ভাড়ুদত্তের চরিত্র
সমগ্র প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তী অঙ্কিত ‘ভাড়ুদত্ত’ সজীব চরিত্র হিসেবে এক অনন্য দৃষ্টান্তরূপে পরিচিত। একালের সাহিত্য সমালোচকদের প্রায় সকলেই মন্তব্য করেছেন যে একালে জন্মালে কবিকঙ্কণ একজন কবি না হ’য়ে ঔপন্যাসিক হ’তেন। কারণ উপন্যাসের প্রধান দু’টি লক্ষণ–বাস্তবতা ও চরিত্র সৃষ্টি– কবির চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে এত সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে, তার তুলনা সেকালে নেই, অনেকের মতে একালেও খুব সুলভ নয়। অধ্যাপক প্রমথনাথ বিশী বলেন: “কবিকঙ্কণ চণ্ডীকে উপন্যাস না বলা গেলেও উপন্যাসের প্রধান লক্ষণ দুটি তাহাতে আছে, বস্তুনিষ্ঠা ও নির্মমতা… কোনো কোনো চরিত্র-চিত্রণে কবি বস্তুনিষ্ঠা ও নির্মমতার চরম করিয়া ছাড়িয়াছেন। এমন একটি বোধ করি, একমাত্র চরিত্র ভাদ্ভদত্ত, অদ্ভুত একমাত্র মনুযাচরিত্র। কারণ কবিকঙ্কণ পশুসমাজের যে চরিত্র আঁকিয়াছেন তাহাও বস্তুনিষ্ঠ।”
ভাড়দত্ত ছিল কলিঙ্গরাজের প্রজা। প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টি ও বন্যায় কলিঙ্গের প্রজারা যখন বুলান মণ্ডলের উদ্যোনে কলিঙ্গ ত্যাগ ক’রে কালকেতুর সদ্য প্রতিষ্ঠিত গুজরাট নগরে যাবার কথা ভাবছিল, তখন ভাড়ুদত্ত আপত্তি জানিয়েছিল। কিন্তু বুলান মণ্ডল যখন তাকে ভরসা দিল—
‘তেসনী ইনাম পাব গুজরাটপুর।
আগুয়ান তোমার প্রজা, তুমি সে ঠাকুর।।’
তখন ভাড়দত্তই সবার অগ্রগামী হ’য়ে কালকেতুর রাজ্য গুজরাটে এসে উপনীত হল। ভাড়ুদত্তের প্রথম আবির্ভাবটি স্মরণীয় করে রেখেছেন কবিকঙ্কণ নিম্নোক্ত বর্ণনায়—
‘ভেট লয়্যা কাঁচকলা পশ্চাতে ভাড়ুর শালা
আগে ভাড়ুদত্তর পয়ান।
ভালে ফোঁটা মহাদস্ত ছেঁড়া ধুতি কোঁচা লম্ব
শ্রবণে কলম খরশাণ।।’
এই সামান্য বর্ণনাটি অসামান্য হ’য়ে ভাড়ুর চরিত্রটিকে ত্রিমাত্রিক ক’রে তুলেছে। রাজদর্শনে কাঁচকলার মতো অতি সামান্য অথচ হাস্যকর বস্তুকে ভেট নিয়ে যাওয়া, কপালে ফেঁাটা কেটে আপন ব্যক্তিত্ব ও গর্বপ্রচারের প্রচেষ্টা, ছিন্নবস্ত্র সত্ত্বেও লম্বা কোচার বাহার এবং সর্বোপরি কানে কলম গুজে মসীজীবী তথা বুদ্ধিজীবীরূপে নিজেকে পরিচিত করবার চেষ্টায় ব্যক্তিচরিত্রটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে–বোঝা যায় ভাঁড়ু একজন ভাড়ও (এবং ভণ্ডও) বটে। সে প্রথমেই কালকেতুর সঙ্গে খুড়া সম্পর্ক পাতিয়ে নিজের বংশ পরিচয় দিয়ে কালকেতুকে বিভ্রান্ত করে দিতে সচেষ্ট হয়। তার ভরসা অনার্য ব্যাধ-সস্তান কালকেতু বংশ পরিচয়ের দুর্বোধ্যতাহেতু সহজে বশ মানবে।
