বৈষ্ণব-গীতিসাহিত্যে ভাবোল্লাস পর্যায়ের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে এই পর্যায়ের অন্তর্গত তোমার পাঠ্য পদগুলোর ভাব-সৌন্দর্যের পরিচয় দাও।
ভাবোল্লাস পর্যায়ের পদগুলোর কাব্যগুণ বিশ্লেষণ করো। এই প্রসঙ্গে ভাবোল্লাস পর্যায়টির পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করো।
বৈষ্ণব পদাৰলীকারদের বর্ণিত ‘ভাবসম্মেলন’-এর পদগুলির তাত্ত্বিক প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণ করো। উক্ত দুই পর্যায়ের পদের একটি করিয়া উদাহরণ দাও।
সম্ভোগ / ভাবোল্লাস / ভাবসম্মিলন
সম্ভোগ:
বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে শৃঙ্গার বা মধুর রসের দুটি প্রধান বিভাগের মধ্যে একটি বিপ্রলস্ত, অপরটি সম্ভ্রোগ। বৈষ্ণব সাহিত্যে বিপ্ৰলম্বের চার পর্যায়ের পর সম্ভোগের স্থান। সম্ভোগের সংজ্ঞা –
‘দর্শনালিঙ্গনাদীনামানুকূল্যান্নিষেবয়া। যুনোরুপ্লাসমারোহন ভাবঃ সম্ভোগ ঈষ্যতে।।
অর্থাৎ দর্শন ও আলিঙ্গনাদির নিমিত্ত যুবক যুবতীর তথা নায়ক-নায়িকার যে ভাবোল্লাস তাকেই ‘সস্তোগ’ নামে অভিহিত করা হয়। বৈষ্ণব পদাবলীতে বা প্রচলিত কথায় সম্ভোগকেই বলা হয় ‘মিলন’। সম্ভোগের প্রধান বিভাগ দুটি মুখ্য ও গৌণ। জাগ্রদবস্থায় মুখ্য সম্ভোগ চতুধা বিভক্ত – সংক্ষিপ্ত, সংকীর্ণ, সম্পন্ন ও সমৃদ্ধি।
(১) পূর্বরাগের পর মিলনে হয় সংক্ষিপ্ত সম্ভোগ। ভয়, লজ্জা-অসহিষ্ণুতা-আদি কারণে নায়ক নায়িকার মিলন হয় সংক্ষিপ্ত তথা ভোগের উপচার সংক্ষেপে গ্রহণ করা হয় বলে একে বলা হয় সংক্ষিপ্ত সম্ভোগ। গোবিন্দদাস বর্ণনা করেছেন– ‘পহিল সমাগম রাধা কান।
(২) মানের পর মিলনে হয় সংকীর্ণ সম্ভোগ। নায়কের উপর পরিপূর্ণ আস্থা স্থাপনে সমর্থ না হয়ে নায়িকা যখন পরিপূর্ণভাবে ধরা দেয় না, তখন হয় সংকীর্ণ সম্ভোগ। রায়শেখর এরূপ সঙ্কীর্ণ সম্ভোগের বর্ণনা দিয়েছেন।
(৩) অদূর প্রবাসের পর মিলনে হয় সম্পন্ন সম্ভোগ বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে এর ‘আগতি’ এবং ‘প্রাদুর্ভাব’ দুই শাখা।
(৪) সুদীর্ঘকাল নায়ক-নায়িকার মধ্যে যদি বিচ্ছেদ বর্তমান থাকে এবং তারপর যদি মিলন সাধিত হয়, তবেই উপভোগের অতিরেক ঘটে এবং সমৃদ্ধিমান সম্ভোগ হয়।
সম্ভোগের অপর বিভাগের নাম ‘গৌণ সম্ভোগ’- একে প্রকারাস্তরে স্বপ্ন সম্ভোগ নামে অভিহিত করা হয়। এখানে একটু তত্ত্বগত প্রশ্ন এসে পড়ে।
