বৈষ্ণব গীতিসাহিত্যে ‘মাথুর’ পর্যায়ের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে এই পর্যায়ের অন্তর্গত তোমার পাঠ্য পদগুলির ভাবসৌন্দর্যের পরিচয় দাও।
গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ মাথুরলীলাকে কি দৃষ্টিতে দেখিয়াছেন তাহা সংক্ষেপে নির্দেশ করিয়া উপযুক্ত উদ্ধৃতি সহযোগে মাথুর পদণ্ডলির সাহিত্যিক সৌন্দর্য বিচার করো।
বৈষ্ণব পদাবলীর ‘মাথুর’ শ্রেণীর পদের অন্য নাম কী? এই শ্রেণীর বিভাগগুলির উল্লেখ করো। তোমার মতে এই শ্রেণীর পদের শ্রেষ্ঠ পদকর্তার কৃতিত্ব উদ্ধৃতিসহ আলোচনা করো।
মাথুর / প্রবাস / বিরহ
সংজ্ঞা, বিভাগ ও বৈচিত্র্য: বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে বিপ্রলঞ্জের যে চতুর্বিধ রূপ কল্পনা করা হয়েছে, তার শেষতম ‘প্রবাস’। শ্রীমদ্ভাগবতে অবশ্য প্রেমবৈচিত্র্য নেই, তার স্থানে অর্থাৎ তৃতীয় স্থানে ‘প্রবাস’ এবং চতুর্থে আছে ‘করুণ’। উজ্জ্বলনীলমণি’ গ্রন্থে প্রবাসের সংজ্ঞা এরূপ-
‘পূর্বসঙ্গতয়োধুনোৰ্ভ বন্দেশাস্তরাদিভিঃ। ব্যবধানস্ত যৎ প্রাজ্ঞৈ: স প্রবাস ইতীর্যতে।।
অর্থাৎ পূর্বে সম্মিলিত নায়ক-নায়িকার মধ্যে দেশাস্তরাদির যে ব্যবধান, তাকে প্রাজ্ঞগণ ‘প্রবাস’ নামে অভিহিত করে থাকেন। বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যে শুধু নায়কের প্রবাস গমনই বর্ণিত হয়েছে।
কালের হিসেবে প্রবাস ত্রিধাবিভক্ত–ভূত, ভবন এবং ভাবী। ‘হরি কি মথুরাপুর গেল। আজু গোকুল শুন ভেল।। – কৃষ্ণ মথুরায় চলে গেলেন আর ফিরে এলেন না —এই যে অতীতকালীয় প্রবাস, একেই বলা হয় ‘ভূত বিরহ’। আবার ‘কাল বলি কালা গেল মধুপুরে। সে কালের আর কত বাকি।।’ ফিরে আসবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কৃষ্ণ মথুরায় গেছেন, এখনও ফিরে আসছেন না শ্রীমতী এই যে বিরহ-জ্বালা ভোগ করে চলেছেন, একেই বলা হয় বর্তমান অর্থাৎ ‘ভবন বিরহ’। ‘কিয়ে সখি চম্পকদাম বনায়সি / করইতে রভস-বিহার। সো বর নাগর যাওব মধুপুর/ব্রজপুর করি আন্ধিয়ার’—ব্রজপুর আঁধার করে নায়ক মধুপুর চলে যাবেন, কাজেই আর রভস-বিহারের জন্য চম্পকদাম বানিয়ে কি হ’বে ভাবীকালের জন্য এই যে বিরহ, একেই বলা হয় ‘ভাবী বিরহ’।
