স্যাডলার কমিশনের রিপাের্টে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার কোন্ কোন ত্রূটি উল্লেখ করা হয়? ওই দুটি নিবারণের জন্য যেসব সুপারিশ করা হয়, তা লেখাে।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার ত্রূটি

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার জুটির বিষয়ে স্যাডলার কমিশনের বক্তব্য হল-

(১) প্রশাসনিক কাজে দক্ষতার অভাব: বিশ্ববিদ্যালয়কে সবসময় প্রশাসনিক কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে উচ্চশিক্ষার মানােন্নয়নে সঠিকভাবে নজর নেওয়া সম্ভব হয় না। সে কারণেই উচ্চশিক্ষার মান নিম্নমুখী।

(২) আর্থিক দুরবস্থা: বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক অনুমােদিত মহাবিদ্যালয়গুলিতেও পঠনপাঠন সন্তোষজনক নয়। অধিকাংশ মহাবিদ্যালয় আর্থিক দুরবস্থায় ভােগে। শিক্ষার্থীদের বেতনের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করতে হয়। তাই উন্নয়নমূলক কাজে অর্থাভাব প্রকটভাবে বাধা সৃষ্টি করে।

(৩) কারিগরি ও বৃত্তিশিক্ষার অভাব: বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি কোর্সের পাঠক্রম মূলত তত্ত্বনির্ভর ও সাহিত্যধর্মী বিষয়ে পাঠ দান করা হয়। কারিগরি ও বৃত্তি শিক্ষার ব্যবস্থা না থাকায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কেরানি তৈরির কারখানাতে পরিণত হয়।

(৪) বক্তৃতাধর্মী শিক্ষণপদ্ধতি: মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাপদ্ধতি বক্তৃতাধর্মী হওয়ায় শিক্ষার্থীরা এতে খুব একটা অনুপ্রাণিত হয় না।

(৫) শিক্ষকদের স্বল্প বেতন ও চাকুরি ক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতা: মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন অল্প হওয়ায় এবং চাকুরির নিরাপত্তা না থাকায় মেধাবী ও যােগ্য ব্যক্তিরা এই পেশায় আসতে চায় না।

(৬) একমুখী ও বাস্তব সম্পর্কহীন গঠনপাঠন: মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠনপাঠন একমুখী ও বাস্তবজীবনের সঙ্গে সম্পর্কহীন হয়ে পড়েছে।

(৭) ছাত্রকল্যাণ বিষয়ে অবহেলা: বিশ্ববিদ্যালয় এবং মহাবিদ্যালয়গুলি ছাত্রকল্যাণের দিকেও সঠিকভাবে নজর রাখতে পারে না।

এককথায়, শিক্ষাব্যবস্থা জীবনমুখী না হওয়ায়, শিক্ষার্থীদের কাছে এই ধরনের শিক্ষার পরিবেশ অবাঞ্ছনীয় মনে হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা বিষয়ে স্যাডলার কমিশনের সুপারিশ

কমিশন বিশ্ববিদ্যিালয় শিক্ষার নানা ত্রুটি ও সমস্যা অনুসন্ধানের পর তা দূর করার উপায় হিসেবে যে সুপারিশ করেন, তা এখানে উল্লেখ করা হল-

(১) বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মর্ভার লাঘব করার বিষয়ে

  • ‘ইন্টারমিডিয়েট শ্রেণির পঠনপাঠন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।
  • মাধ্যমিক এবং ইন্টারমিডিয়েট স্তরের শিক্ষাক্রম পরিচালনার ভার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তে পৃথক বাের্ড বা শিক্ষা পর্ষদের ওপর ন্যস্ত করতে হবে।
  • বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকে এমনভাবে পুনর্বিন্যস্ত করতে হবে যাতে এটি একটি প্রকৃত শিক্ষাধর্মী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
  • কলিকাতার বাইরের মহাবিদ্যালয়গুলিকে এমনভাবে উন্নত করতে হবে, যাতে আগামী দিনে সেগুলি একটি করে পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।