শ্রীমদ্ভাগবতপুরাণে শ্রীকৃষ্ণের মথুরাগমনের পর পুনরাবর্তনের কথা নেই। কাজেই কৃষ্ণ যখন ব্রজে ফিরে এলেন না তখন আর পুনর্মিলনের কোনো সম্ভাবনা থাকে না। অথচ শ্রীমতী রাধিকা চিরবিরহিণীরূপে সারা জীবন কাটিয়ে যাবেন, সম্ভবত এটিও বৈষ্ণব কবিগণ মন থেকে গ্রহণ করতে চাননি। তাই সৃষ্টি হল গৌণ সম্ভোগ তথা স্বপ্নসম্ভোগের। বৈষ্ণব শাস্ত্রে স্বপ্নসম্ভোগের বর্ণনা থাকলেও বৈষ্ণব কবিগণ ভাবসম্মেলনরূপে তাকে উপস্থিত করেছেন। কৃষ্ণ বৃন্দাবনে প্রত্যাগমন করেন নি বলেই রাধার সঙ্গে তার বাস্তব মিলন সম্ভব নয়। বৈষ্ণব কবিরা তাই রাধা-ভাবনার মধ্য দিয়ে এই মিলন ঘটিয়েছেন এ যেন স্বপ্নেই রাধা কৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হলেন। প্রকৃত স্বপ্ন না হয়ে। এ হল জাগরস্বপ্ন। রাধা মনে মনে কৃষ্ণমিলন কল্পনা করেছেন এবং বৈষ্ণব কবিগণ উল্লাস সহকারে এই ভাব-সম্মেলনের পদ রচনা করেছেন। এইজন্যই একে মুখ্য সম্ভোগের অন্তর্ভুক্ত না করে গৌণ সম্ভোগের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ভাবোল্লাস / ভাবসম্মেলন:
বৈষ্ণবীয় রসশাস্ত্র উজ্জ্বলনীলমণি’তে ‘ভাবোল্লাস’-এর কোনো উল্লেখ না থাকলেও ‘পদকল্পতরু’র চতুর্থ শাখার দ্বাদশ পল্লবে যে সকল পদ সঙ্কলন করা হয়েছে, তাদের ‘ভাবোল্লাস’-এর পদ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। সখীদের প্রতি শ্রীমতী রাধার যে স্নেহাতিরেক ‘উজ্জ্বলনীলমণি’ ও ‘ভক্তিরসামৃতসিন্ধু’তে বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে তাকেই বলা হয়েছে। ভাবোল্লাস”। মাথুরের বিরহ কবিদেরও আচ্ছন্ন করে দেয়, তারাও এই বিরহ সইতে না পেরে এক অভিনব উপায় গ্রহণ করে রাধাকৃষ্ণের মিলন সাধন করিয়েছেন। বিরহবিকারের আবেশে রাধা কল্পনা মাধ্যমে কৃষ্ণের সঙ্গসুখ উপভোগ করছেন একেই ‘ভাবসম্মেলন’ নাম দিয়ে – ‘বৈষ্ণবপদকর্তাগণ’ মিলনের বিচিত্র পদ রচনা করে নিজেরাও বিরহ-ভার মুক্ত হয়েছেন। অধ্যাপক অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, “ভাবসম্মেলনের পদগুলির আবেগের নিষ্ঠা ও রসের বৈচিত্র্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। কারণ এই পদসমূহে বিরহ ও মিলনের রস একসঙ্গে মিলিত হইয়াছে। কৃষ্ণের মথুরাগমনের পর রাধা ও কৃষ্ণের আর মিলন হয় নাই বটে, কিন্তু বৈষ্ণব ভক্তকবিগণ এই বিরহের হাহাকারে কেমন করিয়া সমাপ্তি রেখা টানিবেন? তাই তঁাহারা ভাবসম্মেলন