আর একটি সহজ উদাহরণ যোগে এই ভাবী, ভবন ও ভূত বিরহের ব্যাখ্যা করা যায়। কৃষ্ণকে মথুরায় নিয়ে যেতে অক্রুর এসেছেন। যাত্রার প্রস্তুতি চলছে, আশঙ্কায় রাধা-মন দাদুল্যমান। এইটি ভাবী বিরহ। আর দুয়ারে প্রস্তুত রথ। অক্রূর সহ কৃষ্ণ রথোপরি উপবিষ্ট রওনা হওয়ার জন্য অশ্বের পদ চঞ্চল। এইটিই ভবন বিরহ। এবং তৃতীয় হচ্ছে, রথোপরি কৃষ্ণ মথুরায় চলে গেলেন। কৃষ্ণ বিহনে বৃন্দাবন অন্ধকার। এইটি ভূত বিরহ।
আবার স্থায়িত্বকালের বিচারে প্রবাসকে দ্বিধাবিভক্ত করা হয়। ভূত, ভবন এবং ভাবী—এই তিন মিলিয়ে হয় ‘সুদূর প্রবাস’। এই সুদূর প্রবাসই প্রকৃতপক্ষে বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যে প্রবাসের মর্যাদা পেয়েছে এবং পদকর্তাগণ একেই ‘মাধুর’ নামে অভিহিত করে থাকেন। পদাবলী সাহিত্যের একমেবাদ্বিতীয়ম্ নায়ক শ্রীকৃষ্ণের মথুরাগমন এবং পুনরায় ফিরে না আসার জন্যই এই বিরহ বলে একে ‘মাথুর’ নামে অভিহিত করা হয়। এ ছাড়া আর একপ্রকার প্রবাস আছে, যাকে বলা হয় ‘অদূর প্রবাস’ – কালীয়দমন, গোচারণ, রাসে অস্তর্ধান আদি কারণে কৃষ্ণ যখন সাময়িকভাবে অদর্শন হন, তখনই তাকে ‘অদুর প্রবাস’ বলা হয়। রাধা এবং গোপীগণ কৃষ্ণের অপেক্ষায় সাময়িকভাবে বিরহাতুরা হয়ে ওঠেন, উতলা হয়ে তাঁর সন্ধান করেন, পরে আবার তাকে ফিরে পান। এই অদূর প্রবাসকে ‘করুণাখ্য বিপ্রলম্ভ’ নামেও অভিহিত করা চলে। ভাগবতে যে করুণ পর্যায়ের কথা বলা হয়েছে, সম্ভবত তার ভিত্তি এই অদূর প্রবাস। করুণাখ্য বিপ্রলস্তের সংজ্ঞারূপে বলা হয়েছে –‘যুনোরেতস্মিন্ গতবতি লোকান্তরং পুনর্লভ্যে’– অর্থাৎ যুবক-যুবতীর কোনো একজন লোকাস্তর অর্থাৎ স্থানাস্তর গমনের পর আবার যদি তাদের মিলন ঘটে তবে তাকেই বলা হয় করুণাখ্য বিপ্রলম্ভ অর্থাৎ অদূর প্রবাস।
বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে যাকে বলা হয়েছে ‘প্রবাস’ বস্তুত বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যে তাকেই ‘মাথুর’ নামে অভিহিত করা হয়। শ্রীকৃষ্ণের মথুরাগমন এবং দীর্ঘকালের জন্য তার অদর্শন শ্রীমতী রাধিকা এবং কৃষ্ণপ্রাণা গোপীদের অস্তরে যে সস্তাপ জ্বালা সৃষ্টি করেছে, তাকেই কবিরা নানাভাবে প্রকাশ করেছেন এবং মাথুর-পর্যায়ে স্থান দিয়েছেন। এই পর্যায়ের একমাত্র রস করুণ তথা ‘বিরহ’।
বিরহকেই বৈষ্ণব কবিগণ সবথেকে বেশি মর্যাদা দিয়েছেন; বস্তুত কবিদের ‘বিরহের কবি’ বলে আখ্যায়িত করলেও দোষ হয় না। বৈষ্ণব পদের সর্বত্রই তো বিরহ– শুধু প্রবাসেই নয়, পূর্বরাগে এবং মিলনেও বিরহের সুর প্রকট।
