চৈতন্যের জীবন অবলম্বনে বাংলায় ‘চৈতন্য ভাগবত’ ও ‘চৈতন্য চরিতামৃত’
ইতিহাসে দেখা যায়, অনেক সময় একটি ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে, জাতির নবজাগরণের সূত্রপাত হয়। শ্রীচৈতন্যদেব সেই ধ্রুবতার যাঁকে কেন্দ্র করে অনাগত কালের বিচিত্র সম্ভাবনা মূর্ত হয়ে উঠেছিল। বাঙালির সমাজ-জীবন ও সাহিত্যে তাঁর প্রভাব হয়ে উঠেছিল সুদূর প্রসারী। তাঁকে কেন্দ্র করে যুগ জাগৃতির লক্ষণ দেখা গিয়েছিল। ফলে তাঁর দিব্যজীবনকে অবলম্বন করে বাংলা সাহিত্যে এক নতুন ধারার সূচনা হয়। তাঁর জীবনকে অবলম্বন করে জীবনী গ্রন্থ রচনার ধারাটি বিকশিত হয়। তাঁর মতো অন্য কেউ মধ্যযুগের দেব নির্ভর সমাজের উপর আপন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। চৈতন্যদেবের আবির্ভাব এবং বাঙালির আত্মচেতনার উজ্জীবন যেন প্রায় একই সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়। গবেষকের দৃষ্টিতে – “Chaitannyaism having practically created a greater Bengal.” তাই চৈতন্য চরিত সাহিত্য শুধু ভক্তিকাব্য নয়, সমকালীন শ্রেষ্ঠ মানবের জীবন-কাহিনিও বটে। চৈতন্যমন্ত্রে জাতির কুসংস্কারও ভেদ বিচার দূর করে তার শুদ্ধ চৈতন্য সম্পাদনে ব্রতী হয়েছিলেন কবিরা।
বৃন্দাবন দাস :
বাংলা ভাষায় প্রথম চৈতন্য চরিত গ্রন্থ বৃন্দাবন দাসের চৈতন্য ভাগবত’। পরবর্তী কালে কোনও কোনও কাব্যে গ্রন্থটির নাম ‘চৈতন্যমঙ্গল’ ও পাওয়া যায়। বৃন্দাবন দাসের এ গ্রন্থে নবদ্বীপে বৈষ্ণবধর্মের প্রচলিত রূপটি প্রতিফলিত হয়েছে। কবির ঐশ্বর্য মিশ্র ভক্তির দৃষ্টিতে শ্রীচৈতন্যদেব কৃষ্ণ ও রামচন্দ্রের অবতার রূপে কল্পিত। কারণ, যুগ সঙ্কটের কালে পাষণ্ডী দমন ও সাধুদের পরিত্রাণের জন্য শ্রীচৈতন্যদেবের অনিবার্য আবির্ভাব। প্রত্যক্ষভাবে কবি চৈতন্যলীলা দর্শন করেননি, নিজের স্বীকার করেছেন ঃ “হইল মনুষ্যজন্ম না হইল দরশন।” নিত্যানন্দ শিষ্য এই কবির জীবন সম্পর্কে সবিশেষ জানা যায় না। গ্রন্থ সাক্ষ্যে বোঝা যায়, শ্রীবাসের ভ্রাতুষ্পুত্র নারায়ণী দেবী ছিলেন কবির মাতা, নবদ্বীপে, আনুমানিক ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে কবির জন্ম হয়। পরে দেনুড় গ্রামে কবি বসবাস করেন।
চৈতন্যভাগবত আদি, মধ্য ও অন্ত্য এই তিনটি খণ্ডে বিভক্ত। রচনাকাল-১৫৪৮ খ্রিস্টাব্দ। আদি খণ্ডে ১৫টি অধ্যায়ে চৈতন্যের গয়াগমন পর্যন্ত বর্ণিত। মধ্যখণ্ডে ২৭টি অধ্যায়, চৈতন্যের সন্ন্যাস গ্রহণ পর্যন্ত বিবৃত। অস্ত্যখণ্ডে দশ অধ্যায়, নীলাচল কাহিনি বর্ণিত। আদিলীলা বর্ণনায় চৈতন্যভক্ত কবি বলেছেন বিদ্যারসে বৈকুণ্ঠের নায়ক বিহারে। দাস্যভাবের উপাসক কবি তনু-মন উৎসর্গ করে মহাপ্রভু জীবনকে ফুটিয়ে তুলেছেন। চৈতন্যদেবের মানবিক পরিচয়ে গ্রন্থটি আদ্যন্ত উদ্দীপ্ত, মধ্যযুগের সাহিত্য যখন একান্তভাবে দেবপ্রধান, মাটি ও মানুষের স্থান যখন সঙ্কুচিত, তখন এ হেন কাব্যে মানুবীয় ভাবের পরিচয় অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য। তাঁর কাব্যের সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য ইতিহাসের বিশ্বস্ত বিবরণ, চৈতন্য পূর্ব নবদ্বীপ বর্ণনায় বাস্তব চিত্র অঙ্কণ।
সকল সংসার মত্ত ব্যবহার রসে।
কৃষ্ণপুজা বিষ্ণুভক্তি নাহিকারো বাসে ৷৷
পঞ্চদশ ষোড়শ শতকের বাংলাদেশের নৈতিক অবক্ষয় সামাজিক জীবনে ব্যভিচারের যে ধস্ নেমেছিল, এ গ্রন্থের পাতায় পাতায় তা বর্ণিত।