(২) পঠনপাঠনের কোর্স ও শিক্ষাদানের জুটি দূর করার বিষয়ে

  • ‘ইন্টারমিডিয়েটের পর ত্রৈবার্ষিক স্নাতক কোর্স চালু করতে হবে।
  • বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত মহাবিদ্যালয়গুলিতে নতুন নতুন কোর্স পড়ানাের ব্যবস্থা করতে হবে।
  • স্নাতক স্তরে পাস কোর্সের পাশাপাশি অনার্স কোর্সও চালু করতে হবে।
  • শিক্ষাদানকে কেবলমাত্র বক্তৃতাধর্মী না রেখে টিউটোরিয়াল ক্লাসের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে ছাত্র-অধ্যাপক সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হবে এবং শিক্ষার প্রকৃত পরিবেশ সৃষ্টি হবে।
  • বিভিন্ন ধরনের বৃত্তিমুখী পাঠক্রম চালু করতে হবে।
  • ভারতীয় ভাষার চর্চাকে উৎসাহ দানের উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় ভাষার অধ্যাপক সৃষ্টি করতে হবে।
  • পাস এবং অনার্স, উভয় কোর্সেই ভারতীয় আধুনিক ভাষা নিয়ে পঠনপাঠনের জন্য প্রয়ােজনীয় সুযােগ সৃষ্টি করতে হবে।
  • বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাপদ্ধতিরও পুনর্বিন্যাস ও সংস্কার করতে হবে।

(৩) প্রয়ােজনভিত্তিক বিভিন্ন নতুন কোর্স প্রবর্তনের বিষয়ে

  • বিদ্যালয় স্তরে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক সরবরাহের উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘এডুকেশন ডিপার্টমেন্ট খুলতে হবে।
  • স্নাতক স্তরে এবং ইন্টারমিডিয়েট স্তরে এডুকেশন একটি বিষয় হিসেবে পড়ানাের ব্যবস্থা করতে হবে।
  • বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও কারিগরি বিষয়ে শিক্ষা সম্প্রসারণের দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়কে গ্রহণ করতে হবে।
  • শিক্ষার্থীর স্বাস্থ্যোন্নতির বিষয় লক্ষ করার জন্য ডিরেক্টর অব ফিজিক্যাল এডুকেশন নিযুক্ত করতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে শারীরশিক্ষা বিষয়ে পঠনপাঠন চালু করতে হবে।
  • ছাত্রমঙ্গলের বিষয়ে নজরদারি করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রমঙ্গল সংস্থা (Board of Student’s Welfare) গঠন করতে হবে।
  • পনেরাে-ষােলাে বছর বয়সি বালিকারা যাতে শিক্ষালাভের সুযােগ পায়, তার জন্য পর্দাঙ্কুল” সংগঠন গড়ে তুলতে হবে এবং নারীশিক্ষার বিকাশ ত্বরান্বিত করার জন্য প্রয়ােজনীয় বিশেষ বাের্ড গঠন করতে হবে।

(৪) বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন বিষয়ে

  • বিশ্ববিদ্যালয়গুলি যাতে নিছক সরকারি বিভাগে পরিণত না হয়, তার জন্য প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মােট কথা, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালন ব্যবস্থা সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত হবে।
  • মহাবিদ্যালয়গুলির শিক্ষকবৃন্দ যাতে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে, তার জন্য পরিচালক সমিতিতে তাদের প্রতিনিধি সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে।
  • বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে নমনীয় নীতি পালনের ওপর জোর দিতে হবে৷
  • বিশ্ববিদ্যালয়, পরিচালনার ক্ষেত্রে ‘সিনেট এবং সিন্ডিকেট-এর পরিবর্তে একটি ব্যাপক প্রতিনিধিমূলক সমিতি তথা ‘কোর্ট’ (Court) এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাত্যহিক কাজকর্ম পরিচালনার জন্য একটি ক্ষুদ্র কার্যকরী কমিটি (Executive Council) গঠন করতে হবে।
  • বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়ােগ, পরীক্ষা পরিচালনা, পাঠক্রম প্রণয়ন, ডিগ্রি বিতরণ প্রভৃতি বিষয় পরিচালনার জন্য একটি ‘অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল গঠনের এবং বিভিন্ন বিষয়ের জন্য ‘ফ্যাকাল্টি ও ‘বাের্ড অব স্টাডিজ গঠন করতে হবে।
  • প্রতিটি বিষয়ে পঠনপাঠনের সুবিধার জন্য স্নাতকোত্তর স্তরে বিষয়ভিত্তিক বিভাগ চালু করতে হবে এবং প্রতিটি বিভাগে একজন করে বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক নিয়ােগ করতে হবে।
  • প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন করে পূর্ণ সময়ের বেতনভুক্ত উপাচার্য নিয়ােগের ব্যবস্থা করতে হবে৷
  • বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সমন্বয়সাধনের উদ্দেশ্যে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় বাের্ড (Inter-university Board) গঠন করতে হবে।
  • বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরি ও পদোন্নতির বিষয় সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য ‘বিশ্ববিদ্যালয় সার্ভিস কমিশন গঠন করতে হবে।

Education সব প্রশ্ন উত্তর (একাদশ শ্রেণীর)

Leave a Comment