“ভূতের রাজত্বে আর কিছুই না থাক…শান্তি থাকে”- মন্তব্যটি ব্যাখ্যা করাে
উদ্ধৃত অংশটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কর্তার ভূত’ রচনা থেকে নেওয়া হয়েছে। রচনাটি “লিপিকা গ্রন্থের একটি গল্পিকা। প্রাচ্যের দেশগুলি তাদের প্রাচীন কুসংস্কারকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে। পুরােনাে অচল এইসব নিয়মনীতিকে ভূতের প্রভাব বলে মনে করা হয়েছে।
ভূত অর্থাৎ অতীত যখন বর্তমানের ওপর জাঁকিয়ে বসে, তখন সেই ভূতের রাজত্বে একটা অদ্ভুত শান্তি বিরাজ করে। এ দেশবাসী চোখ কান বুজে অলস জীবন কাটায় এবং কিছু ব্যাঘাত ঘটলেই ভূতের ঘাড়ে দোষ চাপিয়েই নিশ্চিন্তে বসে থাকে।
তাই তাদের মধ্যে কোনাে অশান্তি, নড়াচড়া বা পরিবর্তন হয় না। এতে দেশের উন্নতি হােক কি না হােক, দেশের সকল লােক শান্তিতে বসবাস করে। তাই বাইরের আক্রমণ তাদের স্থবির জীবনকে আন্দোলিত করে না, কারণ প্রতিবাদের ভাষা এবং বিদ্রোহ করে ছিনিয়ে নেবার মনােভাব এদের কোনােকালে জেগে ওঠে না। যাই ঘটে তাই তাদের কাছে ভবিতব্য বা ভূতের ক্রিয়াকলাপ।
ব্যঙ্গের চাবুকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমকালীন বৃহত্তর সমাজ মানসিকতার উপর এভাবেই আঘাত হেনেছেন। বাস্তব-চেতনা নিয়েই তিনি ভারতবাসীর মূল্যায়ন করেছেন। ভারতবাসী যত অত্যাচারিত হােক না কেন আদতে তারা শান্তিপ্রিয় মানুষ।
কেন কিছু দেশবাসীর ভূতশাসনতন্ত্র নিয়ে দ্বিধা জাগল?
‘কর্তার ভূত’ রচনায় রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন যে আমাদের দেশ কীভাবে ভূতের দ্বারা পরিচালিত। এখানে রাজার রাজতন্ত্র, জনগণের গণতন্ত্র, প্রজার প্রজাতন্ত্র কোনােটাই গড়ে ওঠেনি—কারণ মানুষ অতীতকে এতটাই ভালােবেসে ফেলেছে যে অতীতের ভূতকেও জোর করে আঁকড়ে ধরে আছে।
প্রাচীন নিয়মকানুন বা কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে এরা দিব্যি নিশ্চিন্তে দিন কাটাচ্ছে। এই ভূতশাসনতন্ত্রে তারা সব কিছু দেখেশুনেও না দেখার ভান করে চোখ বুজে ঘুমিয়ে রয়েছে। কোনােরকম পরিবর্তন এদেশকে স্পর্শ করতে পারে না। তাই এদেশের উন্নতিও ঘটে না।
এই ভূতশাসনতন্ত্র নিয়ে কারাের মনে কোনােরকম দ্বিধা জেগে উঠত না। এমনভাবেই তাদের দিন চলত যাতে চিরকালই তারা গর্ব করতে পারত যে এদের ভবিষ্যৎটা। পােষা ভেড়ার মতাে ভূতের খোঁটায় বাধা। কিন্তু পৃথিবীর অন্যসব দেশগুলােকে এদেশের মতাে ভূতে পায়নি।
তারা তাদের পুরােনাে। বস্তাপচা নিয়মকানুনগুলােকে বহুদিন আগে ঝেড়ে ফেলে আধুনিকতাকে সসম্মানে গ্রহণ করেছে। তাই এরা অগ্রগতির চরম শীর্ষে অবস্থান করছে, যা দেখে সকলে ঈর্ষান্বিত না হয়ে পারছে। না। তাই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে টিকে থাকতে গেলে এদেশের নিয়মকানুনের পরিবর্তন প্রয়ােজন। ভূতকে ঘাড় থেকে নামাতে না পারলে আধুনিক বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এদেশের পদানত হবে না। এ কথাই লেখক বলতে চেয়েছেন।