প্রবাসাখ্য বিরহের দশ দশা–
“চিস্তাত্রজাগরোদ্বেগৌ তানবং মলিনাঙ্গতা।
প্রলাপো ব্যাধিরুন্মাদে৷ মোহমৃত্যুৰ্দশাদশঃ।।”
বৈষ্ণব কবি এর বাংলা অনুবাদ করেছেন–
“দশ দশা হয় তাহে চিন্তাজাগরণ।
উদ্বেগ তানব মলিনাঙ্গ প্রলাপন।।
ব্যাধি উন্মাদ হয় মোহ অনুক্ষণ।
মৃত্যু এই দশ দশা কহে কবিগণ।।”
বিরহের চাতুর্মাস্যা / বারমাস্যা: বৈষ্ণব কবিগণ রাধাবিরহের চাতুর্মাস্যা, বারমাস্যা আদি রচনায়ও অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। বাংলা সাহিত্যে মঙ্গলকাব্যগুলো এক একটা মহাকাব্যোপম কাহিনী নিয়ে গঠিত। তাদের প্রত্যেকটিতে ‘বারমাস্যা’ একটি অবশ্য বর্ণিতব্য বিষয়। বৈষ্ণব কবিদের দৃষ্টিতেও তেমনি ‘মাথুর’ একটি পরিপূর্ণ মহাকাব্যোপম বিষয় – তাই তারাও সযত্নে এর বারমাস্যা রচনা করেছেন। এই বারমাস্যার উৎকর্ষ-বিষয়ে কবিশেখর কালিদাস রায় বলেন, “মাথুরের বারমাস্যা কবিতাগুলি পদবিন্যাসে মাধুর্যে, ছন্দোবৈচিত্র্যের চাতুর্যে, অলঙ্করণের ঐশ্বর্যে জগতের বিরহ-সাহিত্যে অপূর্ব অবদান।”
বড়ু চণ্ডীদাসই সর্বপ্রথম বিরহের ‘চাতুর্মাস্যা’ রচনা করেছিলেন। আষাঢ় থেকে আশ্বিন পর্যন্ত চারমাস কালই বাংলায় প্রকৃত বর্ষা, আর এই বর্ষাকে অবলম্বন করেই বৈষ্ণব কবিগণ বিরহের কাব্য জমিয়ে তুলেছেন। এই প্রসঙ্গে মনে করা চলে— মেঘদূতের কাহিনীটি, সেখানেও আষাঢ়ের প্রথম দিনেই কাস্তা-বিরহ-কাতর যক্ষ আকাশে নবমেঘের অভ্যূদয় লক্ষ্য করেই বিরহাতুর হয়ে উঠেছিল। পদাবলী সাহিত্যে শ্রীরাধার বসস্ত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমস্ত ও শীতকালোচিত বিরহেরও স্বতন্ত্র বর্ণনা করেছেন।
পদকল্পতরুতে রাধার বিরহের যে বারমাস্যা বর্ণিত হয়েছে, তার প্রথম দুমাসের পদ রচনা করেছেন বিদ্যাপতি, চারমাসের পদ রচনা করেছেন গোবিন্দদাস কবিরাজ এবং শেষ ছয়মাসের পদ লিখেছেন গোবিন্দ চক্রবর্তী। গোবিন্দদাস কবিরাজ স্বয়ং অগ্রহায়ণ মাস থেকে বারমাস্যার পদ লিখেছিলেন বলে জানা যায়। মহাপ্রভু চৈতন্যদের মাঘ মাসে সন্ন্যাস নিয়েছিলেন বলে অনেক বৈষ্ণব কবিই মাঘ মাস বা ফাল্গুন মাস থেকে বারমাস্যা আরস্ত করেছেন। কৃষ্ণের প্রবাস যাত্রার সঙ্গে চৈতন্যদেবের সন্ন্যাস গ্রহণের ঘটনাকে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায় একই তাৎপর্য দ্বারা মণ্ডিত করেছেন।