ঠকানো বিদ্যায় আগেই কলিঙ্গরাজ সভায় ভাড়ুদত্তের হাতে খড়ি হয়েছিল বলে অনুমান করতে পারি। অধ্যাপক বিশী ভাঁড় সম্বন্ধে বলেছেন, ভাঁড়ু অত্যস্ত ‘মর্ডান’, তাহার মাসতুতো ভাই আলালের ঘরের দুলালের ‘ঠকচাচা’। তাই প্রথম থেকেই সে কালকেতুকে প্রজা ঠকানোর পরামর্শ দিতে লাগলো –
‘যখন পাকিবে খন্দ পাতিবে বিষম দ্বন্দ্ব
দরিদ্রের ধনে দিবে নাগা।’
কালকেতু প্রথমেই বুলান মdলকে প্রধান রূপে গ্রহণ ক’রেছিল, এটি ভাড়ুর মনঃপুত হয়নি। তাই বুলানের বিরুদ্ধেও কালকেতুকে কানভাঙানি দিতে লাগল। কালকেত দরিদ্র ব্যাধের সস্তান, প্রজা-শাসন-আদি ব্যাপার তার জানা নেই, কাজেই তার পক্ষে কী উচিত কী অনুচিত, ঠিক বুঝতে না পেরে চুপ ক’রে রইল।
নানা জাতির প্রজার আগমনে গুজরাট নগর মুখর হয়ে উঠলো। এত লোকজন তাদের প্রয়োজন মেটাবার জন্য হাট বসানো হ’ল। ভাঁড়ও ভাবলো, প্রথম থেকেই হাটের দখল নিতে হবে, তাই প্রথম থেকেই সে হাটে জোর-জবরদস্তি ক’রে তোলা তুলতে লাগলো, কারোর আপত্তি সে কানে তোলে না—
‘লিণ্ডে ভণ্ডে গালি দেই করে শালা শালা।
আমি মহামণ্ডল আমার আগে তোলা।…
যত যত দ্রব্য লয় নাহি দেয় কড়ি।
পসার লুটিয়া ভাঁড়ু ভরয়ে চুপড়ি।।’
ভাঁড়ুর উপদ্রবে প্রজা এবং হাটুরেরা অতিষ্ঠ হয়ে কালকেতুর কাছে নালিশ জানালো। কালকেতু দরিদ্র অবস্থায় জীবন কাটিয়েছেন, কাজেই দারিদ্র্যের মর্মস্থালা তার অজানিত নয়। তাই দরিদ্র হাটুবেদের প্রতি স্বাভাবিক সহানুভূতির কারণে সে ভাডুকে ডেকে তার কৈফিয়ত তলব করলো। ভাড়ুদত্ত আত্মপক্ষ সমর্থনে জানায়— ‘পরম্পরা আছে মোর মশুলিয়া তোলা।’ কালকেতু এত বেশি মণ্ডল-মাহাত্ম্য জানা নেই—তাই সে বলে—
‘প্ৰজা নাহি মানে বেটা আপনি মণ্ডল।
নগর ভাসিলি ঠকা করিয়া কোন্দল।।’
কটুক্তি শুনে কালকেতু তাকে তাড়িয়ে দিলে তর্জনগর্জন ক’রে ভাড়ুদত্ত জানালো—
‘হরিদত্তের বেটা হই জয়দত্তের নাতি।
হাটে লয়্যা বেচাইব বীরের ঘোড়া হাতি।।
তবে সুশাসিত হ’বে গুজরাট ধরা।
পুনর্ব্বার হাটে মাংস বেচিবে ফুল্লরা।।’
কালকেতুর সর্বনাশ সাধনের শপথ নিয়ে ভাড়ুদত্ত এবার রওয়ানা দিলো কলিঙ্গের পথে—কলিঙ্গরাজের সহায়তায় সে কালকেতুর ওপর প্রতিশোধ নেবে। ভাড়ুর ছোট ভাই পঁচিশ বৎসর বয়সেও তার বিয়ে হয়নি পায়ে গোদ বলে ভাড় তাকে আশ্বাস দিল—
‘এবার মণ্ডলী পাইল আগে দিব বিয়া।’
এই স্তোকবাক্যে তাকে ভুলিয়ে তার মাথায় তুলে দিল রাজভেট—
‘রাজ-ভেট নিল কাঁচকলা পুঁইশাক।
চুবড়ি পুরিয়া নিল কদলীর মোচা।’
কলিঙ্গরাজ কালকেতুর উত্থান এবং গুজরাটে নগর পত্তন কাহিনী জানতেন না। ভাদ্ভদত্ত তাকে এ বিষয়ে সচেতন করে দিয়ে জানালো— প্রজারা সবাই এ দেশ ছেড়ে ওখানে গিয়ে ভিড় করেছে, এবং কালকেতু প্ৰচণ্ড হ’য়ে উঠেছে। কলিঙ্গরাজ সংবাদের যাথার্থ নির্ধারণের জন্য কোটালকে তার সন্ধানে পাঠালেন। কোটাল ফিরে এসে কালকেতুর রাজ্যবিস্তারের কাহিনী সমর্থন করলে কলিঙ্গরাজ ভাঁড়ুর পরামর্শে কালকেতুর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। সেই যুদ্ধে কলিঙ্গরাজের পরাজয় ঘটলে ভাড়ুদত্ত দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল— কারণ তার পরিবার রয়েছে গুজরাট নগরে। তাই সে ভয় দেখিয়ে কোটালকে আবার যুদ্ধে প্রবৃত্ত করে—