ও ভাবোল্লাস নামক এক পৃথক পর্যায়ের পরিকল্পনা করিয়াছেন। ভাবলোকে, মনোজগতে কল্পনার আকাশে শ্রীরাধা কৃষ্ণসঙ্গ লাভ করিয়া মনে করিতেছেন, যেন কৃষ্ণ সত্যই দীর্ঘ বিরহের ব্যবধানের পর তাহাকে গ্রহণ করিতে আসিতেছেন চারিদিকে তাহারই শুভ সূচনা। কিন্তু কৃষ্ণ তো মথুরা – হইতে ফিরেন নাই। কিন্তু পদকর্তা এ নির্মমতা সহ্য করিবেন কি করিয়া? তাই এই পর্যায়ের পদে রাধা-কৃষ্ণের কাল্পনিক মিলনের চিত্র আঁকিয়া তাহারা লীলারসের উপসংহার করিয়াছেন।”
অতএব দেখা যাচ্ছে, ‘পৃথক নামে অভিহিত হলেও ‘ভাবোল্লাস’ এবং ‘ভাবসম্মেলন’ একই বস্তু। এখানে বৈষ্ণব পদকর্তাগণ বৈষ্ণব রসশাস্ত্রের নির্দেশ না মেনে স্বতন্ত্র পন্থা অবলম্বন করেছেন। আপাত হিসেবে আমরা সম্ভোগকেও এর সঙ্গে যোগযুক্ত করতে পারি। কারণ ‘প্রবাস’-এর পর বৈষ্ণবরসশাস্ত্রে যে ‘সমৃদ্ধিমান সম্ভোগ’ বা প্রকৃত সম্ভোগের কথা বলা হয়েছে, তা’ বাস্তবে সম্ভব নয়, কারণ প্রবাসের পর কৃষ্ণ আর মথুরা থেকে ফিরে আসেন নি। অধ্যাপক শ্যামাপদ চক্রবর্তী সম্ভোগের বিষয়টি সম্পর্কে বলেছেন: “সম্ভোগ নায়ক-নায়িকার মিলনজাত উল্লাসময় ভাব। ইহাও বাস্তব নহে, কাব্যগত। বৈষ্ণবশাস্ত্রে বহুপ্রকার সম্ভোগের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সমৃদ্ধিমান সম্ভোগ’। ইহার একটি বিশিষ্ট লক্ষণ এই যে নায়িকা এখানে সম্পূর্ণ স্বাধীন রাধা পরকীয়া বলিয়া পূর্ণ স্বতন্ত্রতা তাঁহার পক্ষে সম্ভব নহে। এই কারণে বৃন্দাবনলীলায় সমৃদ্ধিমান সম্ভোগ কল্পনা করা কঠিন। রূপ গোস্বামী ‘ললিতমাধব’ নাটকে বৃন্দাবনের রাধাকে সাময়িকভাবে দ্বারকায় লইয়া গিয়া সত্যভামায় রূপান্তরিত করিয়া মহারাজ কৃষ্ণের সহিত তাঁহার বিবাহ দিয়াছেন। পরকীয়াকে স্বকীয়া করিয়া তবে সমৃদ্ধিমান সম্ভোগ দেখাইয়াছেন।”
অতএব বাংলা পদাবলী সাহিত্যে যা “সম্ভোগ’ তাকেই ‘ভাবোল্লাস’ বা ‘ভাবসম্মোলন’ রূপে অভিহিত করা হয়। এই ভাবসম্মেলনের একটা তাত্ত্বিক অর্থ করে থাকেন অনেকেই। কবিশেখর কালিদাস রায়ের বক্তব্য এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়— “বৈষ্ণব কবিগণ যে রাধাকৃষ্ণের নিত্যমিলনের কথা বলিয়াছেন, তাহা বৃন্দাবনের রূপলোকে নয়, তাহা কোনো কুঞ্জে নয়, তাহা ভাবলোকে। মহাভাবই বৃন্দাবনলীলায় রূপের মাঝারে অঙ্গ লাভ করিল সে রূপ আবার ভাবের মাঝারে ছাড়া পাইল। ইহাই ভাবসম্মেলনের মূল কথা।…
