বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ মুজতবা আলীর অবদান ও স্থান
বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন ও কর্মের অধিকরী সৈয়দ মুজতবা আলী। শিক্ষাসূত্রে বিশ্বের নানা স্থানে গমনের মধ্যেই সূচিত হয়েছিল তাঁর সাহিত্য রেখা। গুরুগম্ভীর ও তাত্ত্বিক বিষয়কে পরিহার করে সহজ সরল ভঙ্গিতে বৈঠকী মেজাজে তিনি যে ভাবে সাহিত্যের আঙিনার অবতরণ করেন তাতেই সাহিত্যিক রূপে তিনি প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছেন। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সংস্পর্শে এসে তাদের জীবন দর্শনকে যে ভাবে তিনি তাঁর সাহিত্যে এঁকেছেন তা পাঠ করতে গিয়ে যেন মুখোমুখি আলাপের স্বাদ পাওয়া যায়। এ হেন ব্যক্তিত্বের সম্পর্ক পরিচয় লোভে যে কোনও সুহৃদ পাঠকের মন আগ্রহের আতিশয্যে আপ্লুত হয়ে ওঠে।
মুজতবার রচনাশৈলী একান্ত ভাবে তার নিজস্ব। বৈঠকি ঢংয়ে তিনি যে কোনো বিষয়কে সাবলীল, স্বচ্ছ ও সহজবোধের প্রকাশ করতে পারেন। শব্দপ্রয়োগে তিনি বক্তব্যকে রসালো করে তুলবার জন্য ‘যাবনী মশাল’ রীতির পক্ষপাতী। ফলে দেশি-বিদেশি, গুরু-চন্ডালী শব্দ ব্যবহারে তাঁর বিন্দুমাত্র দ্বিধা ছিল না। তাঁর ব্যক্তিত্ববোধের মধ্যে বিরাজ করত এক সদা কৌতুকী মন। ফলে অনেক গুরুগম্ভীর বিষয়কে তিনি সরস করে প্রকাশ করতে পারতেন আর তাতে বিষয়ের গুরুত্ব এতটুকু ক্ষুণ্ণ হতো না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর বার্লিনের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের চিত্র আঁকতে গিয়ে তাঁর উক্তি— “পয়লা বিশ্বযুদ্ধের পর হেথায় অবস্থা হয়েছিল ‘জর্মনির সর্বনাশ’ বিদেশির পৌষমাস। ইনফ্লেশনের গ্যাসে ভর্তি জর্মন কারেন্সির বেলুন তখন বেহেশতে গিয়ে পৌঁচেছে– বেহেশ্তাটা অবশ্যি বিদেশিদের জন্য, জর্মনরা কেউ পাঁচহাজার, কেউ দশহাজার বেলুন থেকে পড়ে গিয়ে প্রাণ দিচ্ছে। আত্মহত্যার খবর তখন আর কোনো কাগজে ছাপাত না, নারী-হৃদয় ইকনমিক্সের কমডিটি, এক ‘বার’ চকলেট দিয়ে এক সার ব্লন্ড কেনা যেত, পাঁচ টাকায় ‘ফার’ কোট, পাঁচশ টাকায় কুরফুস্টেন-ডামে বাড়ি এক টাকায় গ্যোটের কমপ্লীট ওয়ার্কস।”
আবার বিষয়বস্তুর অনুসারে তার প্রকাশভঙ্গিও কেমন পালটে যায়, তার উদাহরণও তাঁর রচনায় দুর্লক্ষ্য নয়। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার, বিশেষ করে সংস্কৃত শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে, লেখক অতি অল্পকথায়, অতি নিরাভরণ ভাষায় তার ছবি এঁকেছেন। সেখানে বাক-বৈদদ্ধের ছটা, তীব্র ব্যঙ্গের ফলা আদৌ নেই।
