ছদ্মবেশিনী চণ্ডী ও ফুল্লরা
স্বামী মহাদেবের সহিত ঝগড়া করে দেবী পার্বতী তথা চণ্ডী যখন পতিগৃহ কৈলাস ত্যাগ ক’রে যেতে চাইলেন, তখন তার সখী পদ্মাবতী তাকে মর্ত্যলোকে তার পূজা প্রচার করবার পরামর্শ দিল দেবী স্থির করলেন যে মর্ত্যলোকে তার পূজা প্রচারের জন্য বাহন করবেন একটি ব্যাধসস্তানকে। তদনুযায়ী তিনি মহাদেবের সাহায্য নিয়ে ইন্দ্রপুত্র নীলাম্বরকে শাপগ্রস্ত ক’রে মর্ত্যলোকে পাঠালেন ব্যাধ-পুত্র কালকেতুরূপে। নীলাম্বরের পত্নী ছায়াও মর্ত্যলোকে ফুল্লরারূপে জন্মগ্রহণ করেন। কালে কালকেতুর সঙ্গে ফুল্লরার বিয়ে হ’ল। সংসারযাত্রা নির্বাহের জন্য কালকেতু বনের পশুদের ওপর অকথ্য অত্যাচার আরম্ভ করলে বিপন্ন পশুরা দেবী চণ্ডীর শরণ গ্রহণ করে। দেবী চণ্ডী পশুদের অধিষ্ঠাত্রী দেবী – তিনিই পূর্বে সিংহকে পশুদের রাজা করে দিয়ে তাদের অভয় দান করেছিলেন। এবারও পশুদের কাতর ক্রন্দনে বিচলিত হ’য়ে তিনি তাদের অভয় দান ক’রে এর প্রতিকারে সক্রিয় হ’লেন। দেবী মায়ার সাহায্যে বনের পশুদের লুকিয়ে রেখে স্বয়ং এক সুবর্ণ গোধিকার বেশ ধারণ ক’রে বনের প্রবেশ পথে পড়ে রইলেন। কালকেতু সেদিন শিকারে ব্যর্থ হয়ে এই গোধিকাকেই ধনুকের ছিলায় ঝুলিয়ে বাড়ি নিয়ে এসে পাষাণ চাপা দিয়ে রেখে হাটে চলে গেল এবং ফুল্লরাকে পাঠালো তার সখির বাড়িতে কিছু চাউল ধার ক’রে আনতে।
ঘরে কেউ নেই, এই অবসরে দেবী চণ্ডী গোধিকার বেশ ত্যাগ করে ষোড়শীর বেশ ধারণ করলেন –
‘হুঙ্কারে ছিণ্ডিয়া দড়ি পরিয়া পাটের শাড়ি
বোল বৎসরের হৈল রামা।’
খঞ্জন-গঞ্জন আঁখি, অকলঙ্ক শশীমুখী এই ষোড়শী রূপসী মদনমোহন রূপ ধারণ ক’রে তদুপযোগী সাজ-সজ্জাও ক’রে নিলেন।
এর পর কাঁচুলী নির্মাণের জন্য দেবী দেবশিল্পী বিশ্বকর্মাকে স্মরণ করলে বিশ্বকর্মা কাঁচুলী নির্মাণে প্রবৃত্ত হ’লেন। সেই কাঁচুলীতে দশাবতার কাহিনী, শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবনলীলা-কাহিনী, বিভিন্ন মুনিঋষি, পশুপাখি, সরীসৃপ ও বৃক্ষাদির চিত্র অঙ্কিত হ’ল। দেবী চণ্ডী ষোড়শী রামারূপে কালকেতুর ঘর উজ্জ্বল ক’রে বসে রইলেন, এমন সময় সখীর বাড়ি থেকে ফুল্লরা ঘরে এসেই থমকে দাঁড়ালো। প্রথমেই সে এই নারীকে প্রণাম করে তাঁর পরিচয় জানতে চাইলে দেবী দ্ব্যর্থবোধক ভাষায় তার উত্তর দিলেন। ফুল্লরা বুঝলো—ইনি ব্রাহ্মণকন্যা, ঘোষাল বংশে এঁর জন্ম, শ্বশুরকুল বন্দ্যবংশ এঁর ঘরে আছে সাত সতীন, ইনি ফুল্লরার গৃহে আশ্রয় চান—
‘তুমি গো ফুল্লরা যদি দেহ অনুমতি।
এই স্থানে কতেক দিন করিব বসতি।।’
