পারেননি বলে পিতার বক্তব্যকেই সমর্থন জানিয়ে স্বীয় মতাদর্শ প্রকাশ করেছেন।
‘নবকুমারের এই উক্তি নাট্যকারের বিদ্রুপ রচনার সার্থক দৃষ্টান্ত। নবকুমার মদের ঘোরে ভাবছে, সে এখনো সেই জ্ঞানতরঙ্গিনী সভার অধিবেশনেই বসে আছে। তাই অস্পষ্ট কথা যা কানে যাচ্ছে তারই উত্তরে শেখানো বুলির মত সে কখনো উৎসাহবাচক ‘হিয়র হিয়র’, কখনো ‘আই সেকেণ্ড দি রেজোলুশন’ অর্থাৎ ‘আমি প্রস্তাব সমর্থন করি’ বলে চলেছে। এদিকে কর্তমশাই তার চরিত্রহীনতায় ও অধঃপতনে চরম আঘাত পেয়ে তখনই ঘোষণা করেছেন, তাঁর যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে। কালই পুত্রকে নিয়ে তিনি সপরিবারে শ্রীবৃন্দাবন যাত্রা করবেন। কোথায় মদ্য-আহার-বাইজী-খেমটা ষ্টত কলকাতার জ্ঞানতরঙ্গিনী সভার স্বাধীনতার দালান আর কোথায় ‘ওলডফুল’ এর শুষ্ক বৃন্দাবন। বেচারা নবকুমার। তার পিতার এই সিদ্ধান্ত মন দিয়ে শোনার মত অবস্থাও তার নেই। কারণ মদের নেশায় সে অর্ধ-অচেতন। তাই পিতার কথায় নেশাগ্রস্তভাবে বলেছে, ‘হিয়র হিয়র আই সেকেণ্ড দি রেজোলুশন’। ‘সাবাস আমি এই প্রস্তাব সমর্থন করি। অর্থাৎ নবকুমার নিজের দুর্ভাগ্যজনক পরিণাম নিজের অজ্ঞাতেই সমর্থন করেছে— এইখানেই উক্তিটির পরিহাসিক উদ্দেশ্য।