সমগ্র চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে ভাঁড়ু দত্ত স্বতন্ত্র এক মানব চরিত্র। ভাঁড়ু দত্ত সমগ্রকাব্যে স্বাতন্ত্রের দাবিদার তার কৌতুক প্রবণতার জন্য, দ্বিচারিতার জন্য, ষড়যন্ত্রের জন্য, কূটকৌশলের জন্য। ভাঁড়ু চরিত্রের মধ্যে প্রকাশ পায় স্বার্থরপতা, আত্মসুখ, যার জন্য অনায়াসে সে অন্যের ক্ষতি করতে প্রস্তুত। তার চরিত্রেও কপটতা ও অভিনবত্বের স্বাদ পাওয়া যায়।
ফুল্লরার নিকট ভাঁড়ু দত্ত : ভাঁড় দত্ত কূটকৌশলী, ষড়যন্ত্র লিপ্সু। ফুল্লরার কাছে গিয়ে সে কালকেতুর প্রতি উদার ভালোবাসার অভিনয় করে, যাতে করে আত্মগোপনকারী কালকেতুর সন্ধান পেয়ে কলিঙ্গরাজকে কাছে ধরিয়ে দিয়ে নিজের অপমানের প্রতিশোধ নিতে পারে। অনায়াসে ফুল্লরাকে মিথ্যা বাক্য বলেছে–
“কহিনু অনেক ন্যায় খণ্ডিল সকল দায়
ভয় কিছু না করিহ মনে।
মনে পেয়্যা পরিতোষ যে নিল সকল দোষ
বীরকে করিব সেনাপতি।।”
ফুল্লরাকে সে আরও বলেছে, সে কালকেতুকে গুজরাটে জায়গির দেবে, কালক্রমে ফুল্লরা ভাগ্যবর্তী হবে। সরল সাদাসিধে, কথার ঘোর পাচ না বোঝা ফুল্লরা তার স্বামীর ধান্যঘরে আত্মগোপন করার কথা বলে দেয়। ফুল্লরা একবারও বুঝতে পারল না পরিণাম কি হবে। কূট কৌশলী ভাঁড়ুর স্বার্থ চরিতার্থ হল।
ফুল্লরার নির্বুদ্ধিতায় কালকেতু বন্দী হল। দেবী চণ্ডিকার আশীর্বাদে আবার রাজ্য ফিরেও পেল। ততোদিন ভাঁড়ু দত্ত নিজেকে সম্পূর্ণ পাল্টে ফেলেছে নিজের স্বার্থ চরিতার্থতার জন্য।
কালকেতুর নিকট ভাঁড়ু দত্ত : নিজের প্রতিপত্তি বাড়ানোর জন্য ভাঁড়ু এখন বিনয়ী কালকেতুর কাছে সেজে ভেট নিয়ে এসেছে। কালকেতুর সম্মুখে এসে বলে-
“তুমি খুড়া হৈলে বন্দী অনুক্ষণ আমি কান্দি
বহু তোমার নাহি খায় ভাত।”
এই হল ভাঁড়ুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। মিষ্টি কথায় লোককে কীভাবে জালে জড়ানো যায়। কিন্তু কালকেতু আর কথায় ভুলবার পাত্র নয়। নিজের স্বার্থে ঘা লাগলে ভাঁড়ু দত্ত খোলস পাল্টে রণমূর্তি ধারণ করে। কালকেতু যখন তাকে মণ্ডল পদ থেকে বরখাস্ত করেছে তখন ভাঁড়ু ক্রোধের সঙ্গে বলেছে।
“যেখানে আমার খুড়া ঘোচালে মাশুলী।
দেখিয়াছি খুড়া হে তোমার ঠাকুরালী।।
তিন গোটা শর ছিল এক গোটা বাঁশ ।
হাটে হাটে ফুল্লরা পসরা দিত মাস।।”
ভাঁড়ু লোভী, স্বার্থপর, প্রতিহিংসাপরায়ণায়। কালকেতুর প্রত্যাখ্যানে তার দৃঢ় সংকল্প–
“হরি দত্তের ব্যাটা হই জয়দত্তের নাতি।
হাটে লয়্যা বেচাইব বীরের ঘোড়া হাতি।।
তবে সুশাসিত হবে গুজরাট ধরা।
পুনর্বার হাটে মাংস বেচিব ফুল্লরা।।”
ভাঁড়ু যে কত প্রতিহিংসা পরায়ণ তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত তার এই উক্তি।
পরিশেষে বলা যায়, ভাঁড়ু চরিত্র রক্তমাংসে গড়া। তার লোভ, ধূর্ততা, শঠতা তাকে জীবন্ত চরিত্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে এখানেই ভাঁড়ু দত্ত চরিত্রের বিশিষ্টতা।