বৈষ্ণব কবিদের পদাবলী বিশ্লেষণ করলে সহজেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, পদকর্তাগণ মানব প্রেমের বিচিত্র লীলা, প্রেমিক প্রেমিকার চিত্তলোকে বিচিত্র ভাবের স্পন্দন, অপরূপ রমণীর ভাষায় লিপিবদ্ধ করেছেন। পদাবলীতে বর্ণিত রাধা-কৃষ্ণের প্রণয় লীলার চিত্র মানব প্রণয়ের রূপ-সৌন্দর্যে গঠিত। কিন্তু এইরূপের অন্তরালে অরূপআকুতির সুর ধ্বনিত অর্থাৎ মানব প্রেমের পটভূমিকায় বিশ্বপ্রেমের লীলা-সঙ্গীত চিত্রিত। বিশিষ্ট সমালোচক বলেছেন— “রাধিকার বয়ঃসন্ধি হইতে আরম্ভ করিয়া তরুণীর প্রেমচাঞ্চল্য প্রেমের নিবিড়তা ও গভীরতা মিলন বিরহ, মান অভিমান প্রভৃতি যাহা কিছু বর্ণনা, বৈশ্বব কবিতার উপরে পাওয়া যায়, পার্থিব নায়িকাকে অবলম্বন করিয়া এই জাতীয় প্রেমের বর্ণনা পূর্ববর্তী কাব্য প্রতিভার ভিতর বর্তমান।” পদাবলী কাব্যে নারী পুরুষের হৃদয়ধারার এই যে সূক্ষ্মাতি সূক্ষ্ম স্পন্দন তার আসল কারণ নিহিত আছে বৈব কবিদের ভূমিকায়, যেখানে তারা প্রেম মনস্তত্ত্বের রূপকার।
বৈষ্ণব পদাবলীর প্রেমের বিচিত্রতার আস্বাদ গ্রহণের জন্য বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস জ্ঞানদাসও গোবিন্দ দাসের কবিতা বিশেষ স্মরণযোগ্য। এই সকল পদকর্তাদের কবিতা বিশ্লেষণে দেখা যায় তাঁরা ঐশীপ্রেমের ব্যঞ্জনা সঞ্চার করে তার মধ্যে মানবীয় প্রেমের ভাব পরিস্ফুট করে পাঠকচিত্তকে রাসানুভূতির স্তরে উত্তীর্ণ করেছেন।
বিদ্যাপতি : মিথিলার রাজসভার সাথে যুক্ত ছিলেন বলেই প্রাকচৈতন্যযুগের বিশিষ্ট পদকর্তা বিদ্যাপতি তাঁর কাব্যে নাগরিক বৈদগ্ধ বিলাসপ্রবণতা, জটিল জীবনবোধ, মার্জিত আচরণ প্রভৃতির প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। কাব্য সৌন্দর্য সৃষ্টির সুন্দর সম্ভাবনাকে স্বীকার করেই তিনি রাধাকৃষ্ণ পদাবলী রচনায় আপন প্রতিভা নিয়োগ করেছিলেন। বিরহ, অভিসার, ভাব সম্মেলন, প্রার্থনা প্রভৃতি পদে রাধা চরিত্রের যেভাবে প্রকাশ ঘটেছে তা অনেকখানি যেন পরিচিতা মর্ত্য জগতের নারীচরিত্রেরই প্রতিরূপ। পূর্বরাগের পদে রাধিকা দৈহিক হিন্দোল ও কটাক্ষের তীক্ষ্ণতায় অনন্যা। বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্যদিয়ে বিদ্যাপতির রাধা ধীরে ধীরে বিকশিত যৌবনা, অভিজ্ঞা নারীতে রূপান্তরিতা। দেহ ও মনে তার যে উচ্ছ্বাস, বয়ঃসন্ধির পদেই তা প্রকটিত।
প্রেম-মনস্তত্ত্বের একজন সুনিপুণ রূপদক্ষ শিল্পীরূপে বিদ্যাপতি তাঁর রাধাকে বিশ্ব বাসনার প্রতীকরূপে যে অঙ্কন করেছেন তা বিরহ পদে রাধার বিরামহীন ক্রন্দনে প্রকাশিত।
“এসখি হামারি দুখের নাহি ওর
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর।”
এই গানে বিস্ময়ে সচকিত ও পুলকিত হতে হয় কিংবা ভাব সম্মেলন পদে বিদ্যাপতির রাধা যখন শ্যামের গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে গেয়ে ওঠেন তখন পাঠক চিত্ত দোলায়িত হয়।
“আজুরজনী হাম ভাগে পোহায়লু
না পেখলু পিয়ামুখচন্দা।
জীবন যৌবন সফল করি মানুলু
দশদিক ভেল নিরদ্বন্দ্বা।।”