এই কথা শুনে ফুল্লরার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। ফুল্লরা হৃদয়ে বিষ কিন্তু মুখে মধু নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে লাগলো। ফুল্লরা প্রথমেই তার রূপের বিস্তৃত বর্ণনায় তার বিস্তর প্রশংসা ক’রে জানতে চাইল, কী কারণে তিনি স্বামীগৃহ ত্যাগ ক’রে এমনভাবে একলা ঘুরে বেড়াচ্ছেন—
‘শাশুড়ী ননদ কিবা কৈল মন্দ
স্বরূপে বল না বাণী।
তোর বিরহ জ্বরে স্বামী যদি মরে
কোন ঘাটে খাবে পানী।।’
ছদ্মবেশিনী চণ্ডী উত্তরে জানালেন যে তার ঘরে বড় জ্বালা। স্বামী জন্মভিখারী, গঙ্গা নামে সতীন সর্বক্ষণ স্বামীর মাথায় চড়ে আছেন, সে বড় স্বামী সোহাগিনী; তাই পতির দোষ দেখে এই রমণী ঘর ছেড়ে এলেন স্বামী বিষণ্ঠ, পঞ্চমুখে শুধু গালি দেয়, এর পর রয়েছে সতীনের জ্বালা এরই ফলে তাঁর দেহ কালী হ’য়ে গেছে। তারপর তিনি ফুল্লরাকে বলেন—
‘খাও পর যত তুমি সকল জোগাব আমি
মোরে তুমি না ভাবিহ ভিন্।
সমরে কানন ভাগে থাকিব বীরের আগে।
আজি হৈতে সম্পদের চিন্।।’
এই গৃহে থাকার ব্যাপারে রমণীর সীমাহীন আগ্রহ দেখে ফুল্লরা এবার নানাপ্রকার হিত কথা বলতে আরম্ভ করে। স্বামীই যে বনিতার গতি ও বিধাতা, তার সন্তুষ্টিবিধানই যে নারীর পরম ধর্ম–এই সত্য ফুল্লরা বোঝাতে চেষ্টা করলো সীতা এবং পরশুরাম-জননী রেণুকার কাহিনী বর্ণনা করে। অতএব এ নারী স্বামী ছেড়ে কেন প্রবাসে এলো ফুল্লরা তাকে বুদ্ধি দেয়—
‘সতিনী কোন্দল করে দ্বিগুণ বলিবে তারে
অভিমানে ঘর ছাড় কেনি।
কোপে কৈলে বিষপান আপনি ত্যজিবে প্রাণ
সতিনের কিবা হ’বে হানি।।’
ফুল্লরার কথা শুনে দেবী কোন উত্তর করলেন না, তাঁকে নিরুত্তর দেখে ফুল্লরা উৎসাহিত হয়ে বিভিন্ন পুরাণকাহিনী বর্ণনা করে ষোড়শীর মনে পতিভক্তি-উদ্দীপনে সচেষ্ট হ’ল। সে বিশেষভাবে মাওব্য মুনি ও বেদবতীর কাহিনী বর্ণনা ক’রে উপদেশ দিল—
‘ভালে ভালে গৃহে লড় ভুলিয়া ভবন ছাড়
পতি লয়্যা কর গিয়া বাস।’
এ সমস্ত শুনে দেবী উত্তরে বললেন—
‘আছিলাম একাকিনী বসিয়া কাননে।
আনিয়াছে তোর স্বামী বান্ধি নিজগুণে।।
হয় নয় জিজ্ঞাসা কর যায়্যা বীরে।
যদি বীর বলে তবে যাব স্থানান্তরে।।’
ফুল্লরা তখন ভাবলো, ভালো কথায় এ নারী ভিজবে না। অতএব তার অভাব-অনটন ও দুঃখের কাহিনী সাত কাহন ক’রে বল্লে যদি এ ভয় পেয়ে পালায়, এই ভরসায় ফুল্লরা তার বারমাসের কাহিনী বলতে আরম্ভ করে। এ কাহিনীতে তার সংসার জীবনের দুঃখ-দুর্দশার অতিশয় বাস্তব ও বিশদ বর্ণনা থাকা সত্ত্বেও যখন দেবী তাকে ভরসা দিয়ে বলেন—
‘আজি হৈতে মোর ধনে আছে তোর অংশ।’
তখন ফুল্লরা প্রমাদ গণে ভাবলো যে এঁকে তাড়ানো তার কর্ম নয়। এই ভেবে ফুল্লরা গেল গোলাহাটে, যেখানে কালকেতু মাংস বিক্রি করতে গেছে। সেখানে গিয়ে ফুল্লরা জিজ্ঞেস করে—
‘কাহার ষোড়শী কন্যা আনিয়াছ ঘরে।….