“রূপময় শ্যাম রায় মথুরা গেলেন, কিন্তু ভাবময় শ্যাম নিত্য মিলনেই থাকিয়া গেলেন। পদাবলীর কবিরা এই নিত্য মিলনের আভাস দিয়াছেন তাহাদের পদে।
“বলরাম দাস বলিয়াছেন – হিয়ার ভিতর হৈতে কে কৈল বাহির… রাধার হিয়ার ভিতর হইতে শ্যামকে বাহির করিল বৈষ্ণব কবিরাই। ইহাতেই ত বৃন্দাবন লীলা। সমগ্র লীলা বিলাস হিয়ার ভিতর হইতে বহিষ্কারিত হৃদয়ের ধনকে ফিরিয়া পাইবার জন্য আকুল আকাঙ্ক্ষা ছাড়া আর কিছুই নয়। হিয়ার ধনের হিয়ায় ফিরিয়া যাওয়ার নামই ভাবসম্মেলন। এই সম্মেলনের সম্ভোগই চরম সম্ভোগ——ইহাকেই বৈষ্ণবাচার্যগণ বলিয়াছেন—সমুদ্ধিমান সম্ভোগ।”
‘প্রেমবৈচিত্র্য’, ‘আক্ষেপানুরাগ’ ও ‘ভাবোল্লাস’ – এই তিন শ্রেণীর পদের তাৎপর্য
বৈষ্ণব পদাবলীতে রাধাকৃষ্ণ লীলার মূল সুর বিপ্রলম্ভ বা বিরহ। পদাবলী সাহিত্যের অধিকাংশ স্থান জুড়েই রৌদ্র-ছায়ার বিচিত্র লীলার মতোই এই বিরহ-মিলনের নানা পাঠক মনকে আবিষ্ট করে। ‘প্রেমবৈচিত্র’, ‘আক্ষেপানুরাগ’, ‘ভাবোল্লাস’ – এরই বিচিত্র ভাব ও ভাবনার বিক্ষেপ।
‘প্রেমবৈচিত্র্য’ বিপ্রলস্তের অন্তর্গত হয়েও যেন সম্ভোগেরই অঙ্গ। সম্ভোগের মধ্যেই যখন অপর কোনো রসের বা ভাবের ছায়াপাত ঘটে, কিংবা মিলনের মধ্যেই যখন বিরহ-ভ্রান্তি ঘটে বা পেয়েও যখন হারানোর আশঙ্কায় মন আশঙ্কিত হয়, তখনই হয় ‘প্রেমবৈচিত্ত’। বৈচিত্র’ অর্থে ব্যাকুলতা বা চিত্তের বিহ্বলতা। প্রেমবৈচিত্রের সম্ভবত অন্যতম নিদর্শন চণ্ডীদাসের ‘দুই কোরে দুই কাদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া’। গোবিন্দদাসের ‘নাগর সঙ্গে রঙ্গে বিলসই কুঞ্জে শুতলি ভুজপাশে। কানু কানু করি রোয়ই সুন্দরী দারুণ বিরহ-হুতাশে’।। পদটিও ‘প্রেমবৈচিত্তা’র নিদর্শনরূপে উল্লেখ করা যায়।
‘প্রেমবৈচিা’ ও ‘আক্ষেপানুরাগ’ এক নয়। কিন্তু ‘আক্ষেপানুরাগ’ প্রেমবৈচিরেই একটা দিক। ব্যাপক অর্থে, রাধার অনুরাগই তো আক্ষেপানুরাগ। আক্ষেপানুরাগ অনুরাগের আধিক্যহেতু প্রিয়জনের প্রতি অদর্শনে উপেক্ষা ভ্রান্তি ঘটে। অতৃপ্ত মিলনাকাঙ্ক্ষা নিয়ে পূর্ব-মিলনের কথা স্মরণ, বর্ণন ও তজ্জনিত আক্ষেপ হচ্ছে ‘আক্ষেপানুরাগ’। রসোৎগারের (রস উৎগার) স্মৃতি + চর্বণা বা স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়েও রাধার আক্ষেপ তিনি শ্যামকে কতই না দুঃখ দিয়েছেন – একেই বলে ‘আক্ষেপানুরাগ’। চণ্ডীদাসের যত নিবারিতে চাই নিবার না যায় রে’, ‘বঁধু, কি আর বলিব তোরে’, ‘কি মোহিনী জান বঁধু কি মোহিনী জান’ প্রভৃতি ‘আক্ষেপানুরাগ’ পদের দৃষ্টাস্ত।
