সূচনা: সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতা এক নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। মহেনজোদারাে, হরপ্পা, চানুহূদড়াে, কালিবঙ্গান, লােথাল প্রভৃতি নগরগুলিব প্রাপ্ত ধবংসাবশেষ থেকে এই সভ্যতার নগর পরিকল্পনার ধারণা পাওয়া যায়।
হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনা
[1] আঞ্চলিক বিভাজন: হরপ্পা নগরটির দুটি অংশ ছিল একটি পশ্চিমের উঁচু দুর্গাঞ্চল, অপরটি পূর্বের নিম্নাঞ্চল। দুর্গাঞ্চলে শাসক শ্রেণির লােকেরা বসবাস করত। আর নিম্নাঞ্চলে সাধারণ শ্রেণির মানুষ বসবাস করত। দুর্গ এলাকা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা থাকত।
[2] রাস্তা: সরল ও প্রশস্ত রাস্তাগুলি পূর্ব থেকে পশ্চিম ও উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে সমান্তরালভাবে বিস্তৃত ছিল। বেশিরভাগ রাস্তা একে অপরকে সমকোণে ছেদ করায় শহরগুলি বর্গাকার ও আয়তাকার ব্লকের রূপ নিয়েছিল। ৯ থেকে ৩৪ ফুট পর্যন্ত চওড়া রাস্তাগুলি ছিল চুন, সুরকি, পাথর ও পােড়া ইট দিয়ে তৈরি। রাস্তার দুধারে বাঁধানাে ফুটপাতে রাত্রে আলাের জন্য ল্যাম্পপােস্টের ব্যবস্থা ছিল। ফুটপাথ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য ছিল ডাস্টবিন।
[3] ঘরবাড়ি: আগুনে পােড়ানাে বা রােদে শােকানাে দুই ধরনের ইট দিয়েই ঘরবাড়ি তৈরি করা হত। দুকামরাবিশিষ্ট ছােটো গৃহ থেকে ত্রিশ কামরাবিশিষ্ট একতলা, দোতলা বা তিনতলা বাড়ির অস্তিত্ব ছিল বলে মনে করা হয়। পাশাপাশি নিম্ন অঞ্চলের উপকণ্ঠে শ্রমিক তথা গরিব শ্রেণির বস্তি গড়ে উঠেছিল। প্রতিটি গৃহেই শােবার ঘর, বসার ঘর, রান্নাঘর, স্নানঘর ও শৌচাগারের ব্যবস্থা ছিল। অধিকাংশ বাড়িতে রাস্তার দিকে কোনাে জানলা বা দরজা না রেখে ভেতরের উঠানের দিকে দু একটি জানলা, দরজা রাখা হত।
[4] পয়ঃপ্রণালী: হরপ্পা সভ্যতার পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত আধুনিক। জলনিকাশের জন্য রাস্তার নীচে দিয়ে পাথরের ঢাকনা দেওয়া নর্দমা থাকত। নর্দমাগুলি পরিষ্কার করার জন্য ইটের তৈরি ঢাকা ম্যানহােলের ব্যবস্থা ছিল। বড়াে নদমার সঙ্গে যুক্ত ছােটো নর্দমা দিয়ে প্রতিটি বাড়ির নােংরা জল বের করা হত।
[5] ম্নানাগার: মহেন-জো-দারাের দুর্গাঞ্চলে সর্বসাধারণের ব্যবহারযােগ্য এক বিশাল বাঁধানাে স্নানাগারের অস্তিত্ব মিলেছে। এর আয়তন দৈর্ঘ্যে ১৮০ ফুট ও প্রস্থ ১০৮ ফুট। স্নানাগারটির চারিদিকে রয়েছে ৮ ফুট উঁচু ইটের দেওয়াল। ঋতুভেদে জল গরম অথবা ঠান্ডা করার ব্যবস্থা ছিল। কাছের এক কূপ থেকে স্নানাগারটিতে জল সরবরাহ এবং পয়ঃপ্রণালীর দ্বারা এখানকার ময়লা জল বের করার ব্যবস্থা ছিল। স্নানাগারটিতে নামা-ওঠার জন্য দুপাশে ইটের সিঁড়ি ছিল।
[6] শস্যাগার: মহেন-জো-দারাে ও হরপ্পা দুই নগরে দুটি বিশাল আকারের শস্যাগার আবিষ্কৃত হয়েছে। হরপ্পার শস্যাগারটি রাভি নদীর প্রাচীন খাতের কাছে অবস্থিত ছিল। মহেন-জো-দারাের ধবংসাবশেষে প্রাপ্ত সর্ববৃহৎ দালানটিকে শস্যাগার বলেই অধিকাংশ পণ্ডিত মনে করেন।
[7] নির্মাণশৈলী: হরপ্পার ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট নির্মাণ এবং জলনিকাশি ব্যবস্থা সবকিছুতেই ছিল সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ছাপ, যা আধুনিক নগরের সঙ্গে তুলনীয়| নগরপুলিকে বিভিন্ন ধাপে একাধিকবার ভাঙাগড়ার মাধ্যমে নির্মাণ করা হয় বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন।
[8] গৌরব্যবস্থা: নগরগুলিতে কেন্দ্রীভূত পৌরব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল। নগরগুলির দেখাশােনার দায়িত্ব পালন করত পৌর প্রতিষ্ঠান। পৌর শাসনব্যবস্থার মান ছিল উন্নত। অধ্যাপক সরসীকুমার সরস্বতী বলেছেন, “এখানে একই প্রকৃতির শক্তিশালী ও কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা ছিল যা জনগণের জীবনযাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করত৷”
উপসংহার: সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনা আধুনিক যুগের মতােই উন্নত ও বৈচিত্র্যপূর্ণ ছিল। সুষ্ঠু নাগরিক পরিকল্পনা নগরবাসীকে সুখস্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনযাত্রা উপহার দিয়েছিল। প্রাচীন যুগের এমন উন্নত নগর পরিকল্পনা শুধু প্রাচীন ভারত নয় সমগ্র বিশ্বের প্রাচীন সভ্যতার এক অনন্য নজির।