‘এক লক্ষ টাকা তুমি খাইলে সে ধুতি।
ভাড়ুদত্ত জীতে পালাইয়া যাবে কতি।।’
ভাড়ুদত্তের দুর্ব্যাক্যে ভয় পেয়ে পরাজিত কলিঙ্গ সৈনাগণ আবার ফিরে আসায় হতবুদ্ধি কালকেতুকে ফুল্লরা ভয় দেখালো –
‘হারিয়া যে জন যায় পুনরপি আইসে তার
হেতু কিছু আছয়ে বিশেষ।।’
স্ত্রীবুদ্ধিতে কালকেতুরও বুদ্ধিভ্রংশ হল—
‘ফুল্লরার কথা শুনি হিতাহিত মনে গুণি
লুকাইল বীর ধান্য ঘরে।।’
এদিকে ভাড়দত্ত সঙ্গে এক ব্রাহ্মণকে নিয়ে এসে ফুল্লরাকে ‘খুড়ী’ বলে ডেকে আপ্যায়িত ক’রে বললো যে কলিঙ্গরাজ পান দিয়ে এই ব্রাহ্মণকে পাঠিয়েছেন সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে। কালকেতু যদিও তাকে অপমান করেছে, কিন্তু ভাড়ু তাতে কিছু মনে করেনি, সে সব বুঝিয়ে শুনিয়ে কলিঙ্গরাজকে শান্ত করেছে। সরলা ফুল্লরা ভাড়ুর চাতুরী বুঝতে না পেরে ‘ধনঘরে দিলো বিলোচন’। অতএব কালকেতুর সন্ধান পেতে আর ভাঁড়ুর কোনো অসুবিধে হল না। কালকেতু বন্দী হল।
এরপর নানা ঘটনা পরম্পরায় কালকেতু মুক্তি লাভ ক’রে স্বরাজ্যে ফিরে এলে ভাঁড়ুদত্ত আবার কপটতার আশ্রয় নিয়ে কালকেতুর কাছে ফিরে এসে বলছে—
‘খুড়া তুমি হৈলে বন্দী অনুক্ষণ আমি কান্দি
বহু তোমার নাহি খায় ভাত।’
কিন্তু এবার আর কালকেতু ভুল করলো না, সে দুষ্ট ভাড়ুর প্রকৃত পরিচয় পেয়ে গেছে। সে তার যথাযোগ্য শাস্তির বিধান করলো—
‘মুড়াহ ভাড়ুর মুণ্ড অভক্ষ্যে পুরিয়া তুগু
দুই গালে দেহ কালি-চূণ।’
শুধু এই শারীরিক শাস্তি বিধানই নয়– কালকেতু তার জাতিত্বের গর্বও বিনাশ করলো—
‘হয়্যা বেটা রাজপুত বোলহ কায়স্থ সুত
নীচ হয়্যা উচ্চ অভিলাষ।’
কালকেতু শেষ পর্যন্ত অবশ্য আবার ভাডুকে আশ্রয় দিয়েছিল—
‘ভাড়ুর লাঘবে বীর দুঃখ ভাবি বড়ি।
কৃপা করি পুনর্বার দিল ঘর-বাড়ি।।’
ভাড়ুদত্ত কবিকঙ্কণের মৌলিক আবিষ্কার না হলেও তিনি চরিত্রটিকে এমন একটি সজীব রূপ দিয়েছেন, যার ফলে শয়তান ভাড়ুর চক্রান্তেই এই উপাখ্যানের ঘটনাস্রোত উত্তাল হ’য়ে পরিণামের দিকে ছুটে চলেছে। অতিশয় খল এই ভাঁড়ুর চরিত্রে কবিকঙ্কণ কিছুটা ‘কমিক’ রস মিশ্রিত করে দেওয়াতে তাকে আর অসহ্য মনে হয় না। এই জগৎসংসারে আদর্শ চরিত্র ব্যক্তির বড় অভাব। এ জাতীয় চরিত্র সৃষ্টিতে উৎকৃষ্ট কল্পনাশক্তির প্রয়োজন। কিন্তু ভাড়ু-জাতীয় জীব বাস্তব জগতে অনেক রয়েছে, অতএব এই চরিত্রসৃষ্টিতে মুকুন্দ কবির সার্থকতা লাভে কোনো অসুবিধা হয় নি।