মাথুরের আধ্যাত্মিক তাৎপর্য:
মাথুরকে অবলম্বন করে অনেকেই এর এক একটি আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা উপস্থাপিত করেছেন। কালিদাস রায় লিখেছেন, “এই মাথুরের নানাভাবে আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। বৃন্দাবনকে লীলাভূমি বা স্বপ্নজগৎ এবং মথুরাকে সত্যলোক বা জীবনসংগ্রামের কর্মক্ষেত্র মনে করিয়া একটা ব্যাখ্যা দেওয়া চলে।….. আর একটি ব্যাখ্যা এই। ভগবান বলেন ‘ঐশ্বর্য-শিথিল প্রেমে নাহি মোর প্রীতি। তিনি সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর রসেরই বশীভূত। মাধুর্যের মধ্যে ঐশ্বর্য ভাব আসিয়া পড়িলেই বাহুবন্ধ শিথিল হইয়া পড়ে। আর তিনি লীলাভূবন ত্যাগ করিয়া চলিয়া যান। ইহাই ভক্তের সাধন মার্গে মাধুর।… মাথুরের আর এক ব্যাখ্যা—“প্রত্যেক মানুষের জীবনেই মাথুর আসে। যৌবনই বৃন্দাবন, যৌবনাত্যয়ই মাথুর। যৌবন প্রেমের মধ্য দিয়া যাহা উপলব্ধি করে, যৌবনাত্যয়ের দাস্যভাবে তাহা বিলুপ্ত হইয়া যায়।… একটি ব্যাখ্যা সর্বজনীন। রাধা-বিরহ মানবাত্মার চিরন্তন বিরহেরই সাহিত্যরূপ। পুর্ণের সহিত, অসীমের সহিত, পরমাত্মার সহিত জীবাত্মার যে বিচ্ছেদ সে বিচ্ছেদের বেদনা মানবমাত্রেরই অস্তরে সুপ্ত আছে। প্রকৃতির বৈচিত্র্য সেই বেদনাকে জাগাইয়া মানব-চিত্তকে অকারণে উদাসী করিয়া তোলে। রবীন্দ্রনাথ এই বেদনার কবি। এই বেদনাকেই বৈষ্ণব কবিরা রাধা-বিরহের সঙ্গীতের মধ্য দিয়া বাণীরূপ দিয়াছেন।”
বিরহের উৎকর্ষ ও বিশ্লেষণ:
বৈষ্ণব পদাবলীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ বিরহ। কৃষ্ণেকপ্রাণা শ্রীমতী রাধিকা এবং গোপীদের হৃদয়বল্লভ শ্রীকৃষ্ণের মথুরাগমনকে উপলক্ষ করেই বিরহিণী নারীর চিত্তবৃত্তির অনুসরণে বৈষ্ণব কবিগণ মধুরাগমন-আরস্তের পূর্ব থেকেই তাদের বিচিত্র মনোভাব বর্ণনা করে গেছেন।
একটা এলোমেলো গুজব শোনা যাচ্ছে যে শ্রীকৃষ্ণ ব্রজ ছেড়ে মথুরায় যাবেন। কথাটা রাধার কানেও পৌঁছল। কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতে পারেন না। তাই–
‘ললিতার কথা শুনি হাসি হাসি বিনোদিনী
কহিতে লাগিল ধনি রাই
তোমরা যে বল শ্যাম মধুপুরে যাইবেন
সে কথা তো কভু শুনি নাই।’
রাই একথা বিশ্বাস করেন না এ কারণে যে হিয়ার মাঝারে মোর এ ঘর মন্দির গো’— যে হৃদয়ের মধ্যে শ্যামচাদের আসন, সেখান থেকে তিনি কী করে বেরুবেন?