কৃষ্ণদাস কবিরাজ :
কৃষ্ণদাসের ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থটি দর্শন, কাব্য ও ইতিহাসের আকর গ্রন্থ হিসাবে একটি উজ্জ্বল রত্নবিশেষ। গ্রন্থটির রচনাবাল বিতর্কের বিষয়। সুকুমার সেন কথিত ১৫৬০-৮০ খ্রিঃ গ্রন্থটির লিপিকাল। আদি, মধ্য, অস্ত্যলীলায় গ্রন্থটি গঠিত। আদি লীলায় প্রথম ১২ পরিচ্ছেদে মুখবন্ধ, শেষ পাঁচ পরিচ্ছদে চৈতন্যের বাল্যলীলা, কৈশোর ও যৌবনলীলার সারাংশ। মধ্যলীলার কাহিনি পট চৈতন্যের শেষ লীলার পূর্বাভাস, সন্ন্যাস গ্রহণ ও নীলাচলে গমন, দক্ষিণ ভ্রমণ, রামানন্দ রায়ের সঙ্গে তত্ত্বালোচনা, নীলচলে প্রত্যাবর্তন ও গৌড়ীয় ভক্তদের সঙ্গে মিলন রথযাত্রায় নৃত্য ইত্যাদি বিষয়। অন্ত্যলীলায় শিবানন্দ সেন ও পথের কুকুরের কাহিনি, রূপ গোস্বামীর নীলাচলে আগমন, প্রদ্যুম্ন মিশ্র ও রঘুনাথ দাসের কথা। মহাপ্রভুর বিরহ বিলাপ, বিরহোন্ম দিন যাপন ইত্যাদি বিষয় স্থান পেয়েছে। এক কথায় চৈতন্য চরিতামৃত—গীতা, গীতগোবিন্দ, অমরকোষ, পাণিনিসূত্র প্রভৃতি গ্রন্থের প্রভাব পুষ্ট একটি অনন্য গ্রন্থ।
বর্ধমান জেলার কাটোয়ায় ঝামটপুর গ্রামে বৈদ্য পরিবারের কবি কৃষ্ণদাস জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর এই গ্রন্থ তত্ত্বভাবনায় প্রোজ্জ্বল। স্বরূপ দামোদর রঘুনাথের পরমতত্ত্ব গ্রন্থটিতে ব্যাখ্যাত। ঈশ্বরের সঙ্গে জীবের ভেদাভেদ কি, সে সম্পর্কে বোঝাতে গিয়ে মন্তব্য করেছেন :
“ঈশ্বরের তত্ত্ব যেন জ্বলিত জ্বলন
জীবের স্বরূপ যৈছে স্ফুলিঙ্গের কণ।।”
এছাড়া, ‘অচিন্ত্য ভেদাভেদতত্ত্ব’ গ্রন্থটিতে সুপ্রতিষ্ঠিত। শ্রীমতী রাধা কৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তির অংশ। তিনি মহাভাবময়ী :
“হ্লাদিনী সার অংশ তার প্রেম নাম।
আনন্দ চিন্ময় রস প্রেমের আখ্যান।।
কৃষ্ণদাস কবিরাজ অন্যান্য কবিদের মতো তাঁর গ্রন্থে শ্রীচৈতন্যের আদি মধ্যলীলার বিশদভাবে বর্ণনা করে কালক্ষেপ করেননি। মূলত তিনি শ্রীচৈতন্যের নীলাচলে অন্ত্যলীলা বর্ণনায় মনোনিবেশ করেছেন। আবার বাসুদের সার্বভৌমের সঙ্গে বিচার, রায় রামানন্দের সঙ্গে পর্যালোচনা, যবন পন্ডিত প্রসঙ্গ, দাক্ষিণাত্য ভ্রমণের পুঙ্ক্ষানুপুঙ্কু বর্ণনার সাক্ষ্যে এই গ্রন্থ ঐতিহাসিকের কাছে মূল্যবান হয়ে উঠেছে। এইগ্রন্থের বিশেষত্ব চরিতকার চৈতন্যজীবনকে প্রথানুগ আবেষ্টনে আবদ্ধ করে রাখেননি। বস্তুত এই পরিশ্রমী ও প্রজ্ঞা কবি-স্বভাবের করক্ষেপে মহাপ্রভুর জীবন এক অলৌকিক আদর্শের চিরায়ত সংবেদনে উপনীত হয়েছে। অন্যদিকে চিত্ম্য বিভূতির সঙ্গে মানব জীবন রসের সম্পূর্ণ ও সুষম সমহারে এই যোগক্ষেম কবির শক্তি প্রমাণিত হয়েছে। তাই মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে এটি সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হয়ে ওঠার গৌরব অর্জন করেছে। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, বৃন্দাবন দাসের ‘চৈতন্য ভাগবত’ শ্রেষ্ঠ চৈতন্যজীবনী গ্রন্থ হিসাবে দাবী করতে সমর্থ হলেও তাতে বাল্য যৌবন-লীলা যেমন সুচার রূপে বর্ণিত হয়েছে, সে তুলনায় তত্ত্বভাবনা, দর্শন ইত্যাদি স্থান পায়নি। ভাগবতে যেমন লীলা প্রসঙ্গ প্রাধান্য পেয়েছে, চরিতামৃতে তেমনি প্রাধান্য পেয়েছে বিশেষ তত্ত্ব ভাবনা। তাই বলতে হয়, চৈতন্য জীবনী কাব্য হিসাবে উক্ত দুটি গ্রন্থ শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার হলেও ‘একে অপরের পরিপূরক’।