শিয়রে কলিঙ্গ রাজা বড়ই দুর্বার।
তোমারে বধিয়া জাতি লইবে আমার।।’
উত্তেজিত কালকেতু ঘরে ফিরে এসে ষোড়শী রমণীকে দেখতে পেয়ে সবিনয় নমস্কারে নানা পুরাণকাহিনী বর্ণনা করে তাঁকে ঘরে ফিরে যেতে অনুরোধ করলো। কিন্তু দেবীকে নিরুত্তর দেখে ক্রোধে কালকেতু ধনুর্বাণ হাতে নিয়ে বললো—
‘ছাড় এই স্থান মাগো ছাড় এই স্থান।
আপনি রাখিলে রহে আপনার মান।।’
কিন্তু এতেও দেবী নিরুত্তর থাকলে কালকেতু শরসন্ধান করে, কিন্তু শর হাতেই রয়ে গেলো দেখে কালকেতু হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। দেবী তখন নিজ পরিচয় দিয়ে বলেন—
‘আইনু পার্বতী আমি তোরে দিতে বর।’
এই বলে তিনি কালকেতুর দুঃখকষ্ট দূর করবার উদ্দেশ্যে মাণিক্যের অঙ্গুরী দিতে চাইলে কালকেতু বলে—
‘আশ্বিনে যেমন বেশে পূজা নিলা সর্বদেশে
দেখাইয়া পুর মোর সাধ।’
দেবী তখন দশভুজা মহিষাসুরমর্দিনী রূপ ধারণ করলে সেই রূপ দেখে কালকেতু-ফুল্লর মূর্ছিত হয়ে পড়ে। দেবী তাদের মূর্ছা দূর করে মাণিক্যের অঙ্গুরী দিলে ফুল্লরা নিষেধ ঝ’রে বলে—
‘একটি অঙ্গুরি নিয়ে হবে কোন্ কাম।
সারিতে নারিবে প্রভু ধনের দুর্নাম।।’
ভক্তের অধীনা ভগবতী তখন বাধ্য হয়ে তাদের সাত ঘড়া ধন পাইয়ে দিয়ে বল্লেন, এই ধনের সাহায্যে চণ্ডীর দেউল নির্মাণ ক’রে তারা যেন বিধানমতো চণ্ডীর পূজা করে এবং গুজরাট নগর পত্তন করে তথায় কালকেতু রাজা হয়ে বসে–এই বলে তিনি অন্তর্ধান করলেন।
চণ্ডী ও ফুল্লরার কথোপকথনের মধ্য থেকে চণ্ডীর একটি পরিহাস রসিক অথচ সহৃদয় মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। তার দ্বার্থ-বোধক পরিচয়-দানেও তার সত্য স্পৃহা, মানবিকতাবোধ ও রসিকতাবোধের পরিচয় বর্তমান। ফুল্লরার কথায় তার বুদ্ধিমত্তা, চাতুর্য ও স্বামিপ্রেমেরও যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। তবে ফুল্লরার মতো ব্যাধ-রমণী মুখে সীতা, মাণ্ডব্যপত্নী প্রভৃতির কাহিনী বড় বেমানান। বারমাস্যায় অসাধারণ বাস্তবতাবোধের পরিচয়ও বর্তমান। তবে এতে অভাব-অনটনের চিত্রই রয়েছে ফুল্লরার দুঃখবোধের নয়। দুঃখবোধটা আরোপিত।