এ বুক চিরিয়া যবে বাহির করিব গো
তবে তো শ্যাম মধুপুরে যাবে।।
অতএব তিনি নিশ্চিন্ত। কিন্তু এবার গুজব সত্যে পরিণত হল। নামে অর্জুর, কিন্তু আসলে ক্রুর, এসেই ঘোষণা করেছেন, ‘কালি কালিই সাজ’ – রাত্রি প্রভাতেই কৃষ্ণকে নিয়ে সে মথুরা রওয়ানা হবে। কাজেই এ রাত যেন আর না পোহায়, তাই হল রাধার একান্ত প্রার্থনা।
‘যোগিনী-চরণ শরণ করি সাধহ
বান্ধহ যামিনীনাথে।
নখতর চান্দ বেকত বহু অম্বরে
যৈছে নহত পরভাতে।।’
যোগিনীকে সাধ্যসাধনা করে তাকে দিয়ে চন্দ্র ও নক্ষত্রকে আকাশে আটকে রাখ।
ব্রজপুর অন্ধকার করে কৃষ্ণ যখন মথুরায় চলেই যাবেন, তখন আর কুসুমসজ্জার প্রয়োজন কি? শেষ পর্যন্ত যা ঘটবার তাই ঘটল–কৃষ্ণ মথুরায় চলে গেলেন। ফলে ব্রজের অবস্থা হল–
‘গোকুলে উছলল করুণাক রোল।
নয়ন-জলে দেখ বহয়ে হিলোল।।
শুন ভেল মন্দির শুন ভেল নগরী।
শুন ভেল দশ দিশ শুন ভেল সগরি।।’
কৃষ্ণের অভাবে গোকূলে কান্নার বন্যা বয়ে গেল। চারিদিকে শুধুই শূন্যতা।
কৃষ্ণবিহীন জীবনে আর কি সার্থকতা। কৃষ্ণের মথুরাগমনের সঙ্গে সঙ্গেই রাধার জীবনের সাধ আহ্লাদ সবই শেষ হয়ে গেল।
“কি কহসি কি পুছসি শুন প্রিয় সজনি।
কৈছনে বঞ্চব হই দিন রজনি।।
নয়নক নিন্দ গেও বয়নক হাস।
সুখ গেও পিয়া-সঙ্গ দুখ মঝু পাশ।।
অথচ কৃষ্ণকে আনন্দে রাখবার জন্য, তার যাতে বিন্দুমাত্র কষ্ট না হয়, তার জন্যে রাধা কখনো বুকে বসন, চন্দন বা হার পর্যন্ত পরিধান করতেন না, সেই কৃষ্ণ এখন তাকে ছেড়ে কত দুরে নদী পাহাড়ের অন্তরালে চলে গেছেন–
চীর চন্দন উরে হার না দেলা।
সো অব নদী-গিরি আঁতর ভেলা।।
রাধার দিক থেকে আদর-যত্নের কোনো ত্রুটি ছিল না নিজের কপালদোষেই এমন ঘটল।
‘পূরব জনমে বিহি লিখিল ভরমে।
পিয়াক দোখ নাহি যে ছিল করমে।।
এভাবেই দিন যায়, ক্রমে এলো দুরস্ত বাদল, ভরা বর্ষায় বিরহিণী রাধার মন আর কিছুতে স্বস্তি পাচ্ছে না–
‘এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর
শূন মন্দির মোর।।’
একালের কবির ভাষায়, এই ত ছিল সেইদিন–
‘এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়।’
জীবন-যৌবন দিয়ে যাঁকে চিরকাল অন্তরের নিধি করে রাখতে চেয়েছিলেন, তিনি তো তার যথাযোগ্য মর্যাদা দিলেন না। শ্রীকৃষ্ণের ব্যবহার রাধার নিকট অসম্ভব এবং সৃষ্টিছাড়া বলে মনে হচ্ছে–
“অনুভবি কানু-পিরিতি অনুমানিয়ে
বিঘটিত বিহি-নিরমাণ।’
এই নবীন বয়সের নবীন প্রেম যদি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়, তার পরে জলসেচনে কি তা আর বেঁচে উঠবে? এখনই যদি বিরহযন্ত্রণা ভোগ করতে হয়, তবে পরে আর কৃষ্ণপ্রেমে কী লাভ হবে?