“গত শতকের শেষ আর এই শতকের গোড়ার দিকে আমাদের দেশের টোলগুলো মড়ক লেগে প্রায় সম্পূর্ণ উজাড় হয়ে যায়। মোগল-পাঠান আমলে যে দুর্দেব ঘটেনি ইংরাজ রাজত্বে সেটা প্রায় আমাদের চোখের সামনেই ঘটল। অর্থনৈতিক চাপে পড়ে দেশের কর্তাব্যক্তিরা ছেলেভাইপোকে টোলে না পাঠিয়ে ইংরেজি স্কুলে পাঠাতে আরম্ভ করলেন। চতুর্দিকে ইংরেজি শিক্ষার জয়-জয়কার পড়ে গেল—সেই ডামাডোলে বিস্তর টোল মরল আর বিস্তর কাব্যতীর্থ বেদান্তবাগীশ না খেয়ে মারা গেলেন এবং তার চেয়েও হৃদয়বিদারক হল তাঁদের অবস্থা যাঁরা কোনো গতিকে সংস্কৃত বা বাংলার শিক্ষক হয়ে হাই স্কুলগুলোতে স্থান পেলেন। এঁদের আপন আপন বিষয়ে অর্থাৎ কাব্য, অলঙ্কার, দর্শন ইত্যাদিতে এঁদের পান্ডিত্য ছিল অন্যান্য শিক্ষকদের তুলনায় অনেক বেশি কিন্তু সম্মান এবং পারিশ্রমিক এঁরা পেতেন সবচেয়ে কম। শুনেছি কোনো কোনো ইস্কুলে পণ্ডিতের মাইনে চাপরাশীর চেয়েও কম ছিল।”
হের ওবের্স্ট সম্পর্কে বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখকের উক্তি শাণিত, বুদ্ধিদীপ্ত, উপমা সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে— “দেখাই যাক্ না প্রাশন রাজপুত কি রকম কালিদাস পড়ায়। হের ওবের্স্টের চেহারাটি যদিও ভাবুকের মতো, তবু কুলোপনা চক্কর হলেই তো আর দাঁতে কালবিষ থাকে না।”
আবার কখনো মিশেল-ভাষার অব্যর্থ লক্ষ্যভেদী সন্ধান— “সমস্ত কাহিনি শুনে ফন্ ব্রাখেল পাঁচটি মিনিট ধরে ঠা-ঠা করে হাসলেন। হাসির ফাঁকে ফাঁকে কখনো বলেন, ‘ডু লীবার হের গট্’ (হে মা কালী), কখনো বলেন, ‘বী কোলিস্ (কি মজার ব্যাপার), কখনো বলেন ‘লাখেন ডি গ্যোটার’ (দেবতারা শুনলে হাসবেন)।
আমি বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালুম। ফন্ ব্রাখেল আমার কাঁধে দিলেন এক গুঁতা। ঝপ্ করে ফের বসে পড়লুম। বললেন, ‘ডু ক্লাইনের ইডিয়ট’ (হারাগঙ্গারাম), এখুনি, তোমার ফোন করে বলে দেওয়া উচিত, তোমার দ্বারা ওসব হবে-টবে না।”
শব্দ দিয়ে ছবি আঁকার দুর্লভ সৃজনশক্তি মুজতবার আয়ত্তে ছিল। রাইন নদীর বর্ণনায় লেখকের একদিকে ছবি আঁকার ক্ষমতা, অন্যদিকে অনুভববেদ্য কবিত্বশক্তির পরিচয় মেলে— “রাইন নদী কিছু ফেলনা নয়। দুদিকে পাহাড়, তার মাঝখানে দিয়ে রাইন সুন্দরী নেচে নেচে চলে যাবার সময় দু’পারে যেন দুখানা সবুজ শাড়ি শুকবার জন্য বিছিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। সে শাড়ি দুখানা আবার খাঁটি বেনারসী। হেথায় লাল ফুলের কেয়ারী, হোথায় নীল সরোবরের ঝলমলানি, যেন পাকা হাতের জরির কাজ। আর সেই শাড়ির ওপর দিয়ে আমাদের ট্রাম যেন দুষ্টু ছেলেটার মতো কারো মানা না শুনে ছুটে চলেছে। মেঘলা দিনের আলোছায়া সবুজ শাড়িতে সাদাকালোর আল্পনা এঁকে দিচ্ছে আর তার ভিতর চাঁপা রঙের ট্রামের আসা-যাওয়া—সমস্ত ব্যাপারটা যেন বাস্তব মনে হয় না ; মনে হয় হঠাৎ কখন রাইন সুন্দরীর ধমকে দুষ্টু ছেলেগুলো লীলাখেলা ঘুচিয়ে দেবেন।”