ভাবোল্লাস বা ভাবসম্মিলন সম্বন্ধে বলা যায় -মথুরাগমনের পর কৃষ্ণ আর বৃন্দাবনে কখনো ফিরে আসেননি। তাই মৃন্ময় বৃন্দাবনে রাধাকৃষ্ণের মিলন কোনোদিনই হয়নি, বিরহ বিকারের আবেশে রাধা কল্পনা মাধ্যমে, ভাবযোগে কৃষ্ণের সঙ্গ সুখ উপভোগ করেছেন। একেই ভাবসম্মিলন, তথা ভাবের জগতে মিলন জনিত উল্লাস, ভাবোল্লাস বলা হয়। তত্ত্বতউভয়ে একই বস্তু। বিদ্যাপতির ‘আজু রজনি হাম ভাগে পোহায়লু পেখলু পিয়া মুখ চন্দা’, ‘কি কহব রে সখি আনন্দ ওর। চিরদিনে মাধব মন্দিরে মোর।।’ ‘পাপ সুধাকর যত দুখ দেল, পিয়া মুখ দরশনে তত সুখ ভেল’। — ভাবসম্মিলন বা ভাবোল্লাসের দৃষ্টান্ত। চণ্ডীদাসের ‘সই, জানি কুদিন সুদিন ভেল। মাধব মন্দিরে তুরিতে আওৰ, কপাল কহিয়া গেল।।’ বা ‘বহুদিন পরে বঁধুয়া এলে দেখা না হইত পরাণ গেলে।।’ প্রভৃতি পদও ভাবোল্লাসের উদাহরণ।
ভাবোল্লাসের কবিগণ
(১) বিদ্যাপতি: বিদ্যাপতি প্রায় সর্ববিধ রস পর্যায়ভূক্ত পদ রচনা করেছেন এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সার্থকতা অর্জন করেছেন। বিদ্যাপতি রাধিকার বিচিত্র অনুভূতির কথা প্রকাশ করলেও বিরহ-বেদনা এবং ভাবসম্মেলনের পদে যেন আপনাকেও অতিক্রম করে গেছেন। তাঁর কাব্যে এই ভাব সমাবেশের জন্যেই মহাপ্রভু অকৃপণভাবে তা’ থেকে রস উপলব্ধির সুযোগ পেয়েছিলেন। বিশেষত ভাবসম্মেলন ও ভাবোল্লাসের পদে বিদ্যাপতি তুলনারহিত। পরম আনন্দে পরিপূর্ণ তৃপ্তি নিয়ে তিনি এই পদগুলো রচনা করেছিলেন। বিদ্যাপতিকে বলা হয় সুখের কবি। বস্তুত বিরহ বর্ণনাতে তিনি সার্থকতা অর্জন করলেও মিলনের ক্ষেত্রই তার স্বস্থান- সে বাস্তব মিলনই হোক, বা ভাব-সম্মিলনই হোক।
শ্রীমতী মথুরায় দূতী পাঠিয়েছিলেন কৃষ্ণকে নিয়ে আসবেন, সেই ভাবনাতেই তার আনন্দ কত।
‘পিয়া যব আওব এ মঝু গেছে।
মঙ্গল যতই করব নিজ দেহে।।’
স্বদেহকে প্রিয়ের বা আরাধ্য দেবতার অধিষ্ঠানভূমিরূপে কল্পনা করার মধ্য দিয়ে একটি আধ্যাত্মিক তত্ত্বেরও সন্ধান পাওয়া যায়। ‘The human body is the highest temple of God বিদ্যাপতি এই পরম সত্যের সন্ধান পেলেন কোথায়? পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার মিলনের আভাসে এখানে নায়িকার অপূর্ব ভাবোল্লাস প্রকাশিত হয়েছে।
তারপর পরম প্রিয়াকে পেয়ে গেলেন শ্রীমতী—
আজু রজনি হাম ভাগে পোহায়লু
পেখলু পিয়া-মুখ-চন্দা।