‘কর্তার ভূত’-রচনাটির নামকরণের সার্থকতা বিচার করাে।
নামকরণ রচনাকে কেবল চিহ্নিতই করে না, এটি পাঠকের কাছে রচনাটিতে প্রবেশের চাবিকাঠিও।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কর্তার ভূত’ ছােটোগল্পে আমরা দেখি যে, বুড়াে কর্তার মৃত্যুকালে দেশবাসী অভিভাবকহীন হওয়ার ভয়ে ভীত হলে ভগবানের দয়ায় অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের সুরাহা না হলেও, তারা শান্তিতে রইল। দু-একজন মানুষ ভূতশাসনতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন করলে তাদের ভাগ্যে জুটল ভূতের কানমলা। বাকিরা গর্বের সঙ্গেই দিন কাটাতে লাগল।
অবশ্য, ভুতুড়ে জেলখানার দেয়ালটাই যেহেতু চোখে দেখা যায় না, সেহেতু সেই জেল থেকে বেরােনাের উপায়ও কারও জানা নেই। আর, এই জেলের ঘানি ঘােরালে পেষণকারীর তেজ বেরিয়ে যায় বলে সে ঠান্ডা হয়ে যায়। শিরােমণি-চুড়ামণির দল জানায়, “বেঁহুশ যারা তারাই পবিত্র, হুঁশিয়ার যারা তারাই অশুচি।” হুঁশিয়ার দেশবাসীর উদ্দেশ্যে ভূতের নায়েব শাসানি দেয়—“চুপ।
এখনাে ঘানি অচল হয় নি।” দেশের মানুষ এই অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি পেতে চাইলেও কর্তার নিয়ন্ত্রণমুক্ত হতে তারা ভয় পায়। কর্তা বলেন, সেইখানেই তার ভূত। এইভাবে লেখক এ গল্পে প্রাচীন সভ্যতা-রূপী কর্তার ধর্মতন্ত্র রূপী ভূত-এ আষ্টেপৃষ্ঠে আচ্ছন্ন আমাদের সমাজব্যবস্থার সমালােচনা করেছেন। তাই, কর্তার ভূত নামকরণটি নিঃসন্দেহে শিল্পসম্মত, ব্যঞ্জনাময় এবং সার্থক।
রবীন্দ্রনাথের ‘কর্তার ভূত’ রচনাটির ভাষাশৈলী তথা রচনাশৈলী পর্যালােচনা করাে।
রবীন্দ্রনাথের ‘লিপিকা’ গ্রন্থের অন্তর্গত কর্তার ভূত ছােটোগল্পটির বাইরের আখ্যানের আড়ালে লুকিয়ে আছে আর একটি সমান্তরাল অন্তর্নিহিত আখ্যান, যেটিই মুখ্য। রূপকের আড়ালে এ গল্পের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন যে, আধুনিককালেও প্রাচীন সভ্যতার ধর্মতন্ত্রে আচ্ছন্ন হয়ে দেশবাসী কেমন যুক্তিবুদ্ধি-বিচার-বিবেচনাহীন হয়ে দিন কাটিয়ে চলেছে। সূক্ষ্ম ব্যঙ্গের সহায়তায় এবং রূপকথা ও লােকসাহিত্যের বিভিন্ন অনুষঙ্গকে ব্যবহার করে এই রূপকার্থটি লেখক এ গল্পে প্রকাশ করেছেন।
এ গল্পে তাই ভূত-প্রেত-দত্যি-দানাের প্রসঙ্গ এসেছে, এসেছে ভগবানের প্রসঙ্গও। খােকা ঘুমােলাে, পাড়া জুড়ােলাে-এই অতিপরিচিত ছেলেভুলানাে ছড়াটির প্রথম দুই পঙ্ক্তির টুকরাে টুকরাে অংশকে এ গল্পে ব্যবহার করে লেখক যেমন দেশবাসীর নিদ্রাচ্ছন্ন অবস্থাকে তুলে ধরেছেন, তেমনি উপস্থাপিত করেছেন তাদের পশ্চাৎমুখিতাকে। আর তা করতে গিয়ে লেখক ব্যবহার করেছেন গদ্যকাব্য রচনার উপযােগী সহজ-সরল, ভাবপ্রবণ ভাষা। সুতরাং শুধু বিষয়গত দিক দিয়েই নয়, রচনাশৈলীর দিক দিয়েও ‘কর্তার ভূত’ ছোট গল্প একটি প্রতিনিধিত্থানীয় রচনা।