‘অঙ্কুর তপন তাপে যদি জারব
কি করব বারিদ মেহে।
এ নব যৌবন বিরহে গোঙায়ব
কি করব সো পিয়া-লেহে।।’
রাধার এই বিরহব্যাকুলতা সখীদের অন্তরেও বেদনা সৃষ্টি করে। তারা ভরসা দেয় – কৃষ্ণ নিশ্চয়ই শীঘ্র ব্রজে ফিরে আসবেন। কিন্তু রাধা তাদের প্রবোধে শাস্ত হন না। তিনি যে এখনো কৃষ্ণবিরহ সত্ত্বেও বেঁচে রয়েছেন, এও তাঁর পক্ষে লজ্জার বিষয়।
‘শুন সখী কি বোলব তোয়
নিলজ প্রাণ সহজে রহু মোয়।
সো গুণনিধি যদি প্রেম হামে ছোড়,
তিল এক জীবইতে লাজ বহু মোর।।’
কৃষ্ণবিরহিত জীবনে তিলেকের জন্য বেঁচে থাকাও তাঁর কাছে লজ্জার বিষয়। হয়তো তিনি আর্ বেঁচে থাকবেন না। তবু, তার মৃত্যুর পরও যেন কৃষ্ণ একবার ব্রজে ফিরে এসে তার প্রিয়জনদের দেখা দিয়ে যান। রাধা যে মল্লিকা চারা পুঁতে রেখে গেছেন, ‘গাঁথিয়া ফুলের মালা পরাইও তারে।” এখানে রয়েছেন কৃষ্ণের সখারা, রয়েছেন মা যশোমতী–
‘তারে আসি যেন পিয়া দেয় দরশন।।’
এই বলে রাধা শ্রীকৃষ্ণের নিকট এক সখীকে দূতী করে পাঠালেন। সখী তাঁকে আশ্বাস দিলেন–
‘ধৈর্য্যং রহু ধৈর্য্যৎ রাই গচ্ছং মাথুরাওয়ে।
ছুঁড়ব পুরী প্রতি প্রতক্ষে যাঁহা দরশন পাওয়ে।।’
এবং সখী সন্ধান করে কৃষ্ণকে আবিষ্কার করলেন, তাঁকে জানালেন শ্রীমতীর অবস্থা— রাধার প্রায় অস্তিমদশা উপস্থিত হয়েছে–
‘নিয়ড়ে সখীগণ বচন যো পুছত
উত্তর না দেয়ই রাধা।
হা হরি হা হরি করতই অনুখন
তুয়া মুখ হেরইতে সাধা।।’
রাধার অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে,–
“মন্দ মলয়ানিল বিষসম মানই
মুরছই পিককুল-রাবে।”
মাথুর পর্ব এখানেই সমাপ্ত। তবে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে এর মধ্যেও একটু আশার আলো দেখা গেছে এবং পরবর্তী বৈষ্ণব কবিদের মধ্যেও কেউ কেউ মাথুরেও রাধাকৃষ্ণের মিলন দেখিয়েছেন। রাধামোহন ঠাকুরের–
‘মথুরা সহেরি করি পথ চাতুরি মিলল নিরজন কুঞ্জে।।’
‘বিরহের’ কবিগণঃ
(১) বিদ্যাপতি : বিদ্যাপতিকে সাধারণত দেহবিলাস এবং সম্ভোগের কবি বলে বর্ণনা করা হলেও বিরহের পদ রচনাতেও সম্ভবত তাঁর কৃতিত্ব কারো চেয়ে কম নয়। তার বিরহের পদগুলোকে বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি স্তর লক্ষ্য করা যায়। প্রথম স্তরে দেখা যায় ভোগবিলাসের প্রতি রাধার আকর্ষণ। কৃষ্ণবিরহ যেন তাকে ভোগ বিরহের জন্যই কাতর করে তুলেছে।
‘অঙ্কুর তপন তাপে যদি জারব
কি করব বারিদ মেহে।
এ নব যৌবন বিরহে গোঙায়ব
কি করব সো পিয়া লেহে।।’
দ্বিতীয় স্তরে ভোগবহ্নি কিছুটা প্রশমিত হলেও উদ্বেলতা বর্তমান ছিল। এ স্তরে রাধা কৃষ্ণের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে উঠেছেন–
