বাংলাদেশের বিশেষ আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিতে যে পদগুলি রচিত হত তা বাঙালির জীবনের নানান দিক নিয়ে রচিত। শাক্ত পদাবলিতে বাংলাদেশের একটা মর্মবাণী প্রকাশ লাভ করেছে। প্রসঙ্গত হর- গৌরীর কাহিনি উল্লেখও হয়েছে।
শাক্তপদাবলিতে তন্ত্রসাধনার সাথে বাঙালির জীবনের মর্মকথাও অঙ্কিত হয়েছে। এই মর্মকথাটির দুটি ভাগ – (১) ‘দেবতারে প্রিয় করি প্রিয়েরে দেবতা’ বাঙালির এই – সমন্বয়ধর্মী মানসিকতা শাক্তপদে ব্যক্ত। বিভিন্ন পৌরাণিক চরিত্রের পারস্পরিক সম্পর্কে এ সত্য প্রকাশিত। (২) বাঙালি জীবনের তাৎপর্যপূর্ণ সত্তা হল অপার বাৎসল্য। এই মর্মকথাটি শাক্তপদে প্রকাশিত হয়েছে। বাঙালি সাধক কবিদের সঙ্গে দেবীর ঐকান্তিক সম্পর্কটি এই সত্যের প্রকাশক। অর্থাৎ সমন্বয়ধর্মী মানসিকতা ও বাৎসল্যরসে উৎভাসিত বাঙালি জীবনের মর্মকথাটি শাক্তপদাবলির মূল উপজীব্য বিষয়।
‘দেবতারে প্রিয় করি প্রিয়েরে দেবতা–এই বাণীর জীবন্ত চিত্র ফুটে উঠেছে আগমনী বিজয়া পদে শিব-ঊমা-মেনকা গিরিরাজের মধ্যে। বাঙালির মধ্যে যে আধ্যাত্মিকতা আছে এবং মানবিক বেদনাও আছে তার প্রকাশও ঘটে। আধ্যাত্মিক অনুভূতিকে ছাপিয়ে বাঙালি ঘরের জামাতা-কন্যা-মাতা-পিতারূপে শাক্তপদে শিব-উমা-মেনকা-গিরি প্রতিভাত। এখানে মেনকা-স্নেহব্যাকুলা মাতা, গিরিরাজ স্নেহপরায়ণ অথচ গম্ভীর প্রকৃতির বাঙালি পিতা, শিব হয়ে উঠেছেন সংসারে উদাসীন বাঙালি জামাতা। আর উমা ভাগ্যবিড়ম্বিতা অভিমানিনী কন্যা। প্রসঙ্গানুসারে মেনকার কথা আলোচনা করতেই হয়; মেনকা যেন স্নেহময়ী, দয়াময়ী, করুণাময়ী, মমতাময়ী বাঙালি মাতা। উমাকে পিতৃগৃহে আনয়নের প্রসঙ্গে গিরিরাজকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন–
“আছে কন্যা সন্তান যার দেখতে হয়, আনতে হয়
সদাই দয়ামায়া ভাবতে হয় হে অন্তরে।”
বাঙালি মাতার যে অস্থিরতা কন্যাকে নিয়ে তা প্রতিফলিত করেছে।
এরপর স্বপ্নে উমার শ্মশানবাসিনী, অট্টহাসিনী রূপ দেখে মেনকার মধ্যে যে প্রতিচ্ছবি প্রস্ফুটিত হয়েছে তাতেও মর্মকথা প্রকাশ পেয়েছে –
“কুস্বপন দেখেছি গিরি, উমা আমার শ্মশানবাসিনী
অসিতবরণা উমা মুখে অট্টঅট্ট হাসি।”
এখানে প্রিয় দেবতা হয়ে উঠেছে। গিরিরাজ স্থির সংযতবাক অথচ স্নেহপরায়ণ ও গম্ভীর প্রকৃতির বাঙালি পিতার ন্যায় প্রতিয়মান। কন্যার প্রতি অসীম মমত্ববোধ তারও আছে, কিন্তু তিনি যুক্তিবাদী—