জীবন-যৌবন সফল করি মানলু
দশ দিশ ভেল নিরদন্দা।।
এই মিলনে রাধিকার সে কি উল্লাস। সমগ্র পৃথিবীময় যেন তার আনন্দধ্বনি ছড়িয়ে পড়েছে। যে কোকিলের কুহু বিরহিণী রাধিকার কানে অগ্নিবর্ষণ করত, যে চাদের আলোয় তার বুক ভেঙে যেত, – আজ তাদের প্রতিও তিনি কৃপাময়ী—
‘সোই কোকিল অব লাখ লাখ ডাকউ
লাখ উদয় করুচন্দা।
পাঁচবাণ অব লাখ বাণ হোউ
মলয় পবন বহু মন্দা।।’
“ভাব ও ভাষা, রস ও রূপের এমন পার্বতীপরমেশ্বর মিলন সত্যই বিরল।”
(২) চণ্ডীদাস: আক্ষেপানুরাগের পদে চণ্ডীদাস অপরাজেয়, কিন্তু ভাব-সম্মেলনের পদগুলোতে যেন আরও আস্তরিকতা, আরও সুস্পষ্টতার পরিচয় পাওয়া যায়। জীবনভোর রাধিকা কৃষ্ণ সন্ধানেই কাটিয়েছেন, কৃষ্ণ তো তার জীবনের জ্বালাই শুধু বাড়িয়েছেন, তৎসত্ত্বেও যখন রাধিকা বলেন, ‘জীবনে মরণে জনমে জনমে প্রাণনাথ হৈও তুমি’—তখন আর বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই। রাধাপ্রেম কামনা-বাসনাশ্রিত মর্ত্যলোক থেকে বহু ঊর্ধ্বে এক অধ্যাত্মলোকে বিচরণ করে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শতেক বরষ পরে বঁধুয়া মিলাল ঘরে’—এই শতবর্ষের ব্যবধানও যার চিত্তে একটুখানি মালিন্য স্পর্শ করাতে পারেনি, সেই রাধাচিও যে যুগ যুগ ধরে বিরহিণী-প্রাণে অমৃতবারি সিঞ্চন করবে তাতেই বা বিস্ময়ের কী আছে?
বিদ্যাপতির ভাবটি চণ্ডীদাসেও বর্তেছে; চণ্ডীদাসের রাধাও ভাবোল্লাসে বলেন—
(এখন) ‘কোকিল আসিয়া করুক গান।
ভ্রমরা ধরুক তাহার তান।।
মলয়-পবন বহুক মন্দ।
গগনে উদয় হউক চন্দ।।’
কিন্তু তার চেয়েও বড়ো কথা রাধার কথায় কী গভীর প্রশান্তি কোনো উচ্ছ্বাস নয়, বাগাড়ম্বর নয়—শুধু একটুখানি আক্ষেপদীর্ণ দীর্ঘশ্বাস—
বহুদিন পরে বঁধুয়া এলে।
দেখা না হইত পরাণ গেলে।।
এই দীর্ঘদিনের অদর্শনে কোনো অনুযোগ নয়, অভিযোগ নয়–
‘দুখিনীর দিন দুখেতে গেল।
মথুরা নগরে ছিলে ত ভাল।।
এসব দুখ কিছু না গণি।
তোমার কুশলে কুশল মানি।’
চণ্ডীদাসের রাধা ছাড়া আর কেইবা এমন করে বলবে?
৩. জ্ঞানদাস: জ্ঞানদাসও ভাবসম্মেলনের কিছু পদ রচনা করেছেন। তবে এখানে মিলনমুহূর্তে। রাধার উল্লাসের মধ্যেও বেদনার সুরটি গুপ্ত থাকেনি।
জ্ঞানদাসের রাধা মনেপ্রাণে অনুভব করেন যে, ‘তোমায় আমায় একই পরাণ’, অতএব আকুল আগ্রহে তিনি প্রিয়তমকে হৃদয় মন্দিরেই প্রতিষ্ঠা করে নেবেন—
‘বধু আর কি ছাড়িয়া দিব।
এ বুক চিরিয়া সেখানে পরাণ
সেখানে তোমারে থোব।’