‘যৌবন রূপ আছল দিন চারি।
সে দেখি আদর কএল মুরারি’
তৃতীয় স্তরে বিরহবহ্নিতে দগ্ধ রাধা যেন সত্যস্বরূপে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছেন, এখন রাধা এক বিষাদময়ী প্রতিমা!—এই শূন্যতাবোধ শুধু রাধাকে নয়, পাঠকের হৃদয়কে পর্যন্ত আচ্ছন্ন করে দেয়–
‘শুন ভেল মন্দির শুন ভেল নগরী।
শুন ভেল দশ দিশ শুন ভেল সগরি।।’
চতুর্থ স্তরে রাধার বিরহিণী রূপটি পূর্ণ প্রস্ফুটিত। তার ভোগাকাঙ্ক্ষা, প্রগল্ভতা সমস্ত স্তিমিত হয়ে এক অত্যন্ত শোভনশ্রী মূর্তি পরিগ্রহ করেছে।
বিদগ্ধ সমালোচক অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসু বিদ্যাপতির বিরহ-পদের কৃতিত্ব বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছেন, ‘অভিসারের পর বিদ্যাপতির বিরহের পদ। এই পর্যায়ে বিদ্যাপতির কবিশক্তি শ্রেষ্ঠত্বের সীমালগ্ন; কী অপূর্ব সব পদই না পাইয়াছি। … ইহা বাহ্যত বেদনার্তির রূপ ধরিলেও কোথাও যেন আনন্দ সাগরের কল্লোল ধ্বনিত হইয়া ওঠে।”
কৃষ্ণচিন্তায় তৎপর শ্রীমতী রাধিকার যে ‘আমিই কৃষ্ণ’ এই অন্বয় উপলব্ধিতে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন, তার ইঙ্গিত পূর্ববর্তী বৈষ্ণব সাহিত্যে পাওয়া গেলেও বিদ্যাপতি এই তত্ত্বকে এক অসাধারণ রসের নির্ঝরে পরিণত করেছেন এই পদের আর তুলনা নেই–
‘অনুখন মাধব মাধব সোঙরিতে সুন্দরি ভেলি মধ্যই।’
(২) চণ্ডীদাস: কবি চণ্ডীদাসকে সাধারণভাবে ‘বেদনার কবি, বিরহের কবি’ বলেই অভিহিত করা হয়। ব্যাকুলতা ও বেদনা যত সহজে মানুষের মনে সাড়া জাগাতে পারে, অপর কোনো অনুভূতির পক্ষেই তা সম্ভব নয়। চণ্ডীদাসের কাব্যে চমক নেই, ঠমক নেই, অলঙ্কার নেই, অতি সহজ সরল ভাষায় প্রাণের কথা বলেছেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “বিদ্যাপতি সুখের কবি, চণ্ডীদাস দুঃখের কবি। চণ্ডীদাস সুখের মধ্যে দুঃখ এবং দুঃখের মধ্যে সুখ দেখিতে পাইয়াছেন। তাহার সুখের মধ্যেও ভয়–দুঃখের প্রতি অনুরাগ।” ফলত চণ্ডীদাসের রচনায় মাথুর আদি অংশবিশেষেই যে বিরহের সুরটি ধ্বনিত হয়েছে, তা নয়, পূর্বরাগ, আক্ষেপানুরাগ, এমনকি মিলনের মধ্যেও সেই চিরন্তন বিরহের সুর। বিশেষভাবে মাথর-এর পদ রচনায় চণ্ডীদাস বিরহচিত্রাঙ্কণে খুব উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব দেখাননি।