ধর্মের গোড়ামি সম্পর্কে লেখকের অকপট উক্তি— “উইলি ঠিকই বলেছে, ধর্মমাত্রই মোমবাতির আধা-আলোর কুসংস্কারে গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে পছন্দ করে, বিজলির কড়া আলোতে আত্মপ্রকাশ করতে চায় না।”
নির্বিচার শব্দব্যবহারে বাক্যবন্ধ ব্যঞ্জনাগর্ভ হয়ে ওঠে, সাবলীল স্বচ্ছন্দপ্রবাহ অব্যাহত থাকে, অথচ বক্তব্য বিষয় আদৌ জটিলতায় ঢাকা পড়ে না। মুজতবার রচনায় এমন দৃষ্টান্ত অজস্র মিলে। যেমন— “আরাম-আয়েশ ফূর্তি-ফার্তির বলতে গেলেই ইংরেজকে ফরাসি শব্দে ফরাসি ব্যঞ্জনা ব্যবহার করতে হয়। ‘জোয়া দ্য ভিভ্র’ (শুদ্ধমাত্র বেঁচে থাকার আনন্দ), ‘বঁ ভিভ’ (আরামে আয়েশে জীবন কাটানো), ‘গুরমে’ (পোষাকি খুশখানেওলা), ‘কন্যেস্যর’ (সমঝদার রসিকজন) এসব কথার ইংরেজি নেই। ভারতবর্ষে হয়ত এককালে ছিল হয়ত কেন, নিশ্চয়ই ছিল, মৃচ্ছকটিক, মালতীমাধব নাট্যে আরাম আয়েশের যে চৌকশ বর্ণনা পাওয়া যায় তার কুল্লে মাল তো আর গুল-মারা বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না—আজ নেই এবং তার কারণ বের করার জন্যও ঘেরন্ড-সংহিতা ঘাঁটতে হয় না। রোগশোক অভাব অনটনের মধ্যিখানে ‘গুরমে’ হওয়ার সুযোগ শতেকে গোটেক পায় কিনা সন্দেহ—তাই খুশ-খানা, খুশ-পিনা বাবুদের কথাগুলো বেবাক ভারতীয় ভাষা থেকে লোপ পেয়ে গিয়েছে, নতুন বোল-তালের প্রশ্নই ওঠে না।” (রাক্ষসী)
সাহিত্যপঞ্জী : সৈয়দ মুজতবা আলীর রচিতা গ্রন্থ তথা সাহিত্য পঞ্জীকে ক্রমিক পরম্পরায় সাজিয়ে নিম্নরূপ একটা খসড়া নির্মাণ করে যেতে পারে— ১। দেশে বিদেশে (১৩৫৬), ২। পঞ্চতন্ত্র (১ম পর্ব–১৩৫৯, ২য় পর্ব—১৩৭৩), ৩। চাচা কাহিনি (১৩৫৯), ৪। ময়ূরকণ্ঠী (১৩৫৯), ৫। অবিশ্বাস্য (১৩৬১), ৬। পূর্বপাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা (১৩৬৩), ৭। জলে ডাঙ্গায় (১৩৬৩), ৮। ধূপছায়া (১৩৬৪) ৯। দ্বন্দ্ব-মধুর (১৩৬৫), ১০। বড়োবাবু (১৩৭২), ১১। কত না অশ্রুজল (১৩৭২), ১২ হিটলার (১৩৭৭), ১৩ চতুরঙ্গ (১৩৬৭), ১৪। শবনম (১৩৬৭), ১৫। টুসিমেম (১৩৭০), ১৬। রাজা-উজির (১৩৭৬), ১৭। প্রেম (অনুবাদ) (১৩৭২), ১৮ দু-হাবা (১৩৭২), ১৯। হাস্য-মধুর (১৩৭৩), ২০। পছন্দসই (১৩৭৪), ২১। তুলনাহীন (১৩৮১), ২২ শহর ইয়ার (১৩৭৬), ২৩। মুসাফির (১৩৭৮), ২৪। শ্রেষ্ঠ গল্প (১৩৬৮), ২৫। ভবঘুরে ও অন্যান্য (১৩৬৯), ২৬। বহু বিচিত্রা (১৩৬৯), ২৭। শ্রেষ্ঠ রম্যরচনা (১৩৬৯), ২৮। পরিবর্তনে অপরিবর্তনীয় (১৩৮২)।