চণ্ডীদাস : চিরনতুন অথচ চির পুরাতন প্রেমগীতির মন্ত্র উচ্চারণে চণ্ডীদাসের একাধিপত্য সর্বজন স্বীকৃত। তাঁর পদ শুধু রাধাকৃষ্ণের প্রেমগাথা নয় তা বিশ্বের চিরন্তন প্রেমগাথা। বিশেষত আক্ষেপানুরাগে চণ্ডীদাস প্রেমমনস্তত্ত্বের সুনিপুণ রূপকার। তাঁর রাধা আমিত্বকে বিলুপ্ত করে পরম পুরুষের প্রতি আত্মা সমর্পণের জন্য যখন গেয়ে ওঠেন—
“বঁধু, কি আর বলিব তোরে
অল্প বয়সে পিরীত করিয়া
এতো দুখ দিলি মোরে।”
‘চণ্ডীদাস গভীরতম প্রেমবেদনার গীতিকার।” প্রেমাস্পদের চরণে আত্মোৎসর্গীকৃত রাধা গেয়ে ওঠেন—
“বঁধু তুমি যে আমার প্রাণ
দেহ মন আদি তোমাতে সঁপেছি
কুলশীল জাতি মান।”
‘পূর্বরাগ’ পর্যায়ে রাধা সখীদের মুখে কৃষ্ণনাম শুনে কৃষ্ণের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন—
“সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম
কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো
আকুল করিল মন প্রাণ।”
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সোচ্চার কণ্ঠে বলেছেন— “চণ্ডীদাস বেদনার কবি, মিলনের মাঝেও চণ্ডীদাসের রাধা হৃদয় বিরহের ম্লান ছায়াপাতে কম্পমান।”
জ্ঞানদাস : চৈতন্য পরবর্তী কবি হলেন জ্ঞানদাস। চরম সাধনা-সিদ্ধ দেহে গোপবিশ্বকারীর মূর্তিধ্যান করে, বৃন্দাবনে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা দর্শন করে, সঙ্গীত মাধ্যমে তা ব্যক্ত করেছেন। রাধার জবানিতে তিনি যখন গেয়ে ওঠেন—
“আলো মুঞি জানো না-
জানিলে যাইতাম না কদম্বের তলে।
চিত মোর হরিয়া নিলে কালিয়া নাগর ছলে।।
তখন জ্ঞানদাসকে রূপদক্ষ শিল্পী হিসাবে মেনে নিতে কোনও সংশয় থাকে না। মিলনের আকুলতা জ্ঞানদাসের মধ্যে যেমন লক্ষণীয় অন্য বৈষ্ণব কবিদের মধ্যে এমনটি নেই। তাইতো আক্ষেপানুরাগে জ্ঞানদাসের রাধা এমনভাবে বলতে পেরেছেন—
“সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু
অনলে পুড়িয়া গেল।
অমিয়া-সাগরে সিনান করিতে
সকলি গরল ভেল।।”
গোবিন্দদাস : চৈতন্যোত্তর যুগের শ্রেষ্ঠ পদ-কর্তা গোবিন্দদাস। ইনি বৈব সাহিত্যে প্রেম মনস্তত্ত্বের সুদক্ষ রূপকার। পূর্বরাগ, অনুরাগ বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখলেও অভিসার-পদে তাঁর প্রতিভা শিখরতুল্য। পার্থিব প্রেমের গভীর শিহরণ অতিক্রম করে আত্মনিবেদনের আধ্যাত্মিক সুর-মূৰ্চ্ছনা তাঁর অভিসার পর্যায়ে বর্ণিত হয়েছে—
“কণ্টক গাড়ি কমলসন পদতল
মঞ্জুির চিরহী ঝাঁপি।”
এই পদ-পাঠে বিস্ময়ে কণ্টকিত হতে হয়। প্রশ্ন জাগে একি কোন দেবীর নামর্ত্য মানবীর চিত্তদীণ তৃষ্মার্ত পদ ? এর মধ্যদিয়েই প্রকাশিত গোবিন্দদাসের কৃতিত্ব এবং তিনি যে মানব-মানবীর সূক্ষ্ম প্রেম-বিশ্লেষণের সুদক্ষ রূপকার তা মানতেই হয়।
বৈষ্ণব পদকর্তাগণ কেবল যে আধ্যাত্ম সাধনায় নিমগ্ন থেকে কালাতিপাত করেননি তার প্রমাণ তাঁদের পদরচনা। মর্ত্য মানবমানবীর বুভুক্ষ চিত্তের যথাযথ সংবাদ পরিবেশনে তাঁরা ছিলেন সদাই তৎপর। তাই সমালোচকদের দৃষ্টিতে বৈষ্মব পদকর্তারা প্রেম-মনস্তত্ত্বের সনিপুণ রূপকার। এই রূপায়ণ শুধু পার্থিব নয়, চিরকালীন আধ্যাত্মিক সাধনা ও আকুতি তাতে বিশেষভাবে প্রকট। বিশ্বসাহিত্যে অন্য কোথাও অপরূপ প্রেমের ঠিকানা আছে বলে মনে হয় না।