(৩) গোবিন্দদাসঃ গোবিন্দদাস মাথুর অবলম্বনে অনেক পদ রচনা করেছেন। তার কোনো কোনো পদ এবং পদাংশ অবিসংবাদিতভাবেই কৃতিত্বের অধিকারী। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে বিরহের পদ রচনায় গোবিন্দদাস অস্তরের সাড়া পাননি। প্রকৃতপক্ষে যে সাধনা বলে বৈষ্ণব কবি রাধার সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠেছিলেন, গোবিন্দদাস সেখানেই একটু পিছিয়ে আছেন। তিনি ভক্ত বৈষ্ণব কবি, কিন্তু রাধাভাব তার সাধনা নয়, তাই রাধার বেদনা তিনি অস্তর দিয়ে উপলব্ধি করতে পারেননি। কিন্তু তৎসত্ত্বেও গোবিন্দদাস বিরহের পদ রচনায় কৃপণতা প্রদর্শন করেননি, এমনকি কোনো কোনো পদে তিনি সিদ্ধিও লাভ করেছেন।
একটি ভাবী বিরহের আশঙ্কায় রাধা শঙ্কাতুরা–
‘নামহি অক্রুর ক্রুর নাহি যা সম
সো আওল ব্রজ মাঝ
ঘরে ঘরে ঘোষই শ্রবণ-অমঙ্গল
কালি কালিহু সাজ।।’
কৃষ্ণকে নিয়ে যাবার জন্যে মথুরা থেকে অক্রুর এসেছেন। ব্রজপুরীর ঘরে ঘরে এ দুঃসংবাদ পৌঁছে গেছে। শ্রীরাধা আর্দ্রকণ্ঠে স্বগতোক্তি করেন,–
“সজনি, রজনী পোহাইলে কালি।
রচহ উপায় যৈছে নহ প্রাতর
মন্দিরে বহু বনমালী।।”
— যার জন্য এমন দুস্তর সাধনায় তিনি কালাতিপাত করলেন, সত্যি কি তিনি চলে যাবেন? অথবা, হয়তো যাবেন না। তারপর যখন প্রকৃতই কৃষ্ণ ব্রজপুরী ছেড়ে গেলেন, তখন শ্রীমতীর বুকফাটা আর্তনাদ ঘোষিত হয়, রাধা বুঝতে পারছেন–
‘পিয়া গেল মধুপুর হাম কুলবালা।
বিপথে পড়ল যৈছে মালতীমালা।।
কি কহসি কি পুছসি শুন প্রিয় সজনি।
কৈছনে বঞ্চব ইহ দিনরজনী।।’
কৃষ্ণবিহীন জীবনে আর কোনো স্বাদ নেই, অতএব সাধও নেই; অতএব তিনি সার সত্য বুঝে নিয়েছেন – মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই এই বিরহের অবসান, অন্তরের ধনের পুনঃপ্রাপ্তি ঘটতে পারে। বিরহ এবং মৃত্যুর যে দ্বন্দ্ব শ্রীমতীর দ্বিধাগ্রস্থ চিত্তকে বিক্ষুব্ধ করে রেখেছিল, এবার তার পরিসমাপ্তি। মৃত্যু সম্বন্ধে তিনি স্থির নিশ্চিত। সেই মুহুর্তে তিনি কামনা করেন তার মৃত্যুর পর দেহাবশেষ তো পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাবে, যে অংশ ক্ষিতি হবে- তা যেন সেই স্থানের মাটিতে পরিণত হয়। যার ওপর দিয়ে কৃষ্ণ একসময় পদচারণা করেবেন–
‘যাঁহা পহু অরুণ-চরণে চলি যাত।
তাঁহা তাহা ধরণী হইয়ে মঝু গাত।।’
–মাথুর পর্যায়ে গোবিন্দদাসের ভাবনা এখানে চরমোৎকর্ষ লাভ করেছে।
গোবিন্দদাস হয়তো বিরহে বিশ্বাসই করতেন না, তাই তিনি মাথুরেও রাধা-কৃষ্ণের মানস মিলন ঘটিয়েছেন।
তবে সাধারণ ভাবে বলা যায়, ‘বিরহপর্যায়ে অনুচিত অলঙ্কৃতি গোবিন্দদাসের কাব্যকে নষ্ট করিয়াছে। গভীরতম বেদনার বাণী সহজ সরল, অর্ধমূর্ছিত গদগদ ভাব। কিন্তু গোবিন্দদাস বিরহ বেদনা প্রকাশ করিতে রাধিকার মুখে যখন নিপুণ সজ্জিত বাণী স্থাপন করেন, তখন তাহাতে হয়তো কবি-চাতুর্য প্রকাশ পায়, কিন্তু কাবা হয় না। আসলে গোবিন্দদাস বেদনার কবি নহেন, আরাধনার কবি।”