“বারে বারে কহ রাণী গৌরী আনিবারে।
জানত জামাতার রীত অশেষ প্রকারে।
বর ত্যাজিয়ে মণি ক্ষণেক বাঁচয়ে ফণী ;
ততোধিক শূলপাণি ভাবে উমা মারে।”
শিবকে শূলপানি সম্বোধনের মধ্যে প্রিয়কে দেবতা করার মানসিকতাটি প্রস্ফুটিত।
পিতৃগৃহে গমনের জন্য উমা শংকরের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করেছেন। পিতা স্বয়ং এসেছেন তাঁকে নিয়ে যাবার জন্য। মা মেনকা দিবারাত্র কান্নাকাটি করছেন। উমা পিতৃগৃহে গমনের অনুমতির সাথে সাথে “আসব পুনঃ, শীঘ্র গতি” শীঘ্র প্রত্যাবর্তনের প্রতিশ্রুতি প্রদানের মধ্য দিয়ে বাঙালির মর্মকথা উদ্ভাসিত। ‘গঙ্গাধর হে শিবশঙ্কর কর অনুমতি হর’ ঊমার এই প্রার্থনায় প্রিয় রূপের মধ্যে দেবত্ব মিশে গিয়ে বাঙালি জীবনের মর্মকথার উজ্জ্বল প্রকাশও ঘটেছে। শিব উমাকে অনুমতি প্রদান করে বলেন–
“জনক-ভবনে যাবে, ভাবনা কি তার?
আমি তব সঙ্গে যাব, কেন ভাব আর।
আহা আহা মরি মরি, বদন বিরস করি,
প্রাণাধিকে প্রাণেশ্বরি, কেঁদো নাকো আর।”
ঊমা এবং মহাদেব দেবত্ব হারিয়ে বাঙালির অভিমানিনী কন্যা এবং সংসার উদাসীন জামাতারূপে প্রতিষ্ঠিত অন্যদিকে জামাতার মধ্যেও দেবত্ব আরোপিত হয়েছে—‘শিবকে পূজরে বিল্বদলে, সচন্দন আর গঙ্গাজলে’ মেনকার এ উক্তিতে।
বাৎসল্য চেতনা প্রকাশে বাঙালি জীবনের মর্মকথাটি প্রকাশিত হয়েছে। এই চেতনার সূত্রে পৌরাণিক দেবী কল্যাণী জগজ্জননীতে রূপান্তরিত হয়েছে। এই রূপাত্তর মূলত মাতৃত্বের বাৎসল্য ভাবনার বহিঃপ্রকাশের মধ্য দিয়ে। ভক্তের আকৃতি পর্বে শক্তিদেবীর বাৎসল্যময়ী সে মাতৃকারূপটি প্রকাশিত –
“মা খেলবি বলে ফাঁকি দিয়ে নাবালে ভূতলে।
এবার যে খেলা খেললে মাগো আশা না পুরিল ॥
রামপ্রসাদ বলে ভবের খেলায় যা হবার তা হল।
এখন সন্ধ্যাবেলায় কোলের ছেলে ঘরে নিয়ে চল।”
দেবীর প্রতি এই আদর আবদারের মধ্যে বাঙালি জীবনের মর্মকথাটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মা ও ছেলের আহ্লাদের বাৎসল্য প্রকাশিত হয় এভাবে –
“মা আমায় ঘুরাবি কত
কলুর চোখ ঢাকা বলদের মতো।”
অতএব হরগৌরীর প্রসঙ্গ অল্প হলেও বাঙালির জীবনে তাঁদের স্থান শীর্ষে। এবং বিচারবিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শাক্তপদাবলি কেবলমাত্র এক বিশেষ ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষের আধ্যাত্মিকতা ও সিদ্ধিপ্রাপ্তির তত্ত্বকথা নয় এর মধ্যে বাঙালির নিজস্ব মর্মকথা অঙ্